বিদ্যুৎ খাত : স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রস্তুতি
প্রকাশিতঃ 5:33 pm | March 14, 2024
মোহাম্মদ হোসাইন :
শুরুতেই আমি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যিনি ভাষা আন্দোলনকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে স্বাধীনতার বীজ বপন করেছিলেন। আমি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি ১৯৫২ সালের ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারির মিছিলে মাতৃভাষার জন্য আত্মোৎসর্গকারী শহিদ রফিকউদ্দিন আহমদ, আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, আবদুস সালাম ফেব্রুয়ারি শফিকুর রহমান, এবং ২২ আউয়াল, অফিউল্লাহ ও অজ্ঞাত বালকসহ সব ভাষা শহিদের যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আজ আমরা স্বাধীন দেশে মাখা। উচিয়ে মাতৃভাষার চর্চা এ করে করে য যাচ্ছি। পিতা বঙ্গবন্ধু ৩ স্বল্পকালীন রেখে গেছেন। তিনি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনে অসংখ্য কাজ করে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত পথে যদি বাংলাদেশ চলতে পারত তা হলে আমরা অনেক আগেই একটি উন্নত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ পেতাম। পঁচাত্তর-পরবর্তী বাংলাদেশে নেমে আসে অন্ধকারের অমানিশা এবং যা অব্যাহত থাকে দীর্ঘ ২১ ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের আগা পর্যন্ত। বঙ্গবন্ধুর প্রদর্শিত পথেই জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে তাঁরই সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা নিরলস কাজ করে চলেছেন এবং বাংলাদেশকে আজ এক অনন্য উচ্চতায় আসন করিয়েছেন।
বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম জনসংল দেশ এবং দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। ইতিপূর্বে এ দেশের অর্থনীতি ছিল কৃষিনির্ভর কিন্তু বর্তমানে ইরে ধীরে এটি একটি শিল্পভিত্তিক অর্থনীতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশ অগ্রসরমাণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, দ্রুত নগরায়ণ এবং শিল্পায়ন বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্রমবর্ধমান শিল্পায়ন ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড একদিকে যেমন বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি স্থিতিশীল রেখেছে, সেই সঙ্গে বাড়িয়েছে বিদ্যুতের চতের চাছিনা। এই চামিদা বৃদ্ধির যারও গড়ে বছরে ১১ শতাংশ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করার লক্ষ্যে ঘোষিত ‘ভিশন ২০২১’-এর ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্য ইতিমধ্যেই অর্জিত হয়েছে এবং বাংলাদেশ একটি স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত, সমৃদ্ধ ও স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে ‘ভিশন ২০৪১’ ঘোষনা করা হয়েছে। সরকারের প্রতিশ্রুত ডিজিটাল বাংলাদেশ’ প্রায় শতভাগ দৃশ্যমান ভাজ। এপ্রিল ২০২২ ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্সের’ ডীয় সভায় প্রধানমন্ত্রী ২০৪১ সালের মধ্যে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ ভিশন বাস্তবায়নে কার্যক্রম শুরু করার নির্দেশনা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আগামীর বাংলাদেশ হবে স্মার্ট বাংলাদেশ। ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে ২০৪১ সালে আমরা স্মার্ট বাংলাদেশে চলে যাব। এটাই এখন আমাদের টার্গেট। স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট ইকোনমি, স্মার্ট গভর্নমেন্ট ও স্বার্ট সোসাইটি-এ চারটি মৌলিক অন্তের ওপর ভিত্তি করে আগামীর বাংলাদেশ বাংলাদেশ। দেশের। শের প্রতিটি নাগরিক ও ক প্রযুক্তি ব্যবহারে হবে দক্ষ ও উপযোগী, অর্থনীতির সব লেনদেন ও ব্যবহার হবে প্রযুক্তিনির্ভর, সরকারি সব সুযোগ- সুবিধা ও কর্মকান্ডসহ সর্বত্র হবে প্রযুক্তির ব্যবহার এবং আমাদের পুরো সমাজটাই হবে প্রযুক্তিবান্ধব।
