ন্যাশনাল ব্যাংককে গৌরবোজ্জ্বল অবস্থানে ফেরানোর চ্যালেঞ্জিং মিশনে খলিলুর রহমান

প্রকাশিতঃ 11:28 pm | May 12, 2024

কালের আলো রিপোর্ট :

দেশের দুর্বল ব্যাংকগুলোর একটি ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড। ব্যাংকটিকে বেসরকারি খাতের ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) সঙ্গে একীভূত করার পরামর্শ দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে ন্যাশনাল ব্যাংক তাতে সায় দেয়নি। নিজেরাই নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে চেয়েছে। আগের পরিচালনা পর্ষদ সভায় এমন সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সেই মোতাবেক ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ৪১ বছর আগে বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের ফার্স্ট জেনারেশনের এ ব্যাংকটি যাত্রা শুরু করেছিল যাদের হাত ধরে তাদেরই একজন উদ্যোক্তা পরিচালককে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হিসেবে। বীর চট্টলার সন্তান, দেশের স্বনামধন্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান কেডিএস গ্রুপের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব খলিলুর রহমান হয়েছেন ব্যাংকটির নতুন চেয়ারম্যান। দায়িত্ব নিয়েই ব্যাংকটিকে আগের গৌরবোজ্জ্বল জায়গায় পৌঁছে দিতে দৃঢ় অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় এ শিল্পপতি।

দীর্ঘদিন ব্যাংকটির সঙ্গে মায়ার বাঁধনে খলিলুর রহমান জানেন কীভাবে ব্যাংকটি শুরু থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত টানা ২৯ বছর এক নম্বর কাতারে ছিল, লাভের মুখ দেখেছিল। সমস্যা কোথায়, সম্ভাবনাই বা কতটুকু! সব সমস্যা চিহ্নিত করে সঠিক দাওয়াই খাদের কিনারায় থাকা ব্যাংকটিকে ঘুরে দাঁড় করানো সম্ভব বলে আশাবাদী অভিজ্ঞ এ শিল্পোদ্যোক্তা। এই প্রতিবেদকের সাথে আলাপেও আশাবাদী উচ্চারণ তার। তাঁর ভাষ্যে-‘ন্যাশনাল ব্যাংক জনগণের ব্যাংক। ১৯৮৩ সালে আমরা এই ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছি। ব্যবসায়ী হিসেবে আমরা জানি ব্যাংককে কীভাবে লাভজনক করতে হয়। আমি জানি, ব্যাংকের কোথায় কী আছে, কী কী সমস্যা আছে, কারণগুলো আমাদের জানা। এই ব্যাংক ২০১২ সাল পর্যন্ত এক নম্বর কাতারে ছিল। বাংলাদেশের বেসরকারি খাতের ফার্স্ট জেনারেশনের ব্যাংক ন্যাশনাল ব্যাংক। তখন আমাদের যারা পরিচালক ছিলেন সবাই ব্যবসায়ী ছিলেন। তাদের ব্যবসার যথেষ্ট অভিজ্ঞতা ছিল। ওই অভিজ্ঞতা দিয়ে আমরা ব্যাংকটি করেছিলাম। সবার সমন্বিত প্রচেষ্টায় আগামী চার বছরের মধ্যে আবার ন্যাশনাল ব্যাংকের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে পারবো। এটি আমার বিশ্বাস।’

চট্টগ্রাম জেলার ঐতিহ্যবাহী পটিয়ার সাঁইদাইর গ্রামের সন্তান, ৭৯ বছর বয়সী খলিলুর রহমান জীবনের গোধূলী বেলায় নিয়েছেন দেশের প্রয়োজনে গ্রহণ করেছেন কঠিন এক চ্যালেঞ্জ। আজন্ম লড়াকু এই মানুষটি সফল হলে বেঁচে যাবে একটি ব্যাংক, শঙ্কা উবে যাবে অনেকের চাকরি হারানোর। চ্যালেঞ্জিং এ কর্মযজ্ঞ সম্পাদনে তিনি প্রথমেই জোর দিতে চান খেলাপি ঋণ আদায়ে। প্রয়োজনে নিতে চান আইনি সহায়তাও।

এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমি চ্যালেঞ্জ নিয়েছি। বাংলাদেশ ব্যাংক যথেষ্ট সহযোগিতা করেছে। যারা ঋণ নিয়েছেন, তাদের কাছ থেকে আদায় করবই। আমরা খেলাপি ঋণ আদায়ের চেষ্টা করব। প্রকৃত ব্যবসায়ী ঋণ নিলে খেলাপি হতে পারেন না। অ্যাসেসমেন্ট করে ঋণ দেওয়া হয়নি। মনিটরিং করা হয়নি। বড় খেলাপিদের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা ভুল স্বীকার করেছেন, টাকা পরিশোধে ইচ্ছুক। বড় ব্যবসায়ীদের টাকা খেলাপি হবে না। ব্যবসা করে ক্ষতি পুষিয়ে নেব। যারা ব্যবসায়ী না হয়ে ঋণ নিয়েছেন, তারাই সমস্যা। অন্তত ৫০ শতাংশ আদায়ে আমরা আশাবাদী। যারা ঋণ নিয়েছেন দরকার হলে জামানত হিসেবে দেওয়া বাড়ি, জমি বিক্রি করে দেব। দেশে আইন আছে, ব্যাংকের টাকা দিতে না পারলে মামলা করে সম্পদ বিক্রি করে দেওয়া যায়।’

দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী ব্যক্তিত্ব খলিলুর রহমান এক সময় চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (সিএমসিসিআই) সভাপতি, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ কনটেইনার ডিপো অ্যাসোসিয়েশনের (বিআইসিডিএ) ভাইস প্রেসিডেন্ট, বাংলাদেশ সিআর কয়েল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিআরসিএমইএ) চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

পর্যবেক্ষক মহল বলছেন, নতুন চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে দক্ষ পরিচালনা পর্ষদ ও চৌকস ব্যবস্থাপনায় ন্যাশনাল ব্যাংককে ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হবে। তাঁরা দায়িত্বের প্রতি সৎ থেকে ব্যাংকের উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে পারবেন। পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংককে নীতি ও তারল্য সহায়তা দিতে হবে। সরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানও ব্যাংকটি থেকে টাকা তুলে নিয়ে গেছে। এসব টাকা ব্যাংকে ফেরাতে হবে। বড় ঋণ বন্ধ আছে, এটি বহাল রাখতে হবে। এসব সম্ভব হলে ব্যাংকটিকে ভালো করা সহজ হবে। দীর্ঘ ব্যবসায়িক অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ এই মানুষটি এটি করতে পারবেন।

ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব খলিলুর রহমানও পরিশ্রম আর সততার পানসিতে চড়ে পৌঁছতে চান অভীষ্ট লক্ষে। নিজের জবানীতেই বলেছেন, ‘পরিশ্রম, সততা থাকলে, কষ্ট করলে এগিয়ে নিতে পারব। পাওনা উসুল করব। যারা ব্যাংক থেকে টাকা নিয়েছে তাদের বোঝাব, আইন প্রয়োগ করে টাকা ফেরত আনব। ডিপোজিট আনব। ডিপোজিট দিয়ে ব্যবসা করব। একসময় আমরা অনেক বেশি লভ্যাংশ দিয়েছি। ইচ্ছা করলে আমরা উন্নত করে এগিয়ে নিতে পারব। ন্যাশনাল ব্যাংকের হারানো গৌরব আবার ফিরিয়ে আনতে পারব ইনশাআল্লাহ। এটি আমার বিশ্বাস। চার বছরে আমরা একটি ভালো অবস্থানে পৌঁছতে পারব।’

ন্যাশনাল ব্যাংকের নবযাত্রার এ কাণ্ডারি ব্যাংকটিকে কোমর সোজা করে দাঁড় করাতে নিজের পরিকল্পনাও সাজিয়ে ফেলেছেন। সেই কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘যারা প্রকৃত ব্যবসা করেন, দেশে বিনিয়োগ করেন, কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করেন তাদের যথেষ্ট সুযোগ দেব। এটি আমার ব্যাংক কখনো বলি না। আমরা বলি, ন্যাশনাল ব্যাংক জনগণের ব্যাংক, বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের ব্যাংক।’

ব্যাংকটির দুরাবস্থার মধ্যে এককভাবে ব্যবসা পরিচালনার বেশ দু:সাহসই দেখিয়েছেন সদালাপী ও কর্মজীবনে দ্যুতি ছড়ানো কেডিএস গ্রুপের চেয়ারম্যান। উদ্যোক্তা পরিচালক হিসেবেই একীভূত হওয়ার ফর্মুলায় সায় দেননি। নেপথ্যের কারণ জানিয়ে খলিলুর রহমান বলেন, ‘আমরা যখন শুনি ব্যাংকটি একীভূত করার কথা চলছে, তখন আমরা আগের পর্ষদ সভা করে সিদ্ধান্ত দিই। যে ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হতে যাচ্ছে তার চেয়ে আমাদের ব্যাংকের ভিত্তি শক্ত বেশি। আমরা কেন একীভূত হবো? আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করি। আমরা পর্ষদ থেকে সিদ্ধান্ত দিলাম, আমরা একীভূত হতে রাজি নই। আমাদের ব্যাংক আমরা চালাব। দরকার হলে নতুন পর্ষদ গঠন করব। অন্য ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হলে অনেক লোকের চাকরি হারানোর শঙ্কা ছিল। কারণ অনেক জায়গায় দুটি ব্যাংকেরই শাখা রয়েছে। সে বিষয়টিও আমরা ভেবেছি।’

কথোপকথনের ভেতর দিয়ে আবেগের ঢেউ ওঠে বর্ষীয়াণ শিল্পোদ্যোক্তা, ন্যাশনাল ব্যাংকের চেয়ারম্যান খলিলুর রহমানের কন্ঠে। কথার ঝংকার তুলে বর্ণনা করেন ব্যাংকটির গোড়াপত্তনের আদ্যোপান্ত। স্বরগ্রামের ওঠানামায় অন্যরকম উত্তেজনা। ভালোবাসা যেখানে চিরস্থায়ী আর আবেগ যেন সীমাহীন। বাস্তবিক অর্থেই
এ ব্যাংকটির প্রতি তাঁর ভালোবাসাও গভীর। স্মৃতি হাতড়ে বলেন, ‘আমরা যখন চার কোটি টাকায় এ ব্যাংকের উদ্যোগ নিয়েছিলাম তখন বেসরকারি ব্যাংক ছিল না। আমরা ঘরে ঘরে গিয়ে, বন্ধু-বান্ধবকে ধরে ব্যাংকের পরিচালক হিসেবে এনেছি। ব্যাংকের পরিচালক হলে টাকা ফেরত পাবে কি না, তখন চিন্তা করত। আমি বলেছি, তুমি টাকা দাও, টাকা ফেরত না পেলে আমি দিয়ে দেব। এভাবে বলে রাজি করিয়েছি।’

আলাপচারিতায় বলতে থাকেন- ‘ব্যাংক ব্যবসা বুঝতে হবে। ব্যাংক ম্যানেজার ব্যবসা বুঝলে ঋণ দিতে পারেন। যাকে ঋণ দেবেন, তার বিনিয়োগ মনিটর করতে হবে। নিয়মিত পরিশোধ করছে কি না, দেখতে হবে। বড় ঋণ ত্রৈমাসিক, ষাণ্মাসিক, বার্ষিক রিশিডিউল করা হবে। মনিটরিং থাকলে টাকা খেলাপি হয় না। খেলাপির কারণে বিশ্বাস কমে যাচ্ছে সাধারণ মানুষের। প্রকৃত ব্যবসায়ী ব্যাংকের টাকা মেরে খাবেন না। ব্যবসায়ীদের মুখের কথার দাম আছে।’

তাঁর নেতৃত্বাধীন নতুন পরিচালনা পর্ষদ ব্যাংকটিতে তিন হাজার কোটি টাকার আমানত সংগ্রহের লক্ষ্য নিয়েছে। এই আমানত সংগ্রহের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘কদিন আগেও শেয়ারের দাম সাড়ে চার টাকা ছিল, এখন সাত টাকা হয়ে গেছে। ডিপোজিট দিন দিন বাড়ছে। এর জন্য বন্ধু, ব্যবসায়ীদের কাছে যাব। ডিপোজিট খাটিয়ে আমানতকারীকে লাভ দিতে হবে। আমাদের মালয়েশিয়ায় ১১টি, মালদ্বীপে তিনটি, সিঙ্গাপুরে দুটিসহ বিভিন্ন দেশে শাখা আছে। এসব শাখার মাধ্যমে আমরা বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ করব। আশা করি, চার বছরেই আগের গৌরবোজ্জ্বল জায়গায় নিয়ে যেতে পারবো।’ #

কালের আলো/এমএএএমকে