ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে নেই বাড়তি সতর্কতা

প্রকাশিতঃ 10:31 pm | September 11, 2024

রাইসুল ইসলাম খান, কালের আলো:

ডেঙ্গু নিয়ে আক্রান্ত এবং মৃত্যু নতুন করে শঙ্কা জাগাচ্ছে। এডিস মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গু মারাত্মকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে প্রত্যন্ত অঞ্চলেও। রাজধানী থেকে শুরু করে গ্রামের বাসিন্দাদের মাঝেও এ বিষয়ে বাড়তি সতর্কতা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব পরিমাপের স্বীকৃত পদ্ধতি ‘ব্রুটো ইনডেক্স’ (বিআই) বলে দিচ্ছে, গত বছরের তুলনায় চলতি বছর এডিস মশার লার্ভা এবং প্রাপ্তবয়স্ক মশা বেশি। এজন্য ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে পূর্ব প্রস্তুতি প্রয়োজন বলে মনে করেন কীটবিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, দুই মাস আগের থেকেই এই প্রস্তুতি নিতে হয়। এই মৌসুমে ডেঙ্গু বাড়বে। ইতোমধ্যে এই প্রভাব দেখা গিয়েছে আগামী কয়েকদিন আরও বাড়বে।

জানা যায়, ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা অতীতের সব রেকর্ড ভেঙেছে, সরকারি হিসাবে ১ হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যু হয়েছে ওই বছর। অথচ তার আগের বছর, ২০২২ সালে এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৮৬৮ জন। এক বছরের ব্যবধানে দ্বিগুণেরও বেশি বাড়ে মৃত্যুর হার। এবছর মৃত্যু ও আক্রান্তের হার কম, তবে গত কিছুদিন ধরে হাসপাতালে বাড়তে শুরু করেছে রোগীর সংখ্যা।

কীটতত্ত্ববিদরা জানান, ডেঙ্গু মৌসুম শুরুর অন্তত দুই মাস আগের থেকে প্রস্তুতি নিতে হয়। কিন্তু সম্প্রতি দেশে নানা অস্থিতিশীলতা বিরাজ করায় সেই প্রস্তুতি থেকে অনেকটাই পিছিয়ে পড়েছে রাজধানীর মশা নিধনের দ্বায়িত্বের থাকা ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। এদিকে মেয়র না থাকায় নতুন করে দ্বায়িত্ব নিয়েছেন প্রশাসকরা। অল্প সময়ের মধ্যে কতটুকু প্রস্তুতি নিতে পেরেছেন তারা তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, দেশে প্রথম ডেঙ্গুজরে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় ২০০০ সালে। পরে ধীরে ধীরে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে। ২০২৩ সালে দেশের ইতিহাসে সর্বাধিক মানুষ আক্রান্ত ও মারা যায়। চলতি বছর গেল ১৫ জুন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে তিন হাজার ২০৭ জন এবং মারা গেছেন ৪০ জন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম জানিয়েছে, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দেশে আরও পাঁচ জনের মৃত্যু হয়েছে। সোমবার (৯ সেপ্টেম্বর) সকাল ৮টা থেকে মঙ্গলবার (১০ সেপ্টেম্বর) সকাল ৮টার মধ্যে তাদের মৃত্যু হয়। এই বছর একদিনে সর্বাধিক মৃত্যু এটি। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ৯৭ জনের মৃত্যু হয়েছে। ওইদিন তাঁরা আরও জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ৫৩৪ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ বছর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৬ হাজার ২৮৫ জন। এছাড়া সারা দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে বর্তমানে ১ হাজার ৬৬৪ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি আছেন। এর মধ্যে ঢাকায় ৯৩৮ জন। ৭২৬ জন অন্যান্য বিভাগে রয়েছেন।

