মানবাধিকার সুরক্ষায় বিশ্বময় দৃষ্টান্ত বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীরা
প্রকাশিতঃ 11:31 pm | May 28, 2024
মো: শামসুল আলম খান, ফাউন্ডার এডিটর:
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের ৩০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছিলেন, মানবাধিকার সুরক্ষার পাশাপাশি গোলযোগপূর্ণ অঞ্চলে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের সেনাদের ভূমিকা আমাকে মুগ্ধ করেছে।’ চরম পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সদস্যরা মানবাধিকার লঙ্ঘন করেন না বলে বছর দুয়েক আগে একটি অনুষ্ঠানে দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এসএম শফিউদ্দিন আহমেদ।
তিনি সেদিন জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা রাখা বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের বিপুল আত্মত্যাগের কথা জানিয়ে বলেন, ‘বিশ্বের অনেক দেশের সৈন্যরা হামলার শিকার হলে অনেক ক্ষেত্রেই তারা নির্মম আচরণ করেন। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, কিছু কিছু দেশে নৃশংসভাবে গুলি চালানো হয়। তাতে অনেক বেসামরিক মানুষ মারা যায়। তারা মানবাধিকারকে তোয়াক্কা করেন না। কিন্তু বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর সদস্যরা এ ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। তারা দেশ-বিদেশে যেখানেই দায়িত্ব পালন করেছেন, সুনাম কুড়িয়েছে। অতীতের রেকর্ড পর্যালোচনা করলে মানবাধিকার লঙ্ঘনের একটি ঘটনাও পাওয়া যাবে না। দেশের সামরিক বাহিনী নিয়ে আমরা গর্ববোধ করি।’ ‘দেশেও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, জাতি গঠন এবং নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করি আমরা। সেই দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা কার্যকরভাবে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা শান্তি রক্ষা কার্যক্রমে প্রয়োগ করেন। নানা ক্ষেত্রে অবদানের জন্য বিশ্বের কাছে বাংলাদেশের একটি ইতিবাচক ভাবমূর্তি রয়েছে’- যোগ করেন বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ এ শান্তিরক্ষী।
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে ‘ব্লু-হেলমেট’র অধীনে বিশ্বের বিভিন্ন বিরোধপূর্ণ দেশে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ কাজ করে যাচ্ছে সেই ১৯৮৮ সাল থেকেই। বর্তমানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে সর্বোচ্চ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হচ্ছে দেশটি।বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের নারী শান্তিরক্ষীদের অংশগ্রহণও ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। ইতোমধ্যে ৩ হাজার ৫৩১ জন নারী শান্তিরক্ষী সদস্য সাফল্যের সঙ্গে তাদের দায়িত্ব সম্পন্ন করেছেন। নারীর ক্ষমতায়নেও তাঁরা রাখছেন উল্লেখযোগ্য ভূমিকা।
# চরম পরিস্থিতিতেও মানবাধিকার লঙ্ঘনের রেকর্ড নেই
# মানবাধিকার সুরক্ষায় বাংলাদেশের সেনাদের ভূমিকায় মুগ্ধ গুতেরেস
# নিরপেক্ষতা, সততা ও মানবিকতার কারণে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত
# অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রের সক্ষমতা বৃদ্ধিতেও সহযোগিতা করছে বাংলাদেশ
শান্তিরক্ষীদের সীমাহীন আত্মত্যাগকে স্মরণ করে ২০০৩ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবস পালিত হয়ে আসছে। ইউক্রেনের শান্তিরক্ষী সংস্থা এবং ইউক্রেন সরকারের যৌথ প্রস্তাবনায় ২০০২ সালের ১১ ডিসেম্বর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের গৃহীত ৫৭/১২৯ প্রস্তাব অনুযায়ী এ দিবসের রূপরেখা প্রণয়ন করা হয়। ১৯৪৮ সালে সংঘটিত আরব-ইসরাইল যুদ্ধকালীন যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণে গঠিত জাতিসংঘ ট্রুস সুপারভিশন অর্গানাইজেশন (আন্টসো) দিনটিকে উপজীব্য করে ২৯ মে নির্ধারণ করা হয়েছে। জাতিসংঘ ট্রুুপস সুপারভিশন অর্গানাইজেশন (আন্টসো)-ই হচ্ছে প্রথম জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী। এই হিসেবে ১৯৪৮ সাল থেকে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনী ৭৬ বছর পূর্ণ করেছে। এদিনে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী সকল পুরুষ-নারীকে শান্তি রক্ষার লক্ষ্যে সর্বোৎকৃষ্ট পেশাদারি মনোভাব বজায়, কর্তব্যপরায়ণতা, নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তাদের আত্মত্যাগের ঘটনাকে গভীর কৃতজ্ঞতা ও যথোচিত সম্মানপূর্বক স্মরণ করা হয়। বাংলাদেশেও নানা কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে যথাযোগ্য মর্যাদায় আজ বুধবার (২৯ মে) দিবসটি পালন করা হবে।
হাইতি থেকে পূর্ব তিমুর, লেবানন থেকে কঙ্গো পর্যন্ত বিশ্বের বিভিন্ন সংঘাতপূর্ণ এলাকায় বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা নিরলসভাবে কাজ করেছেন। বসনিয়ার তীব্র শীত, সাহারা মরুভূমির দুঃসহ গরম ও পূর্ব এশিয়ার ক্লান্তিকর আর্দ্রতার সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছেন বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা। ধর্ম, গোত্র, বর্ণ, রাজনৈতিক মতাদর্শ ও আঞ্চলিক বৈষম্যকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী সদস্যরা নিজেদের উৎসর্গ করেছেন বিশ্ব মানবতার সেবায়। পেশাগত দক্ষতা, নিরপেক্ষতা, সততা ও মানবিকতার কারণে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী সদস্যরা বিশ্বের সব মানুষের কাছে আজ অনন্য এক দৃষ্টান্ত। নিজেদের জীবন বিপন্ন করে বিভিন্ন দেশের জাতিগত সংঘাত মোকাবিলা এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত বিচিত্র দেশের রাস্তাঘাট, অবকাঠামো নির্মাণ ও চিকিৎসা সেবায় বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা অনুকরণীয় দায়িত্ব পালন করায় বিশ্বময় প্রশংসিত হচ্ছেন।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশ পুলিশের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও মর্যাদা বৃদ্ধি করেছে। বাংলাদেশ পুলিশ জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণের মাধ্যমে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় অঙ্গীকারাবদ্ধ। পুলিশ সদর দপ্তর বলছে, বাংলাদেশ পুলিশের ২১ হাজার ৪৫৩ জন শান্তিরক্ষী বিভিন্ন দেশে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে মিশন সম্পন্ন করেছেন। এর মধ্যে নারী শান্তিরক্ষী রয়েছেন এক হাজার ৮১০ জন। বর্তমানে ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো, মালি, সাইপ্রাস, সেন্ট্রাল আফ্রিকা, সাউথ সুদান ও লিবিয়ায় জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ পুলিশের ১২০ জন নারী সদস্যসহ ৩৬৪ জন শান্তিরক্ষী নিয়োজিত রয়েছেন। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালনকালে ২৪ জন পুলিশ সদস্য সর্বোচ্চ আত্মত্যাগ করেছেন। আহত হয়েছেন ১২ জন। এই বছরের গত সোমবার (২৭ মে) ডিআর কঙ্গো জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে যোগ দিতে ১৮০ পুলিশ সদস্য হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ত্যাগ করেন। বাংলাদেশ পুলিশের এ ফরমড্ পুলিশ ইউনিটির কমান্ডিং অফিসার হিসেবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন পুলিশ সুপার কাজী রুবাইয়াত রুমি।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আন্তর্জাতিক শান্তি আর সমৃদ্ধির ক্ষেত্রে অঙ্গীকারবদ্ধ ছিলেন। সে দীক্ষায় দীক্ষিত হয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সবাই বিশ্বশান্তি বিনির্মাণে বদ্ধপরিকর। সে আলোকেই বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা নিরলসভাবে কাজ করছেন। বিশ্বমানবতা প্রতিষ্ঠায় তাঁরা রেখে চলেছেন অসামান্য অবদান। কারণ, ভিন্ন ভিন্ন দেশে ভিন্ন ভিন্ন ধর্ম, বর্ণ, জাতি, গোষ্ঠী রয়েছে। রয়েছে বিচিত্র রাজনৈতিক মতাদর্শ। এসব সামাজিক ভেদাভেদ ও অর্থনৈতিক বৈষম্যকে পিছনে ফেলে সকলকে নিয়ে সহাবস্থান নিশ্চিত করছেন শান্তিরক্ষীরা। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রায় দু’শত আর্মার্ড পারসোনাল ক্যারিয়ার, অস্ত্র ও গোলাবারুদ এবং উল্লেখযোগ্য সংখ্যক যানবাহন নিয়ে তাদের অপারেশন পরিচালনা করছে। বাংলাদেশ নৌবাহিনী দুটি যুদ্ধ জাহাজ ওসমান ও মধুমতি লেবানন এবং ভূমধ্যসাগরীয় এলাকায় সর্বদা টহলের কাজে মোতায়েন রয়েছে। মিশন এলাকার শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অভ্যন্তরীণ নদীপথগুলোতেও তাদের সতর্ক প্রহরায় দেখা যায়। বাংলাদেশ বিমান বাহিনী বিআর-১৩০ এয়ারক্রাফট, এমআই- ১৭ ও বেল হেলিকপ্টারের মাধ্যমে কঙ্গো এবং অন্যত্র জরুরি সামরিক সরঞ্জাম পরিবহন, উদ্ধার অভিযান ও ত্রাণ তৎপরতায় দায়িত্ব পালন করছেন। বাংলাদেশ পুলিশের অনেক সদস্য মিশন এলাকার স্থানীয় প্রশাসনকে দাঙ্গা দমনে সহায়তা দিচ্ছেন। বাংলাদেশের সক্ষমতাকে বিশ্ববাসীর কাছে গৌরবের সঙ্গে তুলে ধরছেন শান্তিরক্ষীরা।
শান্তিরক্ষা মিশনে নিয়োজিত অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রের শান্তিরক্ষা মিশন সংক্রান্ত সক্ষমতা বৃদ্ধিতেও সহযোগিতা প্রদান করে আসছে বাংলাদেশ। গত রোববার (৫ মে) ঢাকা সেনানিবাসে আর্মি মাল্টিপারপাস কমপ্লেক্সে পেরু আর্মড ফোর্সেসকে উপহার হিসেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তৈরি একটি অ্যাক্সপ্লোসিভ অর্ডন্যান্স ডিসপোসাল (ইওডি) রিমোটলি অপারেটেড ভেহিকেল (আরওভি) প্রদান করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে সেনাপ্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘বিশ্ব শান্তিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশিত পথ অনুসরণ করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করে আসছে। বর্তমানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রগতিশীল নেতৃত্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এখন আধুনিকায়ন এবং সক্ষমতা বৃদ্ধির যুগে পদার্পণ করেছে। পাশাপাশি জাতিসংঘের অন্যতম প্রধান শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তার অপারেশনাল সক্ষমতা বৃদ্ধিতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।’
তিনি ওইদিন আরও বলেন, ‘শান্তিরক্ষা মিশনে নিয়োজিত অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রের শান্তিরক্ষা মিশন সংক্রান্ত সক্ষমতা বৃদ্ধিতেও আমরা সহযোগিতা প্রদান করে আসছি। পেরু আর্মড ফোর্সেসকে আরওডি প্রদান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এ সক্ষমতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এটি বাংলাদেশের স্বনির্মিত একটি আরওভি।’ ‘মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে নিয়োজিত জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন-মিনুস্কাতে ব্যবহারের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এর মৌলিক নকশা ও সক্ষমতা নির্ধারণ করা হয়েছে। বিগত কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা এটিকে চূড়ান্ত আকারে আনতে নিরলসভাবে কাজ করেছেন। মিনুস্কাতে সাম্প্রতিক আইইডি হুমকি বিবেচনায় কাউন্টার আইইডি সক্ষমতা বিকাশে এই ইওডি আরওভি কার্যকরী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে’-বলেন সেনাপ্রধান।
কালের আলো/এসএকে/এমএএএমকে