মেধাবী সেনা কর্মকর্তা তানজিমের মৃত্যুতে শোকগাথা
প্রকাশিতঃ 11:45 pm | September 25, 2024

এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, অ্যাকটিং এডিটর:
দায়িত্ব পালনের সময় কক্সবাজারের চকরিয়ায় ডাকাতের ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারিয়েছেন শহিদ লেফটেন্যান্ট তানজিম ছারোয়ার নির্জন। চেনা জানা ভূমণ্ডল ছেড়ে চলে গেছেন না ফেরার দেশে। মৃত্যুর হিমশীতল স্পর্শে থেমে গেলো তাঁর জীবনের স্পন্দন। অনাকাঙ্খিত ও মর্মান্তিক এই মৃত্যুতে দিশেহারা তাঁর পরিবার। রুদ্ধবাক বাবা সারোয়ার জাহান। ক্ষণে ক্ষণে মুর্চ্ছা যাচ্ছেন মা নাজমা বেগম। গভীর মর্মবেদনা আর শোকাচ্ছন্ন তাঁর সহকর্মীদের হৃদয়। প্রিয় মাতৃভূমির জন্য তরুণ এই মেধাবী সেনা কর্মকর্তার আত্মত্যাগের কীর্তি জ্বলন্ত। শোকাহত আঙুলের ফাঁকে বেদনার্ত অনুভূতির মিশেলে শোকগাথা ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও।
তাঁর আত্মত্যাগ একটি সুখী ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমাদের সংকল্পবদ্ধ হয়ে আত্মনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে
ড.মুহাম্মদ ইউনূস
প্রধান উপদেষ্টা
অন্তর্বর্তী সরকার
শোকস্তব্ধ এসব মানুষের ভাষাও শোকাহত। আবার অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতেও সোচ্চার তাঁরা। ইতোমধ্যেই সেনাবাহিনী এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছয় জনকে আটক করেছে। আচমকা এই মৃত্যুতে কাঁদছে দেশ। শোকাভিভূত প্রধান উপদেষ্টা ড.মুহাম্মদ ইউনূস থেকে শুরু করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানসহ সশস্ত্র বাহিনীর সর্বস্তরের সদস্যরা। তাঁরাও প্রকাশ করেছেন বেদনার্ত অনুভূতি। শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি জানিয়েছেন গভীর সমবেদনা। গর্বিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রতিটি সদস্যের মাঝে তাঁর স্মৃতি বেঁচে থাকবে চিরদিন।
মৃত্যু অমোঘ, চিরন্তন বাস্তবতা। প্রতিটি আত্মাকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে এটিই স্বাভাবিক। তবে সেই মৃত্যু যদি হয় হত্যাকাণ্ড; তবে এটিকে খুব সহজে গ্রহণ করা এতোটা সহজ বা স্বাভাবিক নয় মোটেও। একজন মানুষের মৃত্যু ধ্বংস করে দিতে পাওে গোটা পরিবারকে। যিনি মৃত্যুবরণ করলেন তিনি জানতেও পারলেন না তাঁর মৃত্যুতে পরিবার কী অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করছেন বা করবেন! বাষ্পরুদ্ধ হাহাকারে হতভাগ্য বাবা সারোয়ার জাহান তাই বলছিলেন-‘এমন মৃত্যু যেন আর কারও না হয়।’
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাঁর জন্য গর্বিত
জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান
টাঙ্গাইলের সন্তান লেফটেন্যান্ট তানজিম ছারোয়ার নির্জন পাবনা ক্যাডেট কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে ৮২তম দীর্ঘমেয়াদি কোর্সের সঙ্গে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি থেকে ২০২২ সালের ৮ জুন আর্মি সার্ভিস কোরে (এএসসি) কমিশন লাভ করেন। জীবন উদযাপনের মন্ত্রে থিতু হওয়ার আগেই দেশের জন্য দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে জীবন উৎসর্গ করতে হয়েছে তাকে। অশ্রুসিক্ত স্বজন-সহকর্মীরা মঙ্গলবার (২৪ সেপ্টেম্বর) শেষ বিদায় জানান তাকে। ওইদিন সেনাবাহিনীর ১৯ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি ও ঘাটাইলের এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল হুসাইন মোহাম্মদ মাসীহুর রহমান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘এ ঘটনায় আমরা সেনাবাহিনী খুবই মর্মাহত। আমরা আমাদের একজন সহকর্মীকে হারিয়েছি। আমরা তার পরিবারের প্রতি শোক প্রকাশ করছি। বাংলাদেশ আইন অনুযায়ী আসামিদের সর্বোচ্চ শাস্তির আওতায় আনা হবে।’
দেশের অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার মূর্ত প্রতীক বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে নন্দিত নাম বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী। সরকারের নির্দেশে পাহাড়ে নানামুখী মানবিক কর্মযজ্ঞে নিয়োজিত থাকার পাশাপাশি সেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদী অপতৎপরতা বারবার রুখে দিয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অকুতোভয় সদস্যরা। ঝুঁকি নিয়ে আবার কখনও জীবন দিয়ে দেশপ্রেমিক সেনা সদস্যরা নিরীহ পার্বত্য জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা রক্ষায় তৎপর থেকেছেন অহর্নিশ। নি:স্বার্থ মানসিকতার উদাহরণ তৈরি করে দায়িত্ব পালন থেকে কখনও পিছপা হয়নি। ঠিক তেমনি কক্সবাজারের চকোরিয়ায় ডাকাতির হাত থেকে স্থানীয় বাসিন্দাদের রক্ষায় বুকের রক্ত দিয়ে তরুণ সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট তানজিম ছারোয়ার নির্জন প্রমাণ করলেন দেশে শান্তি ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় সেনাবাহিনী বদ্ধপরিকর।
মেধাবী সেনা কর্মকর্তা নির্জনের চিরস্থায়ী শুন্যতায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেউ কেউ লিখেছেন-‘বাংলাদেশ একজন সাহসী সেনা কর্মকর্তাকে হারালো। এ ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয়।’ কোন কোন মন্তব্যে তাকে ‘প্রকৃত হিরো’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে- ‘দেশের শান্তি ও সার্বভৌমত্ব রক্ষায় আপনার এই ত্যাগ জাতি বিনম্র চিত্তে আজীবন স্মরণ করবে। যারা দেশের কল্যাণে প্রাণ দেয় তারা কখনও মরে না, তারা বেঁচে থাকে মানুষের অন্তরে।’
দেশমাতৃকার সেবায় তরুণ সাহসী এই সেনা কর্মকর্তার আত্মত্যাগ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করবে এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনী তাঁর জন্