সংবাদপত্রের প্রকাশক ও সম্পাদকদের মিলনমেলায় গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের ঘোষণা তথ্য উপদেষ্টার

প্রকাশিতঃ 10:44 pm | September 23, 2024

রাইসুল ইসলাম খান, কালের আলো:

দেশের সংবাদপত্রের প্রকাশক, সম্পাদক, নির্বাহী সম্পাদকসহ জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভা। প্রথমবারের মতো এক অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাই। এ যেন এক মিলনমেলা। জাতীয় বা আঞ্চলিক সংবাদপত্র বলতে কোন বৈষম্য নেই। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলামের নির্দেশনায় দীর্ঘ দিনের চলমান বৈষম্য দূর করে নতুন এক নজির স্থাপন করলেন চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (চলতি দায়িত্ব) আবুল কালাম মোহাম্মদ শামসুদ্দিন। এ মতবিনিময় সভায় গুরুত্বপূর্ণ এক বার্তা দিয়েছেন তথ্য উপদেষ্টা। গণমাধ্যম সংস্কার কমিশনের ঘোষণা আগামী সপ্তাহেই আসতে পারে বলে আশা প্রকাশ করেছেন তিনি। তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম জানিয়েছেন, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতিসংঘ থেকে দেশে এলেই হয়তো ঘোষণাটি আসবে।

সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর) বিকেলে রাজধানীর সার্কিট হাউস রোডে চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের (ডিএফপি) উদ্যোগে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় তিনি এসব কথা বলেন। সভায় সম্পাদক ও সাংবাদিকেরা গণমাধ্যমের নানা সমস্যার কথা তুলে ধরে সেগুলো সমাধানের দাবি জানান। তাঁরা এ সময় স্বাধীন গণমাধ্যম কমিশন গঠনের দাবিও তুলেন।

এ প্রসঙ্গে তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আমরা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা চাই, অবশ্যই। কিন্তু আমি আপনাদের কাছে প্রশ্ন রেখে যেতে চাই, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সীমা কতটুকু? আমরা জানি, স্বাধীনতা মানে স্বাধীনতাই; এখানে কোনো নিয়ন্ত্রণ চলে না। কিন্তু গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলে বা স্বাধীনতার মাধ্যমে ফ্যাসিস্টদের প্রচারণা করা যাবে কি না। গণমাধ্যমের স্বাধীনতার কথা বলে ফ্যাসিস্টদের পারপাস সার্ভ (উদ্দেশ্য সাধন) করা যাবে কি না। সেই বিষয়টি আপনাদের কাছে প্রশ্ন রেখে গেলাম। আমরা আমাদের দেশ, আমাদের এই যে অভ্যুত্থান, সেটিকে প্রাধান্য রেখে, মানদণ্ড রেখে সব স্বাধীনতা কিন্তু নিশ্চিত করতে চাই।’

তথ্য উপদেষ্টা আরও বলেন, আমরা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে চাই; এটি কেবল মুখের কথা নয়, এটি কাজে বাস্তবায়ন করতে চাই। জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে গণমাধ্যমের ভূমিকার প্রশংসা করেন উপদেষ্টা। তিনি বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থান চলার সময় সংবাদপত্রের একটি ভালো ভূমিকা ছিল। একটা সময় সারা দেশের মানুষ সংবাদপত্রের ওপর নির্ভরশীল হয়ে উঠেছিল। কারণ, কিছুটা তথ্য পেলে পত্রিকাতেই পাওয়া যায়। তখন দেখা গেছে, ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম একেবারেই কুক্ষিগত, সেই সময়ে সংবাদপত্রই ছিল একমাত্র ভরসা।

এ জন্য তিনি ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানান। তবে উল্টো দিকও ছিল মন্তব্য করে নাহিদ ইসলাম বলেন, সংবাদকর্মীদের অনেকেই আন্দোলনের বিপক্ষেও ছিলেন। ফ্যাসিবাদের পক্ষে তাঁরা কাজ করেছেন। এ সময় নিজের আগের একটি বক্তব্য পুনরায় উল্লেখ করে তথ্য উপদেষ্টা বলেন, ফ্যাসিবাদের পক্ষে যাঁরাই কাজ করুন না কেন, গণহত্যাকে যাঁরাই উসকানি দিয়ে থাকুক না কেন, তাঁদের বিচার হবে। সাংবাদিক, কবি, সাহিত্যিক—এটা বিবেচনায় নেওয়া হবে না। আবার একই সঙ্গে কোনো সাংবাদিক বা যে কেউ, তাঁর সঙ্গে যদি অবিচার করা হয়, সেই বিষয়টিও দেখা হবে। কাউকে যদি এমন মামলা দেওয়া হয়, যে মামলায় আসলে অভিযুক্ত হওয়ার মতো নয়, সেই মামলাগুলো প্রত্যাহার করা হবে। যাঁর যতটুকু অভিযোগ, সেই অভিযোগের ভিত্তিতেই তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সাংবাদিকদের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে সর্বাত্মক চেষ্টার কথা জানিয়ে তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘ সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন ও বিল দেওয়ার পুরো ব্যবস্থা ডিজিটালাইজড করার প্রক্রিয়া চলছে।’

যুক্তিবোধ, মেধা ও প্রজ্ঞার অপূর্ব সমন্বয়ে পুরো অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (চলতি দায়িত্ব) আবুল কালাম মোহাম্মদ শামসুদ্দিন। এ সময় অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন তথ্য অধিদপ্তরের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা মো. নিজামূল কবীর, গণযোগাযোগ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আকতার হোসেন, বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক মো. মাহবুবুল আলম, বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম আবদুল্লাহ।

মতবিনিময় সভায় আরও বক্তব্য রাখেন মানবজমিন এর প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী, নয়া দিগন্তের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক সালাহ উদ্দিন মুহাম্মদ বাবর, জাতীয় প্রেসক্লাব সভাপতি ও কালের কণ্ঠ সম্পাদক হাসান হাফিজ, যুগান্তর সম্পাদক সাইফুল আলম, ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস সম্পাদক শামসুল হক জাহিদ, প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরীফ, আজকের পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক কামরুল হাসান, ডেইলি সানের সম্পাদক রেজাউল করীম লোটাস, প্রতিদিনের বাংলাদেশ সম্পাদক মুস্তাফিজ শফি, ইনকিলাবের নির্বাহী সম্পাদক ফাহিমা বাহাউদ্দিন শামা, সংগ্রামের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক নূরুল আমিন, ইত্তেফাকের বার্তা সম্পাদক অশোক কুমার সিনহা, সংবাদের প্রধান প্রতিবেদক সালাম জুবায়ের, ঢাকা মেইলের হেড অব নিউজ হারুন জামিল, ডেইলি স্টারের মিজানুর রহমান, আজাদীর ওয়াহিদ মালিক, জাগরণের মহিউদ্দিন লিটন, নওরোজ সম্পাদক শামসুল হক দুররানী, জাহাঙ্গীর হোসেন মঞ্জু প্রমুখ।

মতবিনিময় সভা প্রকারান্তরে মিলনমেলা
কার্যত এ মতবিনিময় সভাটি ঢাকা ও ঢাকার বাইরে থেকে আসা বিভিন্ন সংবাদপত্রের সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের মিলনমেলায় রূপ নেয়। ডিএফপির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এমন আয়োজনকে তাঁরা একটি দৃষ্টান্ত বলেও উল্লেখ করেন। জানতে চাইলে দৈনিক সন্ধানী বার্তার প্রধান সম্পাদক এবং দৈনিক আজকের ময়মনসিংহের সম্পাদক ও প্রকাশক মো.শামসুল আলম খান বলেন, ‘ছাত্র-জনতার রক্তস্নাত গণঅভ্যুত্থানের পর শান্তিতে নোবেলজয়ী প্রধান উপদেষ্টা ড.মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে পরিবর্তীত পরিস্থিতিতে ডিএফপিতেও সংস্কারের হাওয়া বইতে শুরু করেছে। আমরা এর সুফল দেখতে পাচ্ছি। এজন্য আমরা তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম এবং চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (চলতি দায়িত্ব) আবুল কালাম মোহাম্মদ শামসুদ্দিনকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। এমন অসাধারণ একটি আয়োজনের ফলে বিভিন্ন সংবাদপত্রের সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা নিজেদের মতামত তুলে ধরতে পেরেছেন। তথ্য উপদেষ্টাও ধৈর্য্যের সঙ্গে দীর্ঘ সময় নিয়ে তাদের মতামত গ্রহণ করেছেন। আমরা চাই এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। প্রকৃত অর্থেই ডিএফপি বদলে যাবে, সবাইকে বদলে দিবে।’

যেসব মতামত উপস্থাপন করলেন সম্পাদক ও সাংবাদিকরা
মতবিনিময় সভায় মানবজমিন-এর প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, সংবাদপত্রের সমস্যার সমাধান করতে চাইলে কমিশনের কোনো বিকল্প নেই। তিনি বলেন, আমি কখনও মফস্বলের পত্রিকা বলি না। সবই জাতীয় দৈনিক।

গণমাধ্যমের জন্য দীর্ঘদিন ধরেই ক্রান্তিকাল যাচ্ছে মন্তব্য করে যুগান্তর সম্পাদক সাইফুল আলম বলেন, খুব কষ্টের মধ্যে আছে গণমাধ্যম। বিশেষ করে করোনাকাল থেকে এর যাত্রা শুরু। প্রচারসংখ্যা, বিজ্ঞাপন ভাটির দিকে। সবাই মিলে গণমাধ্যমের জন্য একটি নীতিমালা করতে হবে।

কালের কণ্ঠ সম্পাদক হাসান হাফিজ বলেন, সংস্কার শুধু রাজনৈতিক ক্ষেত্রে করলে হবে না, এই চলচ্চিত্র ও প্রকাশনা অধিদপ্তরও অনেক প্রশ্নবিদ্ধ। এখানেও অনেক কারচুপি, প্রতারণা ও জালিয়াতি আছে বলে অভিযোগ আছে। এখানেও সংস্কার করতে হবে। ডিএফপি থেকে করা প্রচারসংখ্যা নিয়ে অভিযোগ করেন হাসান হাফিজ। তিনি এসব অনিয়ম দূর করার দাবি জানান।

প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ বলেন, সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমেও বনিয়াদি সংস্কার দরকার। সাইবার নিরাপত্তা আইনসহ সাংবাদিকতা বাধাগ্রস্ত করে, এমন আইনগুলোও সংস্কার করা উচিত। সংবাদপত্রের প্রচারসংখ্যার ক্ষেত্রেও স্বচ্ছতা আনা দরকার।

কালের আলো/আরআই/এমএএএমকে