ময়মনসিংহে দ্বার খুললো পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের, চোখে-মুখে গর্বের হাসি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর

প্রকাশিতঃ 11:00 pm | July 13, 2024

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:

মুক্তিযুদ্ধে বহুল ব্যবহৃত অস্ত্র স্টার্লিং সাব মেশিন কারবাইনকে ‘স্টেনগান’ নামে ডাকতেন মুক্তিযোদ্ধারা। কাচ ঘেরা বাক্সে সাজিয়ে রাখা হয়েছে রাশিয়ার তৈরি এ অস্ত্রটি। থ্রি নট থ্রি রাইফেল হাতে রাজারবাগে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিরোধ গড়ে তুলেন পুলিশ সদস্যরা। কাঁপন ধরিয়ে দেয় পাকিদের বুকে। পয়েন্ট ৩২ বোর রিভলবার, পয়েন্ট ৩৮ বোর রিভলবার, ১২ বোর শটগান, ৯ এমএম এসএমজিসহ আরও অনেক এমন অস্ত্রের দেখা মেলে ময়মনসিংহের পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে। আছে বিভিন্ন সময়ের পুলিশের ইউনিফর্ম, পুলিশ সদস্যদের আত্মজীবনী বা রণাঙ্গনের স্মৃতি, আলোকচিত্রসহ আরও কত কী!

বৃহত্তর ময়মনসিংহের মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধে ময়মনসিংহ জেলা পুলিশের সদস্যদের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার নানা দিক তুলে ধরে ‘বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ময়মনসিংহ’ গড়ে তুলেছেন ময়মনসিংহ জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মাছুম আহাম্মদ ভূঞা। শনিবার (১৩ জুলাই) দ্বার খুলেছে এই জাদুঘরের। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল জেলা পুলিশ লাইনসে এ জাদুঘরের উদ্বোধন করেন। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবেই এ সময় মন্ত্রীর চোখে-মুখে ছিল গর্বের হাসি। দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের মেলবন্ধন তৈরি করা এ জাদুঘর গড়ে তোলার জন্য ময়মনসিংহ জেলা পুলিশ সুপারকে (এসপি) ধন্যবাদ জানান। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘এ উদ্যোগের ফলে নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে, স্বাধীনতাযুদ্ধে ময়মনসিংহের মানুষ কখনও মাথা নত করেনি। সবসময় মাথা উঁচু করে থেকেছে, যার স্বাক্ষর এই পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।’ তিনি বলেন, ‘যারা মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছেন তাদের ইতিহাস এই জাদুঘরে স্থান পেয়েছে। পুলিশের বিবর্তনের ইতিহাসটাও খুঁজে পাওয়া যায় এখানে। রয়েছে বঙ্গবন্ধুর ইতিহাস। এই জাদুঘরে নতুন প্রজন্মরা এলে বঙ্গবন্ধুসহ মুক্তিযুদ্ধকে জানতে পারবে। স্বাধীনতার যুদ্ধে পুলিশেরও কী ভূমিকা ছিল সেটাও জানতে পারবে।’

জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের গৌরবদীপ্ত ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে ধারণ করে জেলা পুলিশ লাইনসের অভ্যন্তরে শৈল্পিক এবং নান্দনিক আদলে নির্মিত হয়েছে এই জাদুঘর। গৌরবোজ্জ্বল সেই ইতিহাসের স্মারক হিসেবেই বৃটিশ আমলের স্থাপত্যের ঐতিহ্যে গড়া প্রায় পরিত্যক্ত ভবনটি সংস্কার করে জাদুঘর প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন ময়মনসিংহ জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মাছুম আহাম্মদ ভূঞা। এ জাদুঘরে রয়েছে ৫টি গ্যালারি। প্রজন্ম প্রজন্মান্তরে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসকে তুলে ধরার এ উদ্যোগের জন্য এর আগে প্রশংসা করে গেছেন দেশের ২৪তম প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানও। শুধু তাই নয়, লোক সংস্কৃতি ও লোকগাঁথার তীর্থ স্থান ময়মনসিংহের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকেও শৈল্পিক উপস্থাপনের মাধ্যমে মেলে ধরা হয়েছে জাদুঘরটিতে। রয়েছে মুক্তিযুদ্ধে পুলিশের অবদানের নানান স্মারক।