২০২৪ সালের সূচনালগ্নে এসে দেখা যাচ্ছে যে, প্রধানমন্ত্রী। শেখ হাসিনার দূরদর্শী, সাহসী ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের ফলে এক যুগে বিদ্যুৎ খাতে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়েছে যা বিগত ১০০ বছরেও হয়নি। ‘শেখ হাসিনার উদ্যোগ, ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ’-প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের মাধ্যমে বিদ্যুতের সুবিধাভোগীর সংখ্যা শতভাগের মাইলফলক অর্জন করায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২২ মার্চ ২০২২ শতভাগ জনগণকে বিদ্যুতের আওতায় আনার ঘোষণা দিয়েছেন। বর্তমানে সরকার নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সুবিধা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ হাজার মেগাওয়াট ও ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা পূরণকল্পে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহন করা হবে স্মার্ট হয়েছে। জনুয়ারি ২০০৯ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ২৪ হাজার ২১০ > মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হয়েছে। ফলে বিদ্যুতের স্থাপিত ক্ষমতা ক্যাপটিভসহ ২৯ হাজার ৭২৭ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে যা সরকার গৃহীত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি এবং নির্দিষ্ট সময়সীমার পূর্বেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে। বিদ্যুতের সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠী ইতিমধ্যেই ১০০ ভাগে উন্নীত হয়েছে। তা ছাড়া ১০ হাজার ৩৫৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার ২৯টি বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রবল্প নির্মানাধীন, ৩ হাজার ৩০৪ মেগাওয়াট ক্ষমতার ২২টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের চুক্তি স্বাক্ষর এবং ৬২৮ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৭টি বিদ্যুৎকেন্দ্রের দরপত্র প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ২০৩০ সাল পর্যন্ত ৯ হাজার ৮২১ মেগাওয়াট ক্ষমতার ৩৫টি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। পুরোনো বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো সংরক্ষণ ও মেরামতের মাধ্যমে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সরকারের বিগত তিন মেয়াদে বিদ্যুৎ সঞ্চালন ও বিতরণ লাইন নির্মাণের ক্ষেত্রে ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। বর্তমানে মোট সঞ্চালন লাইনের পরিমাণ ১৪ হাজার ৯৬১ সার্কিট কিলোমিটার এবং বিতরণ লাইনের পরিমাণ ৬ লাখ ৪৩ হাজার কিলোমিটারে উন্নীত হয়েছে। বিদ্যুতের সামগ্রিক সিস্টেম লস ২০০৮-০৯ অর্থবছরে ১৬.৮৫ শতাংশ থেকে ৬.৫৪ শতাংশ হ্রাস পেয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১০.৩১ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
প্রাত্যহিক জীবনের সঙ্গে বিদ্যুৎ এখন ওতপ্রোতভাবে অড়িত। বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে কিন্তু এই খাতটির নির্ভরযোগ্যতা এবং বিদ্যুতের মানকে ঘিরে নানাবিধ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ বিভাগ সামগ্রিক ক্ষমতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করতে এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্যগুলো পূরণ করতে চাচ্ছে। স্বার্ট গ্রিড প্রযুক্তি বাস্তবায়ন এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে পরিত্রাণ পেতে সাহায্য করতে পারে। কাজেই স্মার্ট বাংলাদেশ নিশ্চিতকরণে বিদ্যুৎ খাতকেও হতে হবে স্মার্ট তথা নির্ভরযোগ্য ও আধুনিক। সেই লক্ষ্যে বিদ্যুৎ বিভাগ বর্তমানে স্মার্ট গ্রিভ ব্যবস্থা প্রচলনসহ সামগ্রিক বিদ্যুৎ উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থাকে স্মার্ট তথা তথা ত আধুনিকায়নের ওপর জোর দিয়েছে। এতদসত্ত্বেও বিদ্যুৎ খাতের সাময়িক উন্নয়নের পথে কতিপয় প্রতিবন্ধকতা বিরাজমান রয়েছে। নিম্নে প্রতিবন্ধকতা ও উত্তরণের উপায়ের ওপর আলোকপাত করা হলো।
