দেড় হাজার কোটি টাকার মালিক লোটাস কামালের জৌলুসহীন শৈশব

প্রকাশিতঃ 3:49 pm | February 13, 2018

অ্যাক্টিং এডিটর, কালের আলো:

একদিনের জন্য হলেও বিশ্ব ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসি’র সভাপতি হবার স্বপ্ন দেখতেন। প্রথম ও একমাত্র বাংলাদেশি হিসেবে নিজের সেই স্বপ্ন পূরণ করেছেন অনেক আগেই। তবে একদিনের জন্য নয়! ছিলেন পুরোপুরি এক বছর। এ পদ প্রাপ্তির মধ্যে দিয়েই মাঠের বাইরে ক্রিকেটে সবচেয়ে বড় সাফল্যই বয়ে আনেন তিনি।

আইসিসি’র সভাপতি পদটি অলঙ্কারিক হলেও বাংলাদেশের জন্য ছিল ভীষণ সম্মানের। এর আগে একই পদে ছিলেন এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলেও। দেশের ক্রিকেটের মতো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে ক্রীড়ানুরাগীদের হৃদয় ছুঁয়ে যান আ হ ম মোস্তফা কামাল ওরফে লোটাস কামাল।

আবার সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীদেরও একজন পরিকল্পনা মন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এখানেও তিনি সফল। বিশ্ব পরিমন্ডলে একনামে পরিচিত। সফল রাজনীতিবিদ ও এ ক্রিকেট সংগঠক কখনোই সাময়িক জয়ের মোহে নিজেকে বেঁধে রাখেননি। তাঁর নামের পাশে ব্যর্থতা শব্দটিই যেন বড্ড বেমানান।

দৃঢ় প্রত্যয়ী ৭০ বছর বয়সী লোটাস কামাল ব্যবসায়ী হিসেবে দেশ সেরাদেরও একজন। তিনি এখন ১৪ হাজার ১ শ’ ৩৯ কোটি টাকার মালিক। জীবনের উষালগ্ন থেকেই লক্ষ্যপূরণে আপসহীন এ মন্ত্রীর সংগ্রামী গল্প বিস্ময় জাগায়। আবার উদ্দীপ্ত করে নতুন প্রজন্মকে। মন্ত্রীর কষ্টে মোড়ানো শৈশব-কৈশোরের জীবনের এমন গল্প এখন মানুষের মুখে মুখে।

অথচ শৈশবে পড়াশুনা চালানোর মতোই সামর্থ্য ছিল না মন্ত্রীর দরিদ্র বাবার। বেতন দিতে না পারায় স্কুলের খাতা থেকে একাধিকবার তার নাম কাটা পড়েছিল। এলাকার মানুষজনের টাকায় বেতন দিতে হয়েছে স্কুলের। ছাত্রজীবনে থাকতে হয়েছে মানুষের বাসা-বাড়িতে।

এ মন্ত্রীর জীবন কাহিনী যেন সাহস, নিরবিচ্ছিন্ন কঠোর পরিশ্রমের দৌলতে সাফল্যের অভিযাত্রায় মুড়ানো। অসীম দৃঢ়তায় তিনিই বলতে পারেন ‘আমি সফল মানুষ।’ তার মুখেই যেন মানায় জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সফল্য দেখিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়।

কুমিল্লার লাকসামের অজপাড়াগাঁয়ে দরিদ্র বাবার জীর্ণ কুঠিরে জন্ম আ হ ম মোস্তফা কামালের। সময়টা ১৯৪৭ সালের ১৫ জুন। বর্তমান জীবনের বিপরীতে তার শৈশব ছিল নিতান্তই জৌলুসহীন। কৃষক বাবার ঘরে জন্মানো সেদিনের কিশোরের পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়াটাই ছিল অনেক চ্যালেঞ্জের।

সেই কঠিন দু:সময় জয় করার গল্পের কথা প্রায়ই নিজের মুখেই তুলে ধরেন লোটাস কামাল। দারিদ্র্যের অন্ধকারে বেড়ে উঠা জীবনের কথা বলতে গিয়ে অনেক সময় আবেগ প্রবণ হয়ে উঠেন।

হৃদয়ের মর্মমূল থেকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন নিজের গ্রামের হাবিবুল্লাহ মিয়া, মোহাম্মদ আলী চেয়ারম্যান ও আলী আশরাফ মজুমদারদের কথা। যারা সেদিন তাঁর স্কুলের বেতন দিয়েছেন। ফরম ফিলাপ করিয়ে দিয়েছেন।

