অপরাজেয় সাহসীদের সুস্থতায় বিজিবি হাসপাতালে একরাশ ডানা মেলা স্বপ্ন
প্রকাশিতঃ 8:55 pm | September 05, 2024
বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:
ইতিহাসের পাতায় যোগ করেছেন নতুন এক অধ্যায়ের। ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানে পরাধীনতার শিকল ভেঙে নতুন এক স্বাধীনতা অর্জনের তৃপ্তি। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নানা বাঁকে সক্রিয় থাকা শত শত আহতের ঠিকানা রাজধানীসহ দেশের কোন না কোন হাসপাতাল। হাসপাতালের বিছানায় থেকেও জয়ের উচ্ছ্বাস এখনও ওদের চোখে-মুখে। অপরাজেয় এই সাহসীদের অনেককেই সুস্থ করে তুলতে গুরুদায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।
নিবিড় পরিচর্যায় গুলিবিদ্ধ অনেককেই পরম মমতা আর দায়িত্বশীলতার সঙ্গে চিকিৎসা সেবা প্রদানের মাধ্যমে অন্য রকম এক সংগ্রামে নিজেদের শামিল করেছেন রাজধানীর পিলখানার বর্ডার গার্ড হাসপাতালের চিকিৎসকরা। দেশের জন্য নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন বীজ বুনে দেওয়া চিকিৎসাধীন আহতরা একা নয়, এই বিশ্বাসটুকু বুনে দিয়েছেন ওদের হৃদমাঝে। গভীর ও দৃঢ় করেছেন পারস্পরিক বন্ধন।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ির কোনাপাড়ায় রোকেয়া আহসান ইউনিভার্সিটি কলেজের ইংরেজী বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী আমান উল্লাহ আমানের (২২) কথাই ধরা যাক। শনির আখড়া গোয়াল বাড়ি মোড় এলাকায় একটি ভাড়া বাসায় থেকে পড়াশুনা করতেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের শুরু থেকেই ঢাকার রাজপথে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। গত ২০ জুলাই শনিবার সকালে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে রাজধানীর যাত্রাবাড়ি এলাকায় দনিয়া কলেজের সামনে রাস্তায় মিছিল করার সময় হঠাৎ তলপেটে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তার তলপেটে অস্ত্রোপচারের পর সরকারিভাবে উন্নত চিকিৎসার জন্য গত ১৯ আগস্ট তাকে পিলখানার বিজিবি হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়। আগের চেয়ে এখন কিছুটা সুস্থতা অনুভব করছেন। আন্তরিকতার সঙ্গেই চলছে তাঁর চিকিৎসা সেবা।
পিলখানার বিজিবি হাসপাতালে চিকিৎসাধীনদের আদ্যোপান্ত
জানা যায়, বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকে রাজধানীর বর্ডার গার্ড হাসপাতালের চিকিৎসকরা জরুরী মেডিকেল টিমের মাধ্যমে নিরলসভাবে চিকিৎসা সেবা প্রদান করে আসছে। এখন পর্যন্ত মোট ৪২ জন এখানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এর মধ্যে ৮ জন ছাত্র রয়েছেন। সার্জিক্যাল টিমের মাধ্যমে এখানে ৬ জন রোগীকে প্রয়োজনীয় জটিল অস্ত্রোপচার করা হয়। ৩ জন রোগীকে অর্থোপেডিক টিম প্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার সম্পন্ন করেছে।
পিলখানার বিজিবি হাসপাতাল জানায়, আহত রোগীদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জামাদি, ওষুধ, প্রয়োজনীয় উন্নত পথ্য বিজিবি থেকে বিনামূল্যে সরবরাহ করা হচ্ছে। সকল রোগীর পরবর্তী দীর্ঘমেয়াদী পূনর্বাসন জরুরী হওয়ায় বিজিবি মহাপরিচালকের সরাসরি তত্ত্বাবধানে সুপরিকল্পিতভাবে সেটি নিশ্চিত করা হচ্ছে। পাশাপাশি রোগীর সঙ্গে আসা স্বজনদের থাকা ও খাবার খরচও বহন করছে বিজিবি।
একই সূত্র জানায়, বিজিবি মহাপরিচালকের আন্তরিকতায় ও চিকিৎসা শাখার সার্বিক তত্ত্বাবধানে গত ১৯ জুলাই শুরু থেকেই আহত ছাত্রদের পিলখানা বিজিবি হাসপাতালে নিয়ে এসে মোবাইল অ্যাম্বুলেন্সে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়। বেশি আহত রোগীদের হাসপাতালের ভেতরে গোপনে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়।
