বিমান বাহিনীর মানবিক ঔদার্য্য, শঙ্কার মেঘ কাটিয়ে জায়েদা-সানজিদাদের ঘরে নতুন অতিথি
প্রকাশিতঃ 9:00 pm | August 30, 2024
এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, অ্যাকটিং এডিটর, ফেনী ঘুরে এসে :
সন্তান জন্মদানের মাধ্যমে পেয়েছেন মাতৃত্বের স্বাদ। পূর্ণতা পেয়েছেন জীবনের। স্বভাবতই আনন্দে আত্মহারা জায়েদা আক্তার (২২)। অতুলনীয় অনুভূতির কথা বলে চললেন। হঠাৎ গাঢ় আঁধার নেমে আসে মুখে। প্রবল বন্যায় গোটা ফেনী পানিতে তলিয়ে যাওয়ার সময় অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। প্রাথমিক চিকিৎসা সেবাই যেখানে অনিশ্চিত সেখানে সিজারের মতো বড়সড় অপারেশন রীতিমতো অলীক কল্পনা! তবে সৌভাগ্যক্রমে বিমান বাহিনীকে বিষয়টি জানানোর পর কেটে যায় শঙ্কার মেঘ। তাকে হেলিকপ্টারে উদ্ধার করে পৌঁছে দেওয়া হয় রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে।
সেখানেই ফুটফুটে পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছেন। নবজাতককে নিয়ে এবার বাড়ি ফেরার পালা। হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকা সেনানিবাসের বিমান ঘাঁটি বাঁশার’এ শুক্রবার (৩০ আগস্ট) নিয়ে আসা হয় জায়েদাকে। সঙ্গী ছিলেন তাঁর স্বামী শরীফুল ইসলাম। স্বামী-স্ত্রী হাসিমুখে বিমান বাহিনীর এমআই১৭১এসএইচ হেলিকপ্টারে উড়লেন আকাশে। গন্তব্য ফেনীর ছাগলনাইয়া হাইস্কুল মাঠ।
উচ্ছ্বসিত জায়েদা একদমেই কালের আলোকে বলেন, ‘সেদিনের সেই বিভীষিকাময় মুহূর্তটা এখনো আমার চোখে ভাসে। বিমান বাহিনীর এই ঋণ শোধ করার মতো নয়।’ পাশেই থাকা স্বামী শরীফুল বলেন, ‘সত্যিই প্রথম সন্তানের বাবা হবার অনুভূতি একদমই আলাদা। বিমান বাহিনী প্রকৃত অর্থেই সাহসিকতা ও মানবিকতার পরিচয় দিয়েছে। তাঁরা পাশে না দাঁড়ালে আজকের এই আনন্দ মুহুূূর্ত আমাদের জীবনে আসতো না। আমরা বিমান বাহিনী প্রধানের প্রতি কৃতজ্ঞ।’
শুধু জায়েদা আক্তারই নন, একই রকম আনন্দানুভূতির কথা জানান সুলতানা (৩২), রাবেয়া (২১), জেনিয়া (২৪) ও সানজিদা (২২)। মানবিক বিপন্নতায় অনাগত সন্তানের জীবন ঝুঁকি ছিল তাদেরও। তাদেরকেও গত কয়েকদিনে ফেনী থেকে নিরাপদে উদ্ধার করে বিমান বাহিনী ঘাঁটি বাশারের এয়ার মুভমেন্টে স্থানান্তরের পর দ্রুত বিশেষায়িত অ্যাম্বুলেন্সে রাজধানীর কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে কেউ ছেলে বা কন্যা সন্তানের মা হয়েছেন। সন্তানের কচি হাতে নিজের আঙুল রেখেছেন তাঁরা। কোলে তোয়ালে প্যাঁচানো ছোট্ট এক জোড়া চোখের চাহনি দেখতে দেখতে অনির্বচনীয় অনিন্দ্য সুন্দর রঙিন জীবনে পরিবারের নতুন অতিথিকে সঙ্গে নিয়ে অবশেষে ফিরে গেলেন বাড়িতে।