প্রতিবন্ধকতাগুলো-
প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ হ্রাস: ২০০৯ সালের আগে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উৎপাদন মূলত প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর অত্যধিক নির্ভরশীল ছিল। দেশীয় গ্যাসের মজুদ প্রত্যাশার চেয়েও দ্রুত ফুরিয়ে যাওয়ার প্রেক্ষিতে আগামী কয়েক বছর বাংলাদেশ যে বড় আালেঞ্জের মুখোমুখি হবে তার মধ্যে অন্যতম হলো বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিকল্প জ্বালানির সংস্থান করা। এই প্রেক্ষাপটে বিদ্যুৎ খাতকে নিজস্ব গ্যাসনির্ভর না রেখে কয়লা, এলএনজি, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, পারমানবিক এবং অন্যান্য বিকল্প জ্বালানির ওপর অধিক গুরুত্ব প্রদান করতে হবে।
বিনিয়োগ: বিদুৎ গাত একটি বিনিয়োগ ঘন গাত। চাহিদানুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিশাল পরিমাণ অর্থায়ন নিশ্চিত করা বাংলাদেশের জন্য অন্যতম ঢালেঞ্জ। পিএসএমপি ২০১৬ অনুসারে বিদ্যুতের চাহিদা পূরণে ২০৩০ এবং ২০৪১ সালের জন্য উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে যথাক্রমে ৪০ হাজার মেগাওয়াট এবং ৬০ হাজার মেগাওয়াট। এই গাতে ২০৩০ সালের মধ্যে ৪০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৮০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করতে হবে। ইতিমধ্যে উৎপাদন, সঞ্চালন ও বিতরণ খাতে ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে। সরকারের একার পক্ষে এই বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ নিশ্চিত করা সহজসাধ্য নয় বিধায় বেসরকারি বিনিয়োগ এবং উন্নয়ন সহযোগীদের এই গাতে অর্থায়নসহ দাতা ও নতুন নতুন অর্থায়নের পথ উন্মোচন করতে হবে।
অবকাঠামোগত উন্নয়ন: বিদ্যুৎ খাতে প্রাথমিক জ্বালানি হ্রাসের প্রেক্ষাপটে প্রাথমিক জ্বালানি আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো যেমন, গতীর সমুদ্রবান্দর এবং প্রাথমিক জ্বালানি সুচারুভাবে পরিবহনের জন্য কয়লা টার্মিনাল, এলএনজি টার্মিনাল এবং সমগ্র দেশব্যাপী সড়ক, রেলপথ, নদীপথে জ্বালানি পরিবহনযোগ্য অবকাঠামো নির্মাণ করা দরকার।
পুরোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিস্থাপন: বিপিডিবির
মালিকানাধীন অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্রই যথেষ্ট পুরোনো এবং অদক্ষ। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো অবসরে পাঠানো এখন সময়ের দাবি। এর মধ্যে কয়েকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নতুন প্রযুক্তির দ্বারা আধুনিকায়ন এবং নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র দ্বারা প্রতিস্থাপন করা দরকার। প্রকল্প বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতা সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতের কার্যকর অংশীদারত্বের কারণে বিদ্যুৎ খাতে এক যুগান্তকারী সাফল্য সম্ভব হয়েছে। তবে বেসরকারি খাতের কয়েকটি প্রকল্প, বিশেষত সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলো সময়মতো জমির প্রাপ্যতা ও
বিনিয়োগ প্রাপ্তিতে অনিশ্চয়তার কারণে লক্ষ্যমাত্রার
চেয়ে অনেক পিছিয়ে রয়েছে।
গ্রিড স্থিতিশীলতা: বিদ্যুৎ উৎপাদনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সঞ্চালন ও বিতরণ ব্যবস্থার উন্নয়ন সমহারে বাড়ছে না, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গ এবং ময়মনসিংহ অঞ্চলে চাহিদানুযায়ী মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ বাহানায় হচ্ছে। নভেম্বরের ২০১৪ এবং অক্টোবর ২০২২-এ সংঘটিত দেশব্যাপী ব্ল্যাকগ্রাউটের মতো অপ্রত্যাশিত বিভ্রাট দেশের বিদ্যুৎ গ্রিডের সুরক্ষা এবং স্থায়িত্বের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রিয় ফ্রিকোয়েন্সি একটি স্থিতিশীল গ্রিডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক ও নির্দেশক। গ্রিড কোড অনুযায়ী গ্রিড ফ্রিকোয়েন্সি বজায় রাখা সম্ভব হচ্ছে না যা মানসম্পন্ন ও নির্ভরযোগ্য মিডের ক্ষেত্রে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা।
বিতরণে প্রতিবন্ধকতা: বিতরণ খাতে বিগত এক যুগে বিদ্যুৎ বিভাগ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ নতুন লাইন যুক্ত করাতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশে বিতরণ সাইনের পরিমাণ বর্তমানে ৬ লাখ কিলোমিটারের অধিক। দৃশ্যমান অগ্রগতি সত্ত্বেও বর্তমান অবকাঠামো একটি নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা নিশ্চিত করার পক্ষে পর্যাপ্ত নয়। পর্যান্ত উৎপাদন ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও ওভারলোডেড বিতরণ নেটওয়ার্ক, আধুনিক মনির্জরং প্রযুক্তি এবং উন্নত সরঞ্জাম ইত্যাদির অভাবে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ বাযজ্ঞার হচ্ছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির সম্প্রসারণে জমির স্বল্পতা অভাবিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সত্তেও বাংলাদেশে অর্থনীতি এখনও কৃষিনির্ভর। বিদ্যুৎ খাতে পৌরবিদ্যুতের জন্য অকৃষিজ জমির যথেষ্ট স্বল্পতা রয়েছে। নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য জমি খুঁজে পাওয়া বর্তমানে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ওঠার উপায়-
জ্বালানি বহুমুখীকরণ: বর্তমানে দেশীয় গ্যাসের মজুদ ক্রমশ কমে যাওয়ায় সরকার দেশীয় গ্যাসের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে অন্যান্য প্রাথমিক অ জ্বালানি উৎসকে বিশ্চেনায় নিয়ে জ্বালানি মিশ্রণকে বহুমুখীকরণের ওপর গুরুত্ব প্রদান করেছে। জ্বালানি সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সরকার গ্যাস, কয়লা, এলএনজি, তরল জ্বালানি, ছৈন- জ্বালানি, পারমাণবিক এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে বিবেচনায় নিয়ে আইইপিএমপি-২০২৩ প্রস্তুত করেছে। এ ছাড়াও সরকার প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে বিদু্যুৎ আমদানির উদ্যোগও গ্রহণ করেছে। বর্তমানে ভারত থেকে আন্তঃদেশীয় বিদ্যুৎ সহযোগিতার আওতায় ১ হাজার ১৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা হচ্ছে। নেপাল থেকে ৪০ মেগাওয়াট বিদু্যুৎ আমদানির চুক্তি শিগগিরই সম্পাদন করা হবে।
এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র: জ্বালানি বহুমুখীকরণের অংশ হিসেবে সরকার নিজস্ব গ্যাসের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনতে এলএনজি আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যা কেবল বিদ্যমান গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে গ্যাস সরবরাহই করবে না বরং বেশ কয়েকটি এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়নেও সহায়তা করবে। বর্তমান দুটি এফএসআরইউর পাশাপাশি আরও ২টি এফএসন্ডারইউ স্থাপনের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তা ছাড়া Land Based LNG নির্মিনাল স্থাপনের উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়েছে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সরকার জ্বালানি হিসেবে কয়লানির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন থেকে এখনই পুরোপুরি সরে আসছে না। বাংলাদেশ তার দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে বদ্ধপরিকর। সরকার তাই আমদানিকৃত কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশাপাশি নিজস্ব কয়লা গনি। থেকে কয়লা উত্তোলনের উদ্যোগ নিয়েছে। ফলে নিজম্ব কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন।
পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র: একইভাবে বাংলাদেশ ২০২৪ সালের শেষের দিকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে ১ মাজার ২০০ মেগাওয়াট এবং ২০২৫ সালে আরও ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে সক্ষম হবে। মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের প্রায় ১০ শতাংশ পারমাণবিক শক্তি উৎস থেকে আসবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
বিনিয়োগ নিশ্চিতকরণ: বিদ্যুৎ খাতের জন্য বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগের প্রয়োজন মেটাতে সরকার ক্রমাগত যথোপযুক্ত বিনিয়োগ উৎসের অনুসন্ধান করে চলেছে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, বর্তমানে জিও, জি-টু-জি এবং অন্যান্য ইনোভেটিভ বিনিয়োগ দ্বারা অর্থায়নের মাধ্যমে চলমান বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর কার্যক্রম বাস্তবায়ন চলছে। Bidders Financing, Export Credit Agency মাধ্যমে বিনিয়োগ নিশ্চিতকরণের ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ খাতকে পথিকৃত বলা চলে। বিদেশি পুঁজিবাজারে বন্ড ঘেড়ে ঋণের বিকল্প অর্থায়নের চেষ্টা করছে। শক্তিশালী মেকানিজম, গাইডলাইনস, পর্যাপ্ত ক্ষমতা ইত্যাদির সাহায্যে বিদু্যুৎ খাতাটির জন্য প্রতিযোগিতামূলক অর্থের সুনির্দিষ্ট জোগান নিশ্চিত করতে বিশেষায়িত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সন্ধান করা দেতে পারে। এ জাতীয় প্রতিষ্ঠান বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। বিভিন্ন গ্রিন ফান্ডগুলো বাংলাদেশের জন্য ঋণের বিকল্প হিসেবে অনুসন্ধান করা যেতে পারে। গ্রিন ফান্ড উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অর্থায়ন কার্যক্রমের জন্য বিশেষভাবে কার্যকর হতে পারে যা গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে সাধারণত এ জাতীয় তহবিলগুলো ছাড়ের প্রক্রিয়া দীর্ঘসূত্রতার দোষে দুষ্ট। স্মার্ট গ্রিড স্মার্ট গিভ হচ্ছে বিদ্যুৎ বিতরণের সর্বাধুনিক ডিজিটাল পদ্ধতি যা তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে শিল্প কারণানা থেকে শুরু করে ঘর পর্যন্ত বিদ্যুতের উৎপাদন ও ব্যবহার মনিটর করবে। প্রাপ্ত তথ্যগুলো সঠিকভাবে ব্যবহার করে পুরো বিদ্যুৎ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করবে অর্থাৎ স্মার্ট গ্রিডের মাধ্যমে স্মার্টভাবে কম খরচের ও কম বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে পারন। ত্রুটিপূর্ণ বিদ্যুৎ বিতরণ কারণে উৎপাদিত বিদ্যুৎ কী পরিমাণে নষ্ট হচ্ছে সে সমন্ধে সঠিক। ধারণা বর্তমানে পাওয়া যায় না। এমনকি কোথায় আমাদের কতটুকু লোডশেডিং হচ্ছে সে সমক্ষেও শতভাগ তথ্য পাওয়া কঠিন। স্বার্ট তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে বর্তমান সিস্টেম সম্বন্ধে ভালো ধারণা পাওয়া যাবে। আজ থেকে ২০ বা ৫০ বছর পরে দেশের বিদ্যুৎ চাহিদা কোন পর্যায়ে থাকবে আর কীভাবে তা পূরণ করা হবে তা নিয়ে বিদ্যুৎ বিভাগ এখন থেকেই পরিকল্পনা করছে। স্মার্ট হিত প্রযুক্তি সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নের অন্যতম উপায়। বিদ্যুৎ খাতের অর্থীনস্থ সব সংস্থা ও কোম্পানিগুলোকে স্মার্ট গ্রিডের আওতায় নিয়ে আসার জন্য বিদ্যুৎ বিভাগ একটি রোডম্যাপ প্রণয়ান করেছে। এই রোডম্যাপটি বাংলাদেশের পাওয়ার সেক্টরের জন্য স্বল্প, মাঝারি ও দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করতে সাহায্য করবে এবং কীভাবে তারা স্মার্ট চিচের বাস্তবাচনকে প্রভাবিত করবে এবং সম্পদের সর্বোত্তম ব্যবহারের সঙ্গে বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে ইউটিলিটিগুলোকে সক্ষম করে দেশের স্মার্ট গ্রিজগুলোকে একীভূতকরণ শুরু করতে সহায়তা করবে। আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে সমগ্র বিদ্যুৎ সেক্টরটিকে স্মার্ট থ্রিডের আওতায় আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি যা নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎস নিশ্চিত করার মাধ্যমে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনেকৃত সরকারের রের প্রতিশ্রুতির সঙ্গে সাযুজ্য বজায় রাখবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্বে ও দিকনির্দেশনায় যথাসময়ে অর্থাৎ আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে পুরো দেশ স্মার্ট মিাতের আওতায় নিয়ে আসার মাইলফলকে পৌঁছাতে সক্ষম হবে। বিতরণ সক্ষমতা বৃদ্ধি জনগণকে ১০০ ভাগ্য বিদ্যুতায়নের আওতায় নিয়ে আসার পাশাপাশি গ্রাহকসেবা উন্নয়নের জন্য একটি সমন্বিত বিদ্যুৎ বিতরণ কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। সবার জন্য নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিদ্যমান বিতরণ ব্যবস্থায় নতুন লাইনের পরিমাণ বৃদ্ধি এবং আধুনিকায়ন প্রয়োজন। সে লক্ষ্যে সরকার বিভত্তণ ব্যবস্থা আধুনিকায়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়-ওভারহেড সিস্টেমকে ভূগর্ভস্থ সিস্টেমে রূপান্তর, ঝাতা বাস্তবায়ন, স্মার্ট গ্রিড সিস্টেম এবং প্রি-পেইড মিটারিং প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন, লোড সম্পন্ন ট্রান্সফরমার প্রতিস্থাপন বিতরণ মিটারগুলো স্থাপন করার পরে প্রি-পেইড গ্রাহকদের কাছে সংস্থাগুলোর আর কোনো অনাদায়ী বকেয়া নেই। অতিরিক্ত লাইন এবং উপকেন্দ্রগুলোর সংস্কার ও ওভারহোলিং, বিদ্যমান নেটওয়ার্কের বিস্তৃতি ইত্যাদি।
ভূগর্ভস্থ বিতরণ ব্যবস্থা: সরকার দেশের বড় শছরগুলোতে ভূগর্ভস্থ বিতরণ ব্যবস্থা চালু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এর লক্ষ্য হলো শহরগুলোতে আধুনিক ব্যবস্থাসহ বিদ্যুৎ সরবরাহ সুবিধা নিশ্চিত করা। বিশ্বের উন্নত এবং আধুনিক দেশগুলোর ন্যায় সরকারি মালিকানাধীন বিদুৎ বিতরণ সংস্থা ডিপিডিসি, ডেমকো ভূদগর্ভস্থ বিদ্যুৎ বিতরণ ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করছে। প্রি-পেইড মিটারিং সিস্টেম: বিদ্যুতের বিল শতভাগ সপ্তাহের মাধ্যমে সহজে বিল পরিশোধের বিষয়টি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে দেশব্যাপী প্রি- -পেইড মিনেরিং ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। করাত এই এই প্রি-পেইড তদুপরি, প্রি-পেইড মিটার প্রবর্তনের কারণে সিস্টেম
লস উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে এবং গ্রাহকরা বিদ্যুৎ ব্যবহারে সচেতন হওয়াতে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুৎ চাহিদাও অনেকাংশে হ্রাস পেয়েছে। পরিশেষে এটি অবশ্যই বলা যেতে পারে যে, যদিও বিদ্যুৎ খাতে অনেক প্রতিবন্ধকতা রয়েছে তবে সেই প্রতিবন্ধকতাগুলো কাটিয়ে ওঠার জন্য বিঘ্নি উপায় এবং প্রচেষ্টা বিদ্যুৎ বিভাগের রয়েছে। বিদু্যুৎ খাত দেশের অন্য খাতগুলোর জন্য একটি উদাহরণ স্থাপন করে দেখিয়েছে যে, অনেক প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও কীভাবে উন্নতি করা যায়। সুতরাং এ কথা অনষ্টীকার্য যে, সাশ্রয়ী বিদ্যুৎ ব্যবস্থা প্রবর্তনে, স্মার্ট গ্রিড এবং জ্বালানি দক্ষতাকে অগ্রাধিকার দিয়ে একটি সাশ্রয়ী, দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ কর্মসূচির মাধ্যমে বিদ্যুৎ, গাত বাংলাদেশকে টেকসই উন্নয়নে ‘স্মার্ট বাংলাদেশের’ লক্ষ্যে পৌছাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। বিদ্যুৎ খাত জীবাশ্য জ্বালানি আমদানির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতার বিপরীতে বিদ্যুৎ আমদানি বাড়ানোর ওপর জোর দিয়ে জ্বালানি সুরক্ষা সর্বোত্তমভাবে নিশ্চিত করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ খাতের পরিকল্পনাগুলো সফলভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে নির্ভরযোগ্য বিদ্যুৎ সরবরাহ আর কেবল স্বপ্নই হয়ে থাকবে না বরং বাস্তবতায় পরিণত হবে।
লেখক: মহাপরিচালক, পাওয়ার সেল, বিদ্যুৎ বিভাগ। বিজ্ঞান মন্ত্রণালয়।