গতানুগতিকতার বাইরে শব্দ, ছবি আর আলোকের চমৎকার সংমিশ্রণে সাজানো হয়েছে জাদুঘরটির প্রতিটি গ্যালারি। এসব দর্শনার্থীদের ভিন্ন অনুভূতি দেওয়ার পাশাপাশি কিছু মুহূর্তের জন্য তাদের পৌঁছে দেবে মুক্তিযুদ্ধের সেই সময়ে। অনন্য এই স্থাপত্যশৈলীর মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ আর বর্তমান সময়কে ধারণ করা হয়েছে। এই অঞ্চলে বেড়ে ওঠা নতুন প্রজন্মকে স্বাধীনতার ইতিহাস বিষয়ে সচেতন করে তুলবে জাদুঘরটি। যার ফলে তারা মাতৃভূমির জন্য গর্ব ও দেশাত্মবোধে উদ্দীপ্ত হবে এবং উদার অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী হবে বলে মনে করেন অনেকেই।

জেলা পুলিশের ১১ প্রকল্পের উদ্বোধন
এর আগে মন্ত্রী উদ্বোধনী ফলক উন্মোচন এর মাধ্যমে জেলা পুলিশের ১১টি প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। প্রকল্পগুলো হলো- পুলিশ লাইনসের ৬ তলা ভিত বিশিষ্ট পুলিশ ব্যারাক ভবনের দ্বিতীয়-ষষ্ঠ তলা পর্যন্ত ঊর্ধ্বমুখী সম্প্রসারণ কাজ, ফুলবাড়িয়া থানা ভবনের দ্বিতীয় তলার আংশিকসহ তৃতীয় ও চতুর্থ তলার নির্মাণ কাজ, হালুয়াঘাট থানা ভবনের দ্বিতীয় তলার আংশিকসহ তৃতীয় ও চতুর্থ তলার নির্মাণ কাজ, গৌরীপুর থানা ভবনের দ্বিতীয় তলার আংশিকসহ তৃতীয় ও চতুর্থ তলার নির্মাণ কাজ, ২ নম্বর শহর পুলিশ ফাঁড়ি ভবনের চতুর্থ-ষষ্ঠ তলার নির্মাণ কাজ, ফুলপুর থানা ভবনের দ্বিতীয় তলার আংশিকসহ তৃতীয় ও চতুর্থ তলার নির্মাণ কাজ, ১ নম্বর শহর পুলিশ ফাঁড়ি ভবনের তৃতীয় ও চতুর্থ তলার নির্মাণ কাজ, পাগলা থানায় ৬ তলা ভিতের ১ তলা ইনচার্জ অফিসার্স কোয়ার্টার ও ৬ তলা ভিতের ৩ তলা ডরমিটরি ভবন নির্মাণ, পাগলা থানা ভবনের দ্বিতীয় তলার আংশিক এবং তৃতীয় ও চতুর্থ তলার নির্মাণের অতিরিক্ত কাজ, পাগলা থানাধীন পাঁচবাগ তদন্ত কেন্দ্রের কার্যক্রম। পরে মন্ত্রী ‘মুক্তিযুদ্ধে পুলিশ: ময়মনসিংহ জেলা’ গ্রন্থের মোড়ক উন্মোচন করেন।
ময়মনসিংহ রেঞ্জের উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) শাহ আবিদ হোসেন এর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সুধী সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেন।

ছাত্রদের আন্দোলন থামানো উচিত
দেশব্যাপী চলমান কোটা সংস্কারের দাবিতে চলা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের বিষয়ে সুধী সমাবেশে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘আমি মনে করি, তাঁদের (ছাত্রদের) একটু অপেক্ষা করা উচিত, আন্দোলন থামানো উচিত। কারণ, পৃথিবীর সব জায়গায় কিন্তু কোটা রয়েছে। সব দেশেই কিছু অনগ্রসর জায়গা থাকে, যেমন আমাদের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জন্য কোটা রয়েছে এবং সংবিধানেও সেটি বলা আছে। এটি বাতিল করে দিলে এরা কোনো দিন সমাজের মূলস্রোতে আসতে পারবে না। আমরা মনে করছি, সবাই যেন একসঙ্গে চলতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘ছাত্র ভাইদের কিছু বলার থাকলে তাঁরা রাস্তাঘাট বন্ধ না করে আদালতে এসে তাঁদের যা বলার তা যেন বলেন। রাস্তাঘাট বন্ধ করলে জনগণের দুর্ভোগ বাড়ে, হাসপাতালগামী রোগীদের দুর্ভোগ বাড়ে। যে যেখানে যাচ্ছেন, তাঁরা বাধাপ্রাপ্ত হলে ৫-৬ ঘণ্টা বসে থাকেন। সেই সাধারণ মানুষের যে কী অভিব্যক্তি, ছাত্রদের তা শোনা উচিত। আমি মনে করি, রাস্তা অবরোধ না করে আমাদের প্রধান বিচারপতি যেভাবে বলেছেন, তাঁদের সব দাবি যেন আদালতে এসে বলেন।’

আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘২০১৮ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কোটা উঠিয়ে দিয়েছিলেন। বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বাধীন। বিচার বিভাগ থেকে বার্তা এসেছে, কোটা আবার চালু হবে। এতে সংক্ষুব্ধ হয়েছেন আমাদের ছাত্ররা। প্রধান বিচারপতি কিন্তু স্পষ্ট করে নির্দেশনা দিয়েছেন, আদালত যে রায়টি দিয়েছিলেন, সেটি স্থগিত করা হয়েছে এবং ছাত্রদেরও বলেছেন, তাঁরা যেন উচ্চ আদালতে যেখানে বিচারটি চলছে, সেখানে গিয়ে যেন তাঁদের কথা বলেন। যাতে করে তাঁদের যদি কিছু বলার থাকে, তাঁরা বললে সেই অনুযায়ী বিচারপতিদের বিচার করতে সুবিধা হবে।’

মন্ত্রী বলেন, করোনার সময় যখন সন্তান বাবা-মায়ের কাছে যায়নি, তখন পুলিশ গেছে। এখানের পুলিশ সবার হৃদয় জয় করেছে। পুলিশ শুধু জনগণকে ভালোবাসে না, দেশের ইতিহাসকেও রক্ষা করে। নির্বাচনে পুলিশের কোনো পক্ষপাতিত্ব ছিল না। তার উদাহরণ বর্তমান আইজিপির ভাই নৌকা নিয়ে দাঁড়ালেও পরাজিত হয়েছেন। পুলিশ বাহিনী সব নির্বাচনে সঠিক দায়িত্ব পালন করেছেন।

জেলা পুলিশ আয়োজিত সুধী সমাবেশে স্বাগত বক্তব্য দেন জেলা পুলিশ সুপার (এসপি) মাছুম আহাম্মদ ভূঞা। এ সময় উপস্থিত ছিলেন ময়মনসিংহ-২ (ফুলপুর-তারাকান্দা) আসনের সংসদ সদস্য শরীফ আহমেদ, ময়মনসিংহ-৪ (সদর) আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ মোহিত উর রহমান, ময়মনসিংহ-১ (হালুয়াঘাট-ধোবাউড়া) আসনের সংসদ সদস্য মাহমুদুল হক, ময়মনসিংহ-৫ (মুক্তাগাছা) আসনের সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম, ময়মনসিংহ-৬ (ফুলবাড়িয়া) আসনের সংসদ সদস্য মো. আবদুল মালেক সরকার, ময়মনসিংহ-৭ (ত্রিশাল) আসনের সংসদ সদস্য এ বি এম আনিছুজ্জামান, ময়মনসিংহ-৮ (ঈশ্বরগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য মাহমুদ হাসান, ময়মনসিংহ-১০ (গফরগাঁও) আসনের সংসদ সদস্য ফাহ্‌মী গোলন্দাজ, ময়মনসিংহ-১১ (ভালুকা) আসনের সংসদ সদস্য আবদুল ওয়াহেদ, ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের মেয়র ও ময়মনসিংহ মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. ইকরামুল হক টিটু, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এমদাদুল হক, ময়মনসিংহ বিভাগীয় কমিশনার উম্মে সালমা তানজিয়া, জেলা প্রশাসক দিদারে আলম মোহাম্মদ মাকসুদ চৌধুরী, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ইউসুফ খান পাঠান, কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাধারণ সম্পাদক আফজালুর রহমান বাবু, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এহতেশামুল আলম, ময়মনসিংহ চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আমিনুল হক শামীম, নাট্যব্যক্তিত্ব ম. হামিদ প্রমুখ।

কালের আলো/এমএএএমকে