নিজের পরিবারের মতো মন্ত্রীর গ্রামের অবস্থাও ছিল বেশ করুণ। খরা ও বর্ষার সময়ে ভয়াবহ খাবার সংকট চলতো। তিনবেলা খাবার জুটবে কীনা এ নিয়েও অনিশ্চয়তায় থাকতে হতো মানুষজনকে। ফলে কৃষক বাবার সন্তানের জন্য কলেজে পড়াশুনা করার স্বপ্ন ছিল ‘গরিবের ঘোড়া রোগ’র মতন।

অকপট মন্ত্রী শৈশবেও ছিলেন অসম্ভব মেধাবী। এলাকার হৃদয়বানদের সহায়তায় সাফল্যের সঙ্গে উচ্চ মাধ্যমিকের গন্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাবার সময়েও ছিলেন চরম অনিশ্চয়তায়। ওই সময় ঢাকা যেতে পকেটে ট্রেনের ভাড়াও ছিল না।

টানা দু’দিন কখনো হেঁটে আবার কখনো ট্রেনের চেকারকে ফাঁকি দিয়ে ঢাকায় পৌঁছেছেন। কিন্তু থাকবেন কোথায় এ নিয়েও পড়েন নতুন সমস্যায়। পড়াশুনা চালাতে গিয়ে মানুষের বাড়িতে বাড়িতে থাকতে হয়েছে।

১৯৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে বাণিজ্য ও আইন বিষয়ে স্নাতক পাস, এরপর অ্যাকাউন্টিংয়ে স্নাতকোত্তর অর্জন করেন। বিশ্বের নানা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামী-দামি ডিগ্রি পেয়েছেন।

কুমিল্লা-১০ আসন থেকে বার বার নির্বাচিত সংসদ সদস্য আ হ ম মোস্তফা কামালের নাম লোটাস কামাল কেন, এমন প্রশ্ন দেশের অনেক মানুষের মনেই। সম্প্রতি এ উপাধির নেপথ্য কথা তুলে ধরেছেন মন্ত্রী নিজেই।

বলেছেন, ১৯৭০ সালে পাকিস্তানের (পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান) চার্টার্ড অ্যাকাউনন্ট্যান্সি পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধা তালিকায় প্রথম হন। সেবার ওই পরীক্ষায় সবকালের সেরা নম্বর পেয়ে পাস করেন। আজো এ রেকর্ড তার কব্জায়। একমাত্র বাঙালি হিসেবে এমন বিরল কৃতিত্বের কারণেই এ উপাধি পান তিনি।

শত প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে চ্যালেঞ্জ নিয়ে জীবনে এগিয়ে যাওয়া আবু হেনা মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল ওরফে লোটাস কামাল পেশায় চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। সফল ব্যবসায়ী হিসেবেও তার সুনাম দেশজোড়া। ব্যবসায়ী হিসেবে যেখানেই হাত দিয়েছেন সোনা ফলিয়েছেন।

মোস্তফা কামালের শৈশবে আরেকটি স্বপ্ন ছিল একজন ভাল খেলোয়াড় হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলা। মাঠের নৈপুণ্যে সবার চেয়ে এগিয়ে থাকলেও খাটো ছিলেন। আমগাছে রশি ঝুলিয়েও লম্বা হওয়ার চেষ্টা করেছেন।

জীবনের প্রারম্ভে ভঙ্গ হওয়া স্বপ্ন আবার নতুনভাবে বড় পরিসরে পূরণ করেছেন লোটাস কামাল। দু’দশকেরও বেশি সময় তিনি আবাহনী ক্রিকেট কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। সংগঠক হিসেবে বার বার দলকে জিতিয়েছেন। তার জামানায় ঢাকা লীগে টানা চ্যাম্পিয়ন হয়েছে আবাহনী। ৩০ বছরেরও বেশি সময় অবদান রেখেছেন দেশের ক্রিকেটের উন্নয়নে।

দেশের ক্রিকেটের অভিভাবক সংস্থা বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি পদে তাকেই ধরা হয় সবকালের সেরা সভাপতি। টানা চার বছর ছিলেন এ পদে।

তাঁর সময়ে স্বাগতিক হিসেবে ২০১১ ক্রিকেট বিশ্বকাপের আয়োজন করে বাংলাদেশ। ওইবারের আয়োজন গোটা বিশ্বে অন্যরকম উচ্চতায় নিয়ে যায় টাইগারদের। বিশ্বকাপ সাফল্যের দিক থেকেও বাংলাদেশ ছিল দ্বিতীয় স্থানে।

মহিলা ক্রিকেট দলের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং তাদের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খেলার সুযোগও হয় তাঁর সময়ে। আন্তর্জাতিক মানের বিপিএল ও বিসিএল চালু হয় তার সময়েই। টাইগাররাও তার সময়ে জিতেছে বেশি। আর্থিকভাবে বিসিবিকে লাভবান করেছেন।

 

কালের আলো/এমকে