ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ডাবের খোসা-চিপসের প্যাকেট কেনার ডিএনসিসি’র নতুন কনসেপ্টে মিলেছে সাড়া
প্রকাশিতঃ 2:10 pm | May 23, 2024
বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:
প্রতি বছরই বর্ষা মৌসুমে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে মশার উপদ্রব। সবার মনে ভর করে ডেঙ্গু আতঙ্ক। গত বছর মশার উৎপত্তিস্থল খুঁজতে আধুনিক প্রযুক্তির ড্রোন ব্যবহার করেছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। এবার নতুন পরিকল্পনা সাজিয়ে এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংসে জোর দিয়েছে তাঁরা। নগরীজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা চিপসের প্যাকেট, পরিত্যক্ত পলিথিন, আইসক্রিমের কাপ, ডাবের খোসা, অব্যবহৃত টায়ার, কমোড ও অন্যান্য পরিত্যক্ত দ্রব্যাদি সাধারণ মানুষের কাছ থেকে কিনে নেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সংস্থাটি। এ উদ্যোগ সফল হলে ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলা করার পাশাপাশি পরিবেশ বিপর্যয়ও কমে আসবে।
এই বছরের সোমবার (৬ মে) রাজধানীর কুড়িল প্রগতি সরণিতে ডেঙ্গু প্রতিরোধে সচেতনতামূলক কার্যক্রম ও মশক নিধন অভিযান শেষে সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে হ্যান্ডমাইক হাতে হাঁকডাক দিয়ে বস্তা ভরে চিপসের প্যাকেট ও ডাবের খোসাসহ অন্যান্য পরিত্যক্ত দ্রব্যাদি কিনতে দেখা যায় ডিএনসিসি মেয়র মো.আতিকুল ইসলামকে। ওইদিন সকালে প্রথমে ৪০০ পিস পরিত্যক্ত চিপসের প্যাকেট নগদ ৪০০ টাকায় কিনেন তিনি। পরে আরও কয়েক বস্তা চিপসের প্যাকেট ও টায়ার নগদ টাকায় কিনে নেন।
জানতে চাইলে ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, ‘ডেঙ্গু প্রতিরোধে আমরা এ কার্যক্রম হাতে নিয়েছি। সবাই যেন সচেতন হন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের। কারণ, সবাই সচেতন না হলে সিটি করপোরেশনের একার পক্ষে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এসব পরিত্যক্ত টায়ার, দইয়ের পাত্র, ডাবের খোসা, চিপসের প্যাকেটে জমে থাকা স্বচ্ছ পানিতে এডিস মশা জন্মায়। আর এসবে যেন পানি জমে না থাকতে পারে, সে কারণে আমরা এসব কিনে নেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছি। আশা করছি এর মাধ্যমে সাধারণ মানুষ সচেতন হবেন। ডিএনসিসির প্রতিটি কাউন্সিলরের কার্যালয়ে গিয়ে এসব জমা দিয়ে নগদ অর্থ নিতে পারবেন যে কেউ।’
জানা যায়, চিপসের প্যাকেট বা সমজাতীয় প্যাকেট প্রতি ১০০টির জন্য ১০০ টাকা করে মূল্য দিচ্ছে ডিএনসিসি। একইভাবে আইসক্রিমের কাপ, ডিসপোজেবল গ্লাস, কাপ ১০০টি ১০০ টাকা; অব্যবহৃত পলিথিন প্রতি কেজি ৫০ টাকা; প্রতি ডাবের খোসা ২ টাকা; মাটি, প্লাস্টিক, মেলামাইন, সিরামিক ইত্যাদির পাত্র প্রতিটির জন্য ৩ টাকা করে দেবে তাঁরা। এছাড়া পরিত্যক্ত টায়ার প্রতিটি ৫০টাকা; পরিত্যক্ত কমোড, বেসিন ইত্যাদি প্রতিটির জন্য ১০০ টাকা, পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের দ্রব্যাদি প্রতি কেজি ১০ টাকায় কিনে নিচ্ছে সংস্থাটি।
ডিএনসিসি সূত্র জানায়, গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে ডিএনসিসি’র বাজেটে মশা নিয়ন্ত্রণে ১১১ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছিল। সংশোধিত বাজেট অনুযায়ী এ খাতে ব্যয় হয় ৭৪ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। গত অর্থবছরের তুলনায় এবারের বরাদ্দ প্রায় দেড়গুণ। এবারের বাজেটে মশা নিধন কাজ পরিচালনার জন্য ৮৪ কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এর মধ্যে মশার ওষুধ কিনতে ব্যয় হবে ৪৫ কোটি টাকা। ৩০ কোটি টাকা ব্যয় হবে মশককর্মীদের দিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনায়। এছাড়া মশা নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। ৭ কোটি ৩৪ লাখ টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে ডেঙ্গু মোকাবিলা, পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম ও প্রচারণায়। সব মিলিয়ে ১২১ কোটি ৮৪ লাখ টাকা।
ডেঙ্গু মোকাবিলায় পরিত্যক্ত দ্রব্যাদি কিনতে ডিএনসিসি মেয়রের নতুন এ কনসেপ্টে ইতিবাচক সাড়া পড়েছে। গতি এসেছে চলমান এ কর্মসূচিতে। পর্যায়ক্রমে সিটি করপোরেশনের ৫৪টি ওয়ার্ডেই একযোগে এসব পরিত্যক্ত পণ্য কিনে নেওয়া হচ্ছে। দ্রুত সময়ে অর্থছাড় শুরু হয়েছে। আঞ্চলিক কার্যালয়ের মাধ্যমে অর্থ কাউন্সিলরদের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষ মনে করছে, নগরীর আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা পলিথিন, চিপসের প্যাকেট, আইসক্রিমের কাপের মতো পরিত্যক্ত দ্রব্যাদি সংগ্রহ করে ধ্বংস করা গেলে ডেঙ্গুর প্রকোপ অনেকটাই কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। প্রতিটি ওয়ার্ডে কাউন্সিলরের কার্যালয়ে গিয়ে যে কেউ এসব পরিত্যক্ত দ্রব্যাদি জমা দিয়ে নগদ অর্থ সংগ্রহ করতে পারছেন অনায়েসেই। প্রতিটি ওয়ার্ডের ক্রয় করা পরিত্যক্ত দ্রব্যাদি প্রতিদিন নিয়মিতভাবে সংগ্রহ করে পরিচ্ছন্নতাকর্মীরা নিকটবর্তী সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশনে (এসটিএস) অপসারণ করছেন। জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করে প্রতিটি ওয়ার্ডকে পরিচ্ছন্ন করার লক্ষ্যে এ নতুন কনসেপ্ট কার্যকর হবে বলে মনে করছেন অনেকেই।
নগরীর পল্লবী, কাজীপাড়া, কুড়িল প্রগতি সরণিসহ বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, ডেঙ্গু মোকাবিলায় ডিএনসিসি চিপসের প্যাকেট, ডাবের খোসা, টায়ার জাতীয় পরিত্যক্ত পণ্য কিনে নিচ্ছে। অনেকেই এগুলো সংগ্রহ করে কাউন্সিলরদের কাছে পৌঁছে দিচ্ছেন। মেয়রের নতুন এ প্রয়াস প্রশংসার দাবি রাখে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের এক অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ মনে করেন, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ করে মশা নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতিকে ঢেলে সাজানো সময়ের দাবি। এজন্য প্রয়োজন দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা। সেজন্য মশার হটস্পট ম্যানেজমেন্টের পাশাপাশি প্রজননস্থল ধ্বংস করার কার্যক্রম নিতে হবে। ডিএনসিসি’র চলমান উদ্যোগে জনগণ সাড়া দিলে কিছুটা ভালো ফল মিলবে।
প্রথমবারের মতো মশক নিধন কর্মীদের প্রশিক্ষণ ও মশার ফাঁদ
অতীতে কোন সময় ডিএনসিসির মশক নিধন কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। এবারই প্রথমবারের মতো তাদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হচ্ছে। আগামী রোববার থেকে নগর ভবনে এ প্রশিক্ষণ শুরু হবে। দেশের নামি কীটতত্ত্ববিদদের পাশাপাশি ইউনাইটেড স্টেটস অ্যাগ্রিকালচার ডিপার্টমেন্টের স্বনামধন্য কীটতত্ত্ববিদদের একটি টিম তাদের প্রশিক্ষণ দেবেন।
একই সূত্র জানায়, দেশে প্রথমবারের মতো মশার ট্র্যাপ বা ফাঁদ বসানোর কর্মযজ্ঞ শুরু করেছে ডিএনসিসি। সপ্তাহে একদিন মশা সংগ্রহ করে মশার ঘনত্ব ও প্রজাতি দেখছে তাঁরা। এর মাধ্যমে কোন এলাকায় মশা নিধনে কেমন জোর দিতে হবে এ বিষয়টি সহজেই বুঝা যাচ্ছে।
ডিএনসিসির স্বাস্থ্য বিভাগ জানায়, ১৯৬.২২ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের ডিএনসিসিতে প্রায় ৬০ লাখ মানুষের বসবাস। এ বিশাল এলাকার জন্য জনবল-যন্ত্রপাতি নেহায়েত কম। তবুও মশক নিধন কাজে নিয়োজিত বর্তমান জনবলের মধ্যে মোট মশক নিধনকর্মী এক হাজার ১৩০ জন (ডিএনসিসি ২৫০ জন), সুপারভাইজার ৬০ জন, মশক নিধন কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতির মধ্যে ফগার মেশিন ৭৬০টি, হস্তচালিত মেশিন ৮৫০টি, হুইল ব্যারো মেশিন ৬২টি, মিস্টব্লোয়ার মেশিন ৪০টি, ভেহিকেল মাউন্টেড ফগার মেশিন ১৫টি এবং নৌকা রয়েছে ৩০টি। মশক নিধনে ডিএনসিসির জনবল-যন্ত্রপাতিতে ঘাটতি থাকলেও কাজে কোন বিঘ্ন ঘটছে না বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
জানতে চাইলে প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী দৈনিক সন্ধানী বার্তাকে বলেন, ‘ডেঙ্গু পাবলিক হেলথ প্রবলেম। এ সমস্যা সমাধানে জনগণের উদ্যোগ বাড়াতে মাননীয় ডিএনসিসি মেয়রের এ উদ্যোগ সময়োপযোগী। এ উদ্যোগে বেশ সাড়া পড়েছে। ইতোমধ্যে আমরা ৫৪টি ওয়ার্ডে প্রায় ২৫ লক্ষ টাকা অর্থ বরাদ্দ দিয়েছি।’
সামগ্রিক বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম দৈনিক সন্ধানী বার্তাকে বলেন, ‘ডেঙ্গু মোকাবিলায় আমাদের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। আমরা আমাদের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছি। ডেঙ্গু রোগীর তালিকা অনুযায়ী তাদের ঠিকানা সংগ্রহ করে রোগীর বাড়িসহ আশেপাশের এলাকায় ব্যাপকভাবে সচেতনতা কার্যক্রম চালাতে আমি কাউন্সিলরদের নির্দেশনা দিয়েছি। সবাইকে নিয়ে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে করণীয় সম্পর্কে মতবিনিময় সভা করতে হবে। সচেতনতামূলক র্যালি করতে হবে। এজন্য প্রত্যেক কাউন্সিলরকে ৫০ হাজার টাকা করে দেওয়া হচ্ছে। সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে ওষুধ প্রয়োগ, পরিচ্ছন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করার পাশাপাশি জনগণের সচেতনতা জরুরি।’
কালের আলো/আরআই/এমকে