সূত্র জানায়, নতুন প্রশাসক নিযুক্ত হওয়ার পর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে মশকনিধন কার্যক্রম তদারকি করার জন্য কমিটি করা হয়েছে। ডিএনসিসি থেকে জানানো হয়, তদারকির জন্য বিভিন্ন বিভাগের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ১০টি অঞ্চলে ১০টি টিম গঠন করা হয়েছে। এসব টিম মশকনিধন কার্যক্রম চলাকালে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী স্বাস্থ্য কর্মকর্তার সঙ্গে সমন্বয়ে ১০টি অঞ্চলের আওতাধীন ওয়ার্ডে মশকনিধন কার্যক্রম তদারকির দায়িত্ব পালন করবে।

এছাড়া ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে জানানো হয়, এডিস মশার লার্ভা নষ্ট ও উড়ন্ত মশা নিধনে নিয়মিত লার্ভিসাইডিং (লার্ভা ধ্বংস) ও এডাল্টিসাইডিং (মশা ধ্বংস) করা হচ্ছে। এছাড়া স্বাস্থ্য অধিদফতর থেকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আওতাধীন এলাকায় বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ডেঙ্গু রোগীর যে তালিকা পাওয়া যায়, সেসব রোগীর ঠিকানা অনুযায়ী বিশেষ মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে।

বুধবার (১১ সেপ্টেম্বর) স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব এম এ আকমল হোসেন আজাদ বলেছেন, ডেঙ্গুর বিষয়ে আমরা সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিচ্ছি। ঢাকার বেশিরভাগ হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের জন্য আলাদা ডেডিকেটেড কর্নার করা হয়েছে। সেখানে তাদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। স্বাস্থ্য খাতের জনবলকে ডেঙ্গু বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদান করা হচ্ছে। বর্তমানে গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ডেঙ্গু পরিস্থিতি তুলনামূলকভাবে ভালো অবস্থায় আছে।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের শিক্ষক ও কীটতত্ত্ববিদ কবিরুল বাশার বলেন, এই মুহূর্তে সিটি করপোরেশনের জোরেসোরে কাজ করা দরকার। হট স্পট ম্যানেজমেন্ট, লার্ভা ম্যানেজমেন্ট, লার্ভা সোর্স ম্যানেজমেন্ট– এই তিনটা বিষয়ে এখন গুরুত্বের সঙ্গে কাজ করতে হবে। লোকবল কম থাকলে প্রয়োজনে অন্য জায়গা থেকে লোক এনে এই কাজগুলো করতে হবে।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে আলোচনার চেয়ে অ্যাকশনকে বেশি নজর উপদেষ্টার
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ বলেছেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধে আলোচনার চেয়ে অ্যাকশনকে বেশি নজর দিচ্ছি৷ ইতোমধ্যে দেশের সকল পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশনকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তারা সে অনুযায়ী কর্মপন্থা গ্রহণ করেছে।

তিনি বুধবার (১১ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তিকৃত ডেঙ্গু রোগীদের পরিদর্শন করতে গিয়ে উপস্থিত সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে এসব কথা বলেন।

হাসান আরিফ বলেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তিকৃত রোগীদের সাথে আমি কথা বলেছি৷ তারা ভালো চিকিৎসা পাচ্ছে। রোগীদের চিকিৎসা সংক্রান্ত কোন অভিযোগ নেই।

তিনি বলেন, গত ৮ সেপ্টেম্বর আমরা ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত অন্যান্য রোগ প্রতিরোধ বিষয়ক জাতীয় কমিটির সভা করেছি৷ সভা ফলপ্রসূ হয়েছে৷ ইতোমধ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে৷

তিনি আরও বলেন, ডেঙ্গু ছাড়াও ভর্তিকৃত রোগীরা টাইফয়েড, ডায়বেটিকসহ অন্যান্য রোগে আক্রান্ত। যার কারণে সুস্থ হতে স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত সময় লাগছে। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগে কর্মরত চিকিৎসক এবং নার্সরা আন্তরিকতার সাথে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা ডেঙ্গু পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে সক্ষম হবো।

এ সময় স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব আবু হেনা মোরশেদ জামানসহ হাসপাতালের উর্ধ্বতন কর্মকতারা তাঁর সঙ্গে ছিলেন।

কালের আলো/এমএএইচ/ইউএইচ