বুয়েটে জঙ্গিবাদের পদধ্বনি

প্রকাশিতঃ 11:16 pm | March 31, 2024

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:

উত্তপ্ত হয়ে ওঠেছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)। ছাত্র রাজনীতিবিহীন ক্যাম্পাসের পক্ষে ধারাবাহিক আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। তবে এ আন্দোলনের মধ্যেই কার্যত জঙ্গিবাদের পদধ্বনি লক্ষ্য করা যাচ্ছে বলে অভিযোগ ওঠেছে। স্বয়ং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার নামে বুয়েটকে জঙ্গিবাদ, অপরাজনীতির কারখানায় পরিণত করা হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হবে। সেই রকম হলে সরকারকে অ্যাকশনে যেতে হবে।’ রাষ্ট্রের সংবিধান ও প্রচলিত আইনের দ্বারা বুয়েট পরিচালিত হতে হবে এটিই নিয়ম। কিন্তু তা না করে আইনের কোথাও ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা বুয়েটকে প্রদান করা না হলেও বুয়েট প্রশাসন বেআইনি ও অসাংবিধানিকভাবে সেটি বাস্তবায়ন করছে। এ ঘটনায় ক্ষোভে ফুঁসে ওঠেছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।

রোববার (৩১ মার্চ) দুপুরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাদদেশে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে তাঁরা। সমাবেশে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন অভিযোগ করে বলেছেন, ‘বুয়েট ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ—হিযবুত তাহরীর, জেএমবি ও ছাত্র শিবিরের প্রশিক্ষিত ক্যাডাররা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। দেয়ালে পোস্টার লাগাচ্ছে, শিক্ষার্থীদের ইমেইলে দাওয়াত দিচ্ছে, টাঙ্গুয়ার হাওরে শিবির দেশ বিরোধী মিটিং করছে। তাই বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত একটি নাটক। এই নাটক বন্ধ করতে হবে। বুয়েটে নিয়মতান্ত্রিক ছাত্ররাজনীতি চালু করতে হবে।’ এদিকে, মধ্যরাতে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ নেতাদের প্রবেশের প্রতিবাদ করে ছয় দফা দাবিতে আন্দোলন করেছে বুয়েট শিক্ষার্থীরা। ৩১ মার্চ রবিবার সকাল ৭টায় অবস্থান নেওয়ার ঘোষণা দিলেও অনুপস্থিত ছিল তারা। পরে বিকেলে সংবাদ সম্মেলনে তারা জানায়, নিরাপত্তার শঙ্কা থাকায় অবস্থান নেননি আন্দোলনকারীরা।

বিভিন্ন সূত্র মনে করে, মূলত এসব ঘটনার নেপথ্যে ধর্মান্ধ মৌলবাদীদের এক ভয়ানক নীল নকশা রয়েছে। গত কয়েক বছর যাবত বুয়েট বাংলাদেশে একটি স্পর্শকাতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উপর নিয়ন্ত্রণ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয় এমনকি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নেই। বুয়েটে যে ছাত্রলীগ বিরোধী আন্দোলন-অভিযান ইত্যাদি সবকিছুর আড়ালে রয়েছে মৌলবাদী একটি গোষ্ঠীর নিবিড় তৎপরতা। সেখানে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার পেছনে পরিকল্পিত মৌলবাদী প্রচেষ্টা মূলত জঙ্গিবাদের পদধ্বনি।

বুয়েটকে অপরাজনীতির কারখানা করা হচ্ছে কি না খতিয়ে দেখা হচ্ছে
রোববার (৩১ মার্চ) সকালে তেজগাঁও ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে দলটির চট্টগ্রাম বিভাগীয় নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনা সব অপকর্ম, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো ট্রলারেন্স। সেই নীতিতে আমরা এগিয়ে চলছি। বুয়েটে আবরার হত্যাকাণ্ডে আমরা ছাড় দেইনি। আজকে আমি রাজনীতি করি, কিন্তু বুয়েটে যেতে পারবো না? এটা কোন ধরনের আইন? এটা কোন ধরনের নীতি? ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার নামে বুয়েটকে জঙ্গিবাদ, অপরাজনীতির কারখানায় পরিণত করা হচ্ছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হবে।’

বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি ‘নিষিদ্ধের নাটক’ বন্ধের দাবি ছাত্রলীগের
বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অসাংবিধানিক, মৌলিক অধিকার পরিপন্থি ও শিক্ষা বিরোধী সিদ্ধান্ত বলে আখ্যা দিয়ে রোববার (৩১ মার্চ) দুপুরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাদদেশে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ। প্রতিবাদ সমাবেশে ছাত্রলীগ সভাপতি সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘ইমতিয়াজ রাব্বি যদি একা স্বাধীনতার স্বপক্ষে লড়াই করে আমরা তার পক্ষে লড়াই করবো। সংবিধান সমাবেশের স্বাধীনতা, সংগঠন করা স্বাধীনতা দিয়েছে। যারা সংবিধান বিরোধী সিদ্ধান্ত দিয়েছে তাদেরকে শিক্ষা দেওয়ার জন্যই আজকে আমরা শহীদ মিনারে হাজির হয়েছি। আমরা দাবি জানাই, বুয়েটসহ প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিতে হবে। ইমতিয়াজ রাব্বির হলের সিট ফিরিয়ে দিয়ে তাকে সসম্মানে বরণ করে নিতে হবে।’

সাদ্দাম হোসেন বলেন, আমরা নাকি বুয়েটে অনুপ্রবেশ করেছি। অনুপ্রবেশের রাজনীতি ছাত্রলীগ করে না। আমরা প্রবেশ করি এবং পরিবর্তন করি। একজন নাগরিক হিসেবে শুধু বুয়েট কেন সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যাওয়ার অধিকার আমাদের রয়েছে। আমি বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতেও অনেকবার বুয়েটে গিয়েছি। বুয়েটে যেতে হলে কাদের কাছে অনুমতি নেব আমরা? যারা ২১ ফেব্রুয়ারি, ২৬ মার্চের বিরোধিতা করে তাদের কাছে?

তিনি আরও বলেন, আমরা জানি ছাত্ররাজনীতিতে নেগেটিভ এলিমেন্ট রয়েছে। তবে এটাকে সংস্কার করতে হবে আরও ভালো ছাত্ররাজনীতি দিয়ে। ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের নামে সংবিধান অবমাননা হচ্ছে। যাচ্ছেতাই ক্যাম্পাস কালচার তৈরি ও ক্যাম্পাসে অন্ধকার রাজনীতি চর্চার সুযোগ করা হচ্ছে। আমরা চাই বুয়েটের শিক্ষার্থীরা স্মার্ট ছাত্ররাজনীতি উপহার দেবে। আপনারা আসুন, ছাত্ররাজনীতির স্ট্যান্ডার্ড তৈরি করুন। আমরা ছাত্রলীগ গণতান্ত্রিকভাবে তা অনুসরণ করবো।

প্রতিবাদ সমাবেশে ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক শেখ ওয়ালি আসিফ ইনানের সঞ্চালনায় সভাপতিত্ব করেন সভাপতি সাদ্দাম হোসেন। সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল, ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, সরকারি তিতুমীর কলেজ, বাঙলা কলেজ, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগসহ আশপাশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ইউনিট ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সমবেত হন। এসময় নেতাকর্মীদের ‘মৌলবাদের বিরুদ্ধে, ডাইরেক্ট অ্যাকশন’, ‘শিবিরের বিরুদ্ধে, ডাইরেক্ট অ্যাকশন’, ‘জায়ামাত-শিবির-রাজাকার, তাড়াতাড়ি বাংলা ছাড়’, ‘শিবিরে আস্তানা, ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’ সহ বিভিন্ন ধরনের স্লোগান দিতে দেখা যায়।

সমাবেশে উপস্থিত হন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি মাজহারুল কবির শয়ন, সাধারণ সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ ছাত্রলীগের সভাপতি রাজিবুল ইসলাম (বাপ্পি), সাধারণ সম্পাদক সজল কুন্ডুসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা।

এর আগে ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে সমাবেশের বিষয়ে জানানো হয়, বুয়েট কর্তৃক বিশ্ববিদ্যালয়ের ২১ ব্যাচের পুরকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ হোসেন রাহিম রাব্বির আবাসিক হলের বরাদ্দকৃত সিট বাতিল ঘোষণা করার সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা-গণতন্ত্রকামী মানুষ ও ছাত্রসমাজ চূড়ান্তভাবে প্রত্যাখ্যান করছে। বাংলাদেশের ছাত্রসমাজ বুয়েট প্রশাসনের সিদ্ধান্তকে একটি অন্যায্য, অসাংবিধানিক, মৌলিক অধিকার পরিপন্থি ও সর্বোচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃক নৈতিক স্খলনজনিত শিক্ষাবিরোধী কর্মকাণ্ড হিসেবে আখ্যায়িত করে এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে।

বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ও এই রাষ্ট্রে সাধারণের শিক্ষার অধিকার একটি গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে, যার নেতৃত্ব দিয়েছে এ দেশের ছাত্রসমাজ। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, সাম্প্রতিককালে সংবিধান সম্মত ছাত্র রাজনীতি নিয়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়টিতে এমন কিছু কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে, আশ্রয়-প্রশ্রয় পাচ্ছে, যা ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের মহান সংবিধানের চূড়ান্ত লঙ্ঘন। আরও বলা হয়, বুয়েট বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে এবং বাংলাদেশের জনগণের অর্থে পরিচালিত একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। তাই সর্বাবস্থায় এই রাষ্ট্রের সংবিধান ও প্রচলিত আইনের দ্বারা এটি পরিচালিত হতে হবে। কিন্তু তা না করে, এই আইনের কোথাও ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা বুয়েটকে প্রদান করা না হলেও বুয়েট প্রশাসন বেআইনি ও অসাংবিধানিকভাবে তা বাস্তবায়ন করছে। মূলধারার প্রকাশ্য ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের এই প্রচেষ্টার মাধ্যমে বুয়েটকে দেশ ও বিশ্ব মানবতাবিরোধী, নিষিদ্ধ, অন্ধকার জগতের বিভিন্ন সংগঠনের কর্মকাণ্ড পরিচালনার তীর্থস্থানে পরিণত করা হয়েছে।

নিরাপত্তার শঙ্কায় আসেনি আন্দোলনকারী
রবিবার (৩১ মার্চ) বিকালে বুয়েটের রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ের সামনে সংবাদ সম্মেলন আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা লিখিত বক্তব্যে বলেন, বুয়েটে ছাত্র রাজনীতিবিহীন ক্যাম্পাসের পক্ষে আন্দোলনরত সব ব্যাচের সব শিক্ষার্থীরা আজ ৩১ মার্চ নিরাপত্তার শঙ্কায় আসেনি। তারা জানান, ক্যাম্পাসের আশপাশের সব এলাকায় গতকাল রাত থেকে ক্রমাগত মাইকিং, শিক্ষার্থীদের ফোন কলে হুমকি-ধমকি প্রদান করা, সোশ্যাল মিডিয়ায় নানারকম গুজব, বুয়েট শিক্ষার্থীদের মিথ্যা ট্যাগ দেওয়া, শিক্ষার্থীদের ছবি নাম পরিচয়সহ পোস্ট করে তাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা গুরুতরভাবে বিঘ্নিত হয়, এমন সব অপপ্রচার চালানো হয়েছে। এমতাবস্থায় বুয়েট ক্যাম্পাস এবং আশপাশের এলাকা বুয়েটের শিক্ষার্থীদের জন্য অনিরাপদ হয়ে পড়েছে। এমনকি বুয়েট ক্যাম্পাসের বাইরেও শিক্ষার্থীরা তাদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিয়ে শঙ্কিত। নিরাপত্তাজনিত এসব কারণে বুয়েট শিক্ষার্থীদের আজ ক্যাম্পাসে অবস্থান না নেওয়ার মানে এই নয় যে বুয়েটের শিক্ষার্থীরা তাদের ছাত্র রাজনীতিবিহীন ক্যাম্পাসের দাবি থেকে সরে এসেছে। এ দাবি বুয়েটের সব ব্যাচের সব শিক্ষার্থীর।

কালের আলো/ডিএস/এমএম