শুক্রবার (৩০ আগস্ট) বেলা পৌনে ১২টার দিকে তাদের বহনকারী বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর এমআই১৭১এসএইচ হেলিকপ্টার ফেনীর ছাগলনাইয়া হাই স্কুল মাঠের অস্থায়ী হেলিপ্যাড স্পর্শ করার সময় আগে থেকেই সেখানে উপস্থিত ছিলেন তাদের কাছের থেকে দূরের স্বজনেরাও। এসব অভিযানকে তাঁরা বিমান বাহিনীর সাহসিকতা, দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের পাশাপাশি অনুপম দেশপ্রেমের উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি বলেই মনে করেন। এর আগে তাদের ঢাকা সেনানিবাসে বিমান ঘাঁটি বাশারে আনন্দ নন্দিত বিদায়ী অভিনন্দন জানান বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ১০১ স্পেশাল ফ্লাইং ইউনিটের (এসএফইউ) এর কমান্ড্যান্ট এয়ার কমডোর মো: মিরাজ পাটোয়ারী। এ সময় তাদের হাতে বিভিন্ন উপহার সামগ্রীও তুলে দেওয়া হয়। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বাহিনীটির সদস্যদের আন্তরিকতায় অশ্রুসজল মায়াময় চোখ নজরে আসে সবার।
দেশের আকাশসীমা রক্ষার অতন্দ্র প্রহরী বাংলাদেশ বিমান বাহিনী বুকে সাহস নিয়ে মাথা উঁচু করে দুর্যোগে দুর্বিপাকে সাধারণ মানুষের পাশে থেকে কার্যকর ভূমিকা পালনের মাধ্যমে উজ্জ্বল করেছে দেশের ভাবমূর্তি। পরম মমতায় সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সর্বগ্রাসী বন্যা কবলিত ফেনীসহ দেশের ১১টি জেলায়। প্রবল বন্যায় ডুবন্ত জনপদের দুর্গম বিভিন্ন এলাকায় হেলিকপ্টার নামানো সম্ভব না হলেও খুব দক্ষতার সঙ্গে বিমান বাহিনী গর্ভবতীসহ আটকেপড়া মানুষকে উদ্ধার করে নিজেদের সক্ষমতার বিষয়টি মোটা দাগে উপস্থাপন করেছে। দুর্যোগেই মানবিকতার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ করেছেন নিজেদের।
বিভিন্ন সূত্র জানায়, স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা মোকাবিলায় বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ত্রাণ বিতরণ, উদ্ধার ও চিকিৎসা সেবা প্রদানসহ নানাবিধ উদ্যোগ গ্রহণ করে। হেলিকপ্টারে ফেনীতে জেনারেটর ও চিকিৎসকদের নিয়ে গিয়ে বসানো হয়েছে মেডিকেল ক্যাম্প। সেখানে মিলছে ঠান্ডা ও পানিবাহিত রোগের চিকিৎসা। এর আগে শুরুতেই বানভাসিদের রক্ষায় নিজেদের সর্বাত্মক প্রস্তুতির কথা জানিয়েছিলেন বাংলাদেশ বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চীফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন। হেলিকপ্টার থেকে দুর্গত এলাকায় বন্যার্তদের জন্য প্যারাস্যুটের মাধ্যমে ত্রাণ ফেলা হয়। গত শুক্রবার (২৩ আগস্ট) তিনি হেলিকপ্টার থেকে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করেন। আরও সুষ্ঠভাবে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনায় দেন প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা। এসব হৃদয়স্পর্শী কর্মযজ্ঞ মানসিক স্বস্তি ও শক্তি জুগিয়েছে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে; আশান্বিত করেছে দেশের বিবেকবান প্রতিটি মানুষকে। ভালোবাসার মায়াবি মোহনায় তাঁরা কল্যাণ আর মানবিকতার সুর গেঁথে দিচ্ছেন বানভাসিদের প্রাণে প্রাণে। যারপরেনাই ঠাঁই করে নিয়েছেন সর্বনাশা বন্যায় পানিবন্দিদের হৃদয়ের মঞ্জিলে।
কালের আলো/এমএএএমকে