নিষিদ্ধ পলিথিনের যথেচ্ছ ব্যবহার বন্ধে হার্ডলাইনে সরকার, বিকল্প সরবরাহে নজর পরিবেশ উপদেষ্টার

প্রকাশিতঃ 8:52 pm | September 24, 2024

রাইসুল ইসলাম খান, কালের আলো:

ঢাকাসহ সারা দেশের দোকান ও বাজারে হাত বাড়ালেই মিলছে পলিথিন। চাল, ডাল, লবণ, মাছ বা যেকোনো কিছু কিনলেই পলিথিনে ভরে ধরিয়ে দেওয়া হয় হাতে। অথচ এটি যে নিষিদ্ধ সেটিই যেন এক রকম ভুলতে বসেছেন সবাই। প্রশাসনের নাকের ডগায় বাজারগুলোতে দেদার বিক্রি হচ্ছে পলিথিন ব্যাগ। পলিথিন ব্যবহারে পরিবেশদূষণের মাত্রা যেমনি বেড়েছে তেমনি উর্বরতা শক্তিও নষ্ট হচ্ছে মাটির। মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে জীববৈচিত্র্য। অপচনশীল পলিথিন নিয়ন্ত্রণে সম্প্রতি জোর তৎপরতা শুরু করেছে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। সুপারশপের পর এবার কাঁচাবাজারেও পলিথিন ও পলিপ্রপাইলিনের তৈরি ব্যাগের যথেচ্ছ ব্যবহার বন্ধে হার্ডলাইনে রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন-পলিথিনের বিরুদ্ধে আগামী পহেলা অক্টোবর থেকে সুপারশপগুলোতে এবং কাঁচাবাজার ও পলিথিন উৎপাদন কারখানায় পহেলা নভেম্বর থেকে অভিযান শুরু হবে।

পাশাপাশি পলিথিনের বিকল্প হিসেবে সব সুপারশপে বা এর সম্মুখে পাট ও কাপড়ের ব্যাগ ক্রেতাদের কেনাকাটার জন্য রাখা হবে। এ লক্ষ্য বাস্তবায়নে তরুণ ও শিক্ষার্থীদের সম্পৃক্ত করতে চান উপদেষ্টা। ইতোমধ্যেই পলিথিন শপিং ব্যাগের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে তাঁর নেতৃত্বাধীন মন্ত্রণালয়। সব স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে তিনি সভাও করেছেন। জনসচেতনতা বিকাশে জাতীয় দৈনিকে গণবিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পাশাপাশি প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধের বিষয়টিও ব্যাপকভাবে প্রচারণার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। মঙ্গলবার (২৪ সেপ্টেম্বর) পলিথিন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর টাউন হল কাঁচাবাজারে ক্লিন-আপ কার্যক্রম উদ্বোধন ও বাজারে পলিথিনের বিকল্প সামগ্রী বিতরণ, বাজারে বিদ্যমান পলিথিন ব্যাগসহ অন্যান্য পলিথিনজাত প্যাকেজিং সংগ্রহের জন্য বিন ও স্থায়ী নোটিশ বোর্ড স্থাপন কাজের উদ্বোধনকালে এসব বিষয়ে কার্যকর দিকনির্দেশনা প্রদান করেছেন পরিবেশ উপদেষ্টা। বিশেষ নজর দিয়েছেন বিকল্প সরবরাহেও।

পরে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের টাউন হল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন কাঁচাবাজার বণিক সমিতির অফিসে পলিথিন শপিং ব্যাগ ব্যবহার বন্ধে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা নিয়ে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় নিজেদের বিভিন্ন সিদ্ধান্ত জানানোর পাশাপাশি আগামী পহেলা নভেম্বর থেকে পলিথিন উৎপাদনকারীদের বিরুদ্ধেও অভিযান চালানোর হুঁশিয়ারি দেন এই পরিবেশবিদ।

পলিথিন মাটিতে মিশে যেতে সময় লাগে ২০০ বছর
জানা যায়, ম্যানহোল, নালা, খাল, নদীতে পড়ে থাকা পলিথিন ব্যাগগুলো বৃষ্টি হলেই বিপত্তি ঘটায়। পানি নামার পথ রুদ্ধ থাকায় দেখা দেয় জলাবদ্ধতার সমস্যা। পলিথিন মাটিতে মিশে যেতে সময় লাগে কমপক্ষে ২০০ বছর। মাটিতে বা জলাশয়ে থাকা ব্যাগগুলো পরিবেশের জন্য কতটা ক্ষতির কারণ হয়েছে, তা নিয়ে পরিবেশবিদরা বহু বছর ধরেই কথা বলে আসছেন। যদিও পরিবেশ সংরক্ষণের স্বার্থে ২০০২ সালে পলিথিন শপিং ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করে সরকার। এছাড়া পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী পলিথিনে তৈরি সব ধরনের শপিং ব্যাগ উৎপাদন, আমদানি, বাজারজাতকরণ, বিক্রি ও বিক্রির জন্য প্রদর্শন, মজুত-বিতরণ নিষিদ্ধ। এর ব্যত্যয় হলে জেল-জরিমানার বিধান রয়েছে। অথচ এই আইন লঙ্ঘন করেই ঢাকাসহ সারা দেশের দোকান ও বাজারে সয়লাব পলিথিনের শপিং ব্যাগ। পলিথিন ব্যাগ মানুষের স্বাভাবিক জীবনের সঙ্গে পুরোপুরি মিশে যাওয়ায় কোনভাবেই ক্রেতা-বিক্রেতাদের হাত থেকে এই ক্ষতিকর পণ্য সরানো যায়নি।

পলিথিনে পরিবেশদূষণ বন্ধে বিগত সরকার থেকেছে উদাসীন। কিন্তু শুরু থেকেই এ বিষয়ে জোরালো উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি মনে করেন, সতর্ক করার এবং কঠোর হওয়ার সময় পার হয়ে গেছে। অভিযানের মাধ্যমেই তাই এই উপদেষ্টা শুরু করতে চান পলিথিনবিরোধী কার্যক্রম।

আলাপ-আলোচনা নয় প্রয়োগ হবে আইন
এদিন, রাজধানীর মোহাম্মদপুরের টাউন হল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন কাঁচাবাজার বণিক সমিতির অফিসে পলিথিন শপিং ব্যাগ ব্যবহার বন্ধে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা নিয়ে আয়োজিত মতবিনিময় সভায় পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, ‘কাঁচাবাজারগুলো যাতে আর পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার না করে, সেজন্য আমরা বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছি। এটা নতুন করে নিষেধ করার কিছু নেই। এটা ২০০২ সাল থেকে আইন করে নিষিদ্ধ করা আছে। ২০০৪-২০০৬ সাল পর্যন্ত সফলভাবেই প্লাস্টিক ব্যাগের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল। পলিথিন উৎপাদনকারী বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে অভিযান চালানো হয়েছিল। কিন্তু মার্কেটে কখনো অভিযান চালানো হয়নি। ফলে মার্কেটগুলো দেদারসে পলিথিন এনেছে এবং পলিথিনে পণ্য দিয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘পলিথিন ব্যাগগুলো রিসাইকেল করা যায়, কিন্তু সেটা সন্তোষজনক নয়। কারণ পলিথিন ব্যাগ বা অন্যান্য সামগ্রী থেকে মানুষের রক্তে, মস্তিষ্কে, লিভারে পলিথিনের অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছে। বাংলাদেশে পলিথিন দিয়ে মোড়ক করার কারণে লবণের মধ্যে পর্যন্ত মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের অনেক নদীর মাছের মধ্যে মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া যাচ্ছে। কাজেই প্লাস্টিক ব্যবহার করাই একটা ক্ষতিকারক বিষয়। সুতরাং এটাকে কালেক্ট করে রিসাইকেল হচ্ছে সর্বশেষ সমাধান, যেখানে আর কোনো বিকল্প থাকবে না।’

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা বলেন, আগামী ১ অক্টোবর থেকে ঢাকার সুপারশপগুলোতে প্লাস্টিক ও পলিপ্রপাইলিনের ব্যাগ আর ব্যবহার করা যাবে না। এটা সরকারের একক কোনো সিদ্ধান্ত নয়। এটি সুপারশপগুলোর ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এর বিকল্প হিসেবে পাট, কাপড় ও কাগজের ব্যাগ ব্যবহার করতে হবে। এজন্য বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনসহ ২০-২৫টি প্রতিষ্ঠান পাট, কাপড় ও কাগজের ব্যাগ তাদের সরবরাহ করবে। এরই মধ্যে সুপারশপগুলো তাদের চাহিদা দিয়েছে এবং তাদের চাহিদা অনুযায়ী ব্যাগের যোগানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান আরও বলেন, সুপারশপের পাশাপাশি আমরা আগামী ১ নভেম্বর কাঁচাবাজারগুলোতে পলিথিন ও পলিপ্রপাইলিনের ব্যাগ ব্যবহার বন্ধে কার্যক্রম শুরু করব। সেটি আজকের মতো আলাপ-আলোচনা নয়, আইন প্রয়োগ করা হবে। দোকান-মালিক সমিতির নেতারাও আমাদের কথা দিয়েছেন, এক মাসের মধ্যে তারা পলিথিনের পরিবর্তে পাট, কাপড় বা কাগজের ব্যাগ ব্যবহার শুরু করবেন।

তিনি আরও বলেন, পলিথিন বা পলিপ্রপাইলিনের ব্যাগ ব্যবহারে যে নিষেধাজ্ঞা আছে, সেটি কার্যকর করতে আগামী ১ অক্টোবর সুপারশপে এবং ১ নভেম্বর কাঁচাবাজারগুলোতে কাজ শুরু করতে যাচ্ছি। একই সঙ্গে পলিথিন যেখানে উৎপাদন করা হয়, ১ নভেম্বর থেকে সেখানে আমরা আমাদের অভিযান চালাব। সবাই পর্যাপ্ত সময় পাচ্ছেন। আমরাও বিকল্প সরবরাহের জন্য কাজ করছি।

আমরা অভিযান দিয়ে একটি তিক্ত পরিস্থিতি নিয়ে কাজ শুরু করতে চাই না। সবাইকে বুঝতে হবে, পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার ক্ষতিকর। এটা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। এ নিয়ে আমাদের সতর্ক, সচেতন ও উদ্যোগী হওয়ার সময় পার হয়ে গেছে। আমরা বরং দেরিতে শুরু করলাম। আমরা আইন করে আইনটা প্রয়োগ করলাম না- যোগ করেন উপদেষ্টা।

কালের আলো/আরআই/এমএএএমকে