এর আগে গত বুধবার (২১ আগস্ট) বিজিবি সদর দপ্তর থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানা হয়, কোটা সংস্কার আন্দোলনে সারাদেশে ৩ বিজিবি সদস্য নিহত ও ১৩০ জন বিজিবি সদস্য আহত হন। নিহতদের মধ্যে ২ জন র্যাবে কর্মরত ছিলেন। গুরুতর আহত ১৮ জনকে ঢাকায় বর্ডার গার্ড হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হয়েছে। বর্তমানে ৪ জন বিজিবি সদস্য চিকিৎসাধীন রয়েছে। এছাড়াও আন্দোলনে আহত বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজ ও বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রউফ পাবলিক কলেজের শিক্ষার্থীসহ অন্যান্য স্থান থেকে আসা ২০ জন শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন পেশার মানুষ বর্ডার গার্ড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে। এর আগে ৩ জন শিক্ষার্থীকে চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হয়েছে।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহতদের শয্যা পাশে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহতদের সার্বিক অবস্থার খোঁজ খবর নিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম. সাখাওয়াত হোসেন গত মঙ্গলবার (১৩ আগস্ট) ও বর্তমান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বুধবার (২১ আগস্ট) পিলখানায় বর্ডার গার্ড হাসপাতাল পরিদর্শন করেন। এসময় তাঁরা আহত বিজিবি সদস্য এবং আন্দোলনে আহত হয়ে বিজিবি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলেন এবং তাদের চিকিৎসার খোঁজ খবর নেন। দু’উপদেষ্টাই আহত বিজিবি সদস্য ও শিক্ষার্থীদের উন্নত চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার জন্য বিজিবি মহাপরিচালকসহ সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ প্রদান করেন।
আহত দুর্জয় সাহসীদের সুস্থতায় বিজিবির প্রাণান্তকর প্রয়াস
তারুণ্যের উদ্যম, আগ্রহ ও শক্তি অতুলনীয়। আন্দোলনে অংশগ্রহণ করা প্রত্যেকে সাহসিকতা ও বিপ্লবের প্রতীক। একজন আবু সাঈদ বা মুগ্ধের মতো গল্প সবার চোখের সামনে দৃশ্যমান। দুর্জয় তারুণ্য নির্ভয়ে বুলেটের সামনে দাঁড়িয়েছেন। মাথা নত করেনি। ওরা একাত্তর দেখেনি কিন্তু চব্বিশের অমরকাব্যের নায়ক ওরাই। চোখের সামনে ভাই-বোনদের মৃত্যু দেখেছে, বিসর্জন দিয়েছে অশ্রু। ছাত্র-জনতার দাবির মুখে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন। প্রায় দেড় দশকের নির্যাতন-নিপীড়নের অবসান হয়েছে। সব ক্ষমতার উৎস জনগণ, প্রমাণিত হয়েছে আবারও। এখন হাতে হাত রেখে বৈষম্যহীন দেশগড়ার প্রত্যয় ওদের। অনেক গল্প থেকে গেছে অন্তরালে বা অগোচরে। আশার আলো হয়ে আহত দুর্জয় সাহসীদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)।
বিজিবি সদর দপ্তর জানায়, ‘সীমান্তে অতন্দ্র প্রহরীর ভূমিকা পালনের পাশাপাশি দেশের প্রতিটি দুর্যোগে-সঙ্কটে দেশের মানুষের পাশে রয়েছে বিজিবি। বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত ছাত্র-জনতার সুচিকিৎসা নিশ্চিতে আমাদের আন্তরিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। তাদের মনে ও মননে, চিন্তায় ও চেতনায় একটি সুন্দর ও শান্তির বাংলাদেশের একরাশ ডানা মেলা স্বপ্ন। সেই স্বপ্নপূরণে পিলখানার বিজিবি হাসপাতালের চিকিৎসকরা রাত-দিন একাকার করে কাজ করছেন।’
কালের আলো/এমএএএমকে