বঙ্গবন্ধুর মহাকাব্যিক ভাষণে মুক্তির পথ

প্রকাশিতঃ 12:08 pm | March 26, 2024

অধ্যাপক ডা. এ বি এম আব্দুল্লাহ:

বাঙালির দীর্ঘ স্বাধিকার আন্দোলনের চূড়ান্ত লড়াইয়ের সূচনা হয়েছিল সেদিন ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ। ৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মহাকাব্যিক ভাষণ মুক্তির পথ দেখায় বাঙালিকে। একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের রূপরেখা দেখতে পায় বাঙালি জাতি। প্রবল আন্দোলনের স্রোতধারায় ক্রমশ বাঙালির হৃদয়ে আঁকা হয় একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের ছবি। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের সূচনা ঘটে। হাজার বছরের পরাধীনতার শেকল ভেঙে বিশ্বের বুকে স্বাধীন অস্তিত্ব ঘোষণা করে বীর বাঙালি। ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। নির্বিচারে হত্যা করে সাধারণ মানুষকে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বন্দির পূর্ব মুহূর্তে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার মাধ্যমে বাঙালির চূড়ান্ত মুক্তির সংগ্রাম শুরু হয়। নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আত্মসমর্পণে বাধ্য করা হয় পাক হানাদার বাহিনী। ৩০ লাখ শহিদ আর অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি একটি দেশ, একটি মানচিত্র ও একটি পতাকা। এই গর্ব প্রতিটি বাঙালির।

আজকের এই দিনটিতে আমি গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি মহান স্বাধীনতার রূপকার বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। স্মরণ করছি মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গকারী বীর শহিদদের। স্মরণ করছি জাতীয় চার নেতা, বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক থেকে শুরু করে বিদেশি বন্ধু এবং সর্বস্তরের জনগণকে-যারা অধিকার আদায়ে ও মুক্তিসংগ্রামে বিভিন্নভাবে রেখেছেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান।

বঙ্গবন্ধু বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে পরিচিত করেছেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। তিনি স্বাধীনতাপ্রাপ্ত যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশকে পুনর্গঠন করেছেন মাত্র সাড়ে তিন বছরে। তিনি দেশের শিক্ষা, চিকিৎসা, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, ধর্মীয় মূল্যবোধসহ প্রতিটি ক্ষেত্রে একটি সুস্পষ্ট দিক নির্দেশনা দিয়ে গেছেন। বাংলার ইতিহাসে পেয়েছেন চির অমরতা। বাঙালির মানসপটে চির ভাস্বর লোকান্তরিত বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশকে বিশ্ব দরবারে আজ উন্নয়নের রোল মডেলে পরিণত করেছেন তাঁর সুযোগ্য কন্যা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তুলতে সংগ্রাম করে চলেছেন নিরন্তর।

স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বলা হয় রাজনীতির কবি। তিনি শুধু স্বপ্নস্রষ্টা ছিলেন না, ছিলেন স্বপ্নদ্রষ্টা ও ভবিষ্যৎদ্রষ্টা।আজীবন তাঁর স্বপ্ন ছিল বাংলার খেটে খাওয়া, গরিব-দুঃখীসহ সর্বস্তরের মানুষের মুখে হাসি ফোটানো। তিনি এমন একটি স্বাধীন, সার্বভৌম এবং সুখী-সমৃদ্ধশালী সোনার বাংলা গড়তে চেয়েছিলেন, যেখানে বাংলার সর্বস্তরের মানুষের সাংবিধানিক, রাষ্ট্রীয় এবং রাজনৈতিক অধিকার হিসেবে পাঁচটি মৌলিক অধিকার অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা ও চিকিৎসা সুনিশ্চিত করা যাবে। আর এই মৌলিক অধিকারগুলোকে অগ্রাধিকার দিয়ে তিনি তার রাজনৈতিক কর্মসূচি এবং নীতিমালা প্রণয়নে সচেষ্ট হন। পাঁচটি মৌলিক অধিকারের অন্যতম স্বাস্থ্যসেবাকে তিনি বিশেষভাবে গুরুত্বারোপ করেন এবং তা বাস্তবায়নে সুপরিকল্পিতভাবে কর্মযজ্ঞ শুরু করেন।

বঙ্গবন্ধু আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পবিত্র আমানত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান-এর ১০ (ক)-এ চিকিৎসাকে মৌলিক অধিকার এবং ১৮(১)-এ জনগণের পুষ্টি ও জনস্বাস্থ্যকে রাষ্ট্রের কর্তব্য বলে ব্যক্ত করেন। তিনি তার আন্তরিকতা, বিচক্ষণতা এবং দূরদর্শিতা দিয়ে উপলব্ধি করেছিলেন, দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য জনগণের চিকিৎসা এবং চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতি করা অবশ্যই জরুরি।

বঙ্গবন্ধুর স্বাস্থ্যচিন্তা ছিল অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত, যুগোপযোগী, আধুনিক এবং জনকল্যাণমুখী। সত্যি বলতে কি, তারই চিন্তাপ্রসূত নীতিমালা এবং পরিকল্পনায় আজকের বর্তমান স্বাস্থ্য ব্যবস্থার গোড়াপত্তন বা ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল। মাত্র সাড়ে তিন বছরে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের সব ক্ষেত্রে একটি শক্ত নীতিমালা, পরিকল্পনা ও শক্ত অবকাঠামো রেখে গেছেন, যার ওপর নির্ভর করেই গড়ে উঠেছে আজকের বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ভিত্তি।

বঙ্গবন্ধুর স্বাস্থ্যসেবার পরিকল্পনা শুধু রাজধানী বা শহরকেন্দ্রিক ছিল না। বরং জেলা, থানা, ইউনিয়ন এবং গ্রামসহ তৃণমূল পর্যায়ে সেই সুযোগ নিশ্চিত করাই ছিল তার মূল উদ্দেশ্য। দেশের একজন মানুষও যেন চিকিৎসার আওতার বাইরে না থাকে, এমনকি কাউকে যেন অর্থের অভাবে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হতে না হয়-এই ছিল তার দর্শন। আর এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়ে তিনি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেলা হাসপাতাল, মহকুমা হাসপাতাল, থানা হেলথ কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একটি সুবিন্যস্ত স্বাস্থ্য-ব্যবস্থা প্রণয়নের পথ দেখিয়েছিলেন।

পরে তার উত্তরসূরি এবং সুযোগ্যা কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরেই পূর্ণতা পায় এই কমিউনিটি ক্লিনিক ভিত্তিক চিকিৎসাসেবা, যা বর্তমানে প্রান্তিক জনগণের ন্যূনতম প্রাথমিক চিকিৎসার প্রধান আশ্রয়স্থল হিসেবে স্বীকৃত এবং ব্যাপকভাবে প্রশংসিত। আজ বিশ্বের দরবারে এই কমিউনিটি ক্লিনিক ব্যবস্থা একটি রোল মডেল। জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলো কমিউনিটি ক্লিনিক প্রতিষ্ঠায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফল উদ্ভাবনী উদ্যোগের ব্যাপক স্বীকৃতি দিয়ে এই উদ্যোগকে ‘দ্য শেখ হাসিনা ইনিশিয়েটিভ’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের অদম্য উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় এই স্বীকৃতি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের ভাবমূর্তি আরও উজ্জ্বল করেছে।

জাতির পিতার স্বাস্থ্য ভাবনার মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল জনগণের সার্বিক কল্যাণ। তিনি চেয়েছিলেন প্রচুর ডাক্তার হবে, ডাক্তাররা মর্যাদাবান হবে, তাদের উচ্চশিক্ষা নিশ্চিত হবে, আর এই ডাক্তাররাই সর্বস্তরের জনগণকে সেবা দেবে। রাষ্ট্র সব নাগরিকের জন্য সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করবে, আর এজন্যই তিনি এক সুবিন্যস্ত বাস্তবভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা এঁকেছিলেন।

শুধু তাই নয়, রোগের চিকিৎসা এবং প্রতিরোধের ব্যবস্থা, চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও উন্নয়নকল্পে গবেষণা, এমনকি ওষুধ নীতি-সবমিলিয়ে কী ছিল না তার পরিকল্পনা ও কর্মযজ্ঞে! প্রায় ৫৩ বছর আগে তিনি যে রূপরেখা দিয়ে গিয়েছিলেন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে, আজও সেগুলোর বাস্তবায়নের চেষ্টা চলছে। জনগণ যতটুকু স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছেন, তা তারই কর্মপরিকল্পনা এবং কর্মের ধারাবাহিক ফসল বলা চলে। বঙ্গবন্ধু যদি বেঁচে থাকতেন তাহলে হয়তো আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আরও আগেই অনেক দূর এগিয়ে যেত। দেশ স্বাধীনের পর তিনি সময় পেয়েছিলেন মাত্র সাড়ে তিন বছর। এত স্বল্প সময়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধু তার স্বপ্নের স্বাস্থ্যখাতকে পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত করে যেতে পারেননি।

জাতির পিতা দেশকে নিয়ে যে চিন্তা করতেন, তারই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সম্পাদনে আত্মনিয়োগ করে জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে নিরলসভাবে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন

বঙ্গবন্ধুর আজন্ম স্বপ্নের স্বাস্থ্যসেবার সফল এবং স্বার্থকভাবে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তার সুযোগ্য উত্তরসূরি জননেত্রী শেখ হাসিনার নেওয়া বাস্তবভিত্তিক ও ব্যাপক কার্যক্রম দেশের জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করবে এবং আগামীতে একটি পূর্ণাঙ্গ, সুপরিকল্পিত ও সুদূরপ্রসারী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হবে, এই হোক আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক : মেডিসিন বিশেষজ্ঞ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক।