যে কান্না বরং আনন্দ দিত

প্রকাশিতঃ 1:38 pm | October 05, 2017

সাজেদ অপেক্ষা করছে কেয়ার হাসপাতালে। সুজানাকে নেয়া হয়েছে অপারেশন থিয়েটারে। তবে তার আগে সাজেদকে পূরণ করতে হয়েছে অঙ্গীকারনামা। সজ্ঞানে, স্বেচ্ছায়- রোগীর কোনও ক্ষতি হলে বা কোনও দুর্ঘটনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়। যদিও সাজেদ সজ্ঞানে জানে যে- ক্ষতি তার এক দিক থেকে হয়েই যাচ্ছে। যাই হোক,  সব দায় শুধু অসহায় রোগীদের আর সাধারণ জনগণের। সাজেদের অবস্থা যেন হাত পা বাঁধা মানুষের মত। তার চেহারা কেমন অপরাধীর মতো মনে হচ্ছে, তবে উৎকন্ঠিত নয়। এখানে যে সিকিউরিটি গার্ড দায়িত্ব পালন করছেন-  তিনি চোখ ড্যাবড্যাব করে সাজেদের দিকে তাকিয়ে আছেন। যা তাকে আরও সিটিয়ে দিচ্ছে।

কাকতালীয়ভাবে আজ সাজেদ ও সুজানার তৃতীয় বিবাহবার্ষিকী। নতুন এক জীবনের বেড়ে উঠা, নতুন দাম্পত্য জীবনের আরেকটি মধুর বছরের সূচনা হতে পারতো। কিন্তু বিধাতার বিধান সে আর খন্ডাতে পারেনি। অনেক চেষ্টা করেছিল। চেষ্টার ফল নাকি কখনো বৃথা যায় না। কথাটি সেও বিশ্বাস করে। হয়তোবা এই চেষ্টার ফসল সে ঘরে তুলতে পারবে জীবদ্দশারই কোনো এক সময়।

সুজানার সাথে তার সম্পর্কটা বছরখানেক ধরেই ভালো যাচ্ছিলো না। সুজানার রাত করে বাসায় ফেরা, সংসার বিমুখতা। বাসায় যতটুকু সময়, ডিজিটাল ডিভাইস নিয়ে পড়ে থাকা। সাজেদ আরও স্মার্ট আরও রোমান্টিক হতে অনেক চেষ্টা করেছে। এমনকি খুঁজে বের করতে চেয়েছে- ঐ ছেলের মধ্যে কি এমন আছে যার জন্য সুজানার মনোজগতটাই পরিবর্তন হয়ে গেল। কি সেই মাদক, কি সেই সম্মোহনী প্রভাবক যা সুজানাকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করেছে। বেহায়া, ব্যক্তিত্বহীন পুরুষের কাজ হলেও সে তা করেছে। কারণ, যেকোনো মূল্যে সে সুজানাকেই চেয়েছিল। কিন্তু তার এই আপাত নির্লজ্জতা হয়তো সুজানাকে আরও নির্লজ্জ হতে উৎসাহিত করেছে। এখন তাদের সম্পর্কে আর কোনো রাখঢাক নেই। সুজানা প্রকাশ্যেই তার প্রেমলীলা চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি যখন তারা বেডরুমে অবস্থান করে। সাজেদ পরাজিত সৈনিকের মত সবকিছু দেখেও না দেখার ভান করে, শুনেও না শোনার ভান করে। কারণ পরিস্থিতি আর তার নিয়ন্ত্রণে নেই।

সুজানার জীবনের নতুন মানুষ শাফায়াত। সে রাজরানিসহ রাজত্ব জয় করেছে। রানি মহোদয়াও চায় নতুন রাজার অধীন হতে। যেখানে আছে নতুন রোমাঞ্চ, যে কিনা যুদ্ধের মাধ্যমে রানিকে জয় করেছে। না, সাজেদ কোনো যুদ্ধজয়ের মাধ্যমে সুজানার আধিকারিক হয়নি। তাদের বিয়েটা হয়েছিল পারিবারিকভাবে। খুব সুন্দরভাবে, সুখে শান্তিতে কেটে যাচ্ছিল তাদের দাম্পত্য জীবন। সাজেদ ভালো বেতনে ভালো কোম্পানিতে চাকরি করে। সুজানার বাসায় সময় কাটে না। সাজেদও পারছিল না চাকরিটা আরেকটু কনসিডার করে সুজানাকে কিছুটা সময় বেশি দেবার। সুজানাই তার চাকরিটা জুটিয়ে নেয়। সাজেদও মানা করেনি। কারণ সে অনেক উদার ও আধুনিক মনস্কা। আর সে কখনও মানা করেনি সুজানার কোনও সিদ্ধান্তে, কোনও ইচ্ছা পূরণে। ত্যাগ স্বীকার করে হলেও সুজানাকে সর্বদা খুশি রাখতে চেয়েছে। শাফায়াত সে কোম্পানিতেই চাকরি করে। সাজেদের সে সম্মতিই বোধহয় কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আসলে এই দুর্বল মুহূর্তে সাজেদ সুজানার এই পরিবর্তনের জন্য সম্ভাব্য সকল কারণ বিশ্লেষণ করে আফসোস করে, পূর্বের ঘটনাগুলোকে শুধরে দিতে চায়, সেই ভুলের অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে। কিন্তু সাজেদ বাস্তবতা জানে না। হতে পারে এই দুর্বল মুহূর্তে মানতে চায় না। জীবন তার আপন গতিতেই বহমান। মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ মাত্র। বড় বড় ঢেউয়ের সূচনা নদীর যেকোনো দিক থেকেই হতে পারে। ঢেউগুলো নৌকার এপাশেও আঘাত করতে পারে আবার বিপরীত পাশেও।

সুজানাকে অপারেশন থিয়েটার থেকে বের করা হয়েছে। হুইলচেয়ার ঠেলে আনছে হাসপাতালের এক কর্মী। সুজানার মুখটা মলিন। ধকল গিয়েছে, চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে। তবে তা মানসিক না শারীরিক। সাজেদ সুজানার কাছে এগিয়ে যেতে যেতে ভাবে দৃশ্যটাতো ভিন্নও হতে পারতো। সুজানা একা নয়, যদি তার সাথে বের হতো এক মানবশিশু। যার প্রথম কান্না বরং সবাইকে আনন্দ দিত। হ্যাঁ তাইতো- কান্না সেটিও মানুষকে আনন্দ দিতে পারে। স্বর্গীয় আনন্দ। কি অদ্ভুত কথা! স্বাভাবিকতার পুরোই বিপরীত। এভাবে তো সে কখনও ভেবে দেখেনি। সাজেদের চোখ ভিজে উঠে।

‘কেমন লাগছে, সুজানা!’

‘বুঝতে পারছি না।’

‘চলো, তাড়াতাড়ি বাসায় যাই।’

অপেক্ষমান ট্যাক্সিক্যাবে সাজেদ সুজানাকে খুব সাবধানে ধরে উঠায়। সুজানার মোবাইলে একের পর এক কল আসছে। যে ফোনকলটি সাজেদের কষ্ট আরও বাড়িয়ে দেয়।

 

ট্যাক্সিক্যাবে সাজেদ আলতো করে গভীর মমতায় সুজানার হাতটা টেনে নেয়। তার চোখের দিকে তাকায়। না, সে চোখে তার জন্য লিখিত কোনো আবেগীয় ভাষা সে খুঁজে পায়নি। যেমনটা পায়নি- সে রাতে। সাজেদ ভেবেছিল সুজানাকে আটকানোর শেষ একটা চেষ্টা করে দেখবে। সেদিন রাতে বলা যায় অনেকটা জোর করেই তার সাথে মিলিত হয়েছিল। সুজানা হয়তো তার চোখের দিকে ইচ্ছে করেই তাকায়নি। তাহলে দেখতে পেত কতটা দুঃখ ভারাক্রান্ত আকুতিময় ভালোবাসা ছিল সেই চোখে। এই ভালোবাসার জন্যই সাজেদ ভুলতে চেষ্টা করে- এটা বিয়ের প্রথম রাতের মত নয়- যাকে সে এখন স্পর্শ করছে, অনুরূপভাবেই কেউ সুজানাকে তারই সম্মতিতে স্পর্শ  করেছে। যেদিন সুজানার শারীরিক পরিবর্তন ধরা পড়ে- সে সাজেদের সাথে অনেক রাগ করেছিল। তাকে অশ্রাব্য ভাষায় গালমন্দ করেছিল। ততদিনে মাতৃজঠরে আশ্রয় নেয়া জীবনটির মাসখানেক হয়ে গেছে। বাচ্চাটা নষ্ট করার জন্য সুজানা নিজেই উদ্যোগী হয়, দৌঁড়ঝাপ শুরু করে। হয়তো তার সাথে ছিল শাফায়াত। আর আজকে শাফায়াত তো আর আসতে পারে না। আর এতটুকু চক্ষুলজ্জা সুজানার নিশ্চয়ই অবশিষ্ট ছিল।

সাজেদ ও সুজানার ডিভোর্স হয়েছে আজ প্রায় তিনমাস হল। সাজেদ এতদিনে অনেকটা ধাতস্থ হয়ে উঠেছে। মাঝে মাঝে বুকের ভেতর যে চিনচিন ব্যথা করতো সেটা অনেক কমেছে। মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে গেলে সারা বাড়ি কাকে যেন খুঁজতো। সেটাও এখন আর হয় না। দু দুটো জীবন, দু দুটো মানুষ হারানোর ব্যথা সে মাত্র তিনমাসেই লাঘব করতে পেরেছে। এজন্য সে বিধাতাকে ধন্যবাদ জানায়।

তারও তিন বছর পরে। সাজেদ ঘটনাক্রমে এসেছিল কেয়ার হাসপাতালে- স্কিনের ডাক্তার দেখাতে। অপেক্ষমান সাজেদের চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়- যখন দেখে সুজানা শাফায়াতকে নিয়ে এক গাইনী বিশেষজ্ঞের কক্ষ থেকে বের হচ্ছে। সুজানার চোখে পানি। কৌতূহল সংবরণ করতে না পেরে অ্যাটেনডেন্টকে জিজ্ঞেস করে- কি হয়েছে উনার! মা হবার সক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে- অ্যাটেনডেন্টের নির্লিপ্ত উত্তর। কিন্তু যার জীবনে এটি ঘটেছে, সে বুঝতে পারছে- মূল্যবান কি সে হারিয়েছে! সাজেদের নিজেরও খারাপ লাগছে। এই হাসপাতালেই আজ সুজানার চোখে পানি কিন্তু সেদিন ছিল সাজেদের। জীবন সত্যিই অদ্ভুত। প্রতিটি ঘটনাই সে মনে রাখে। তার নাট্যরূপ দিতে চেষ্টা করে। স্রোতকে কখনোই একমুখে পরিচালিত করেনা। সুজানার কি সেদিনের কথা মনে পড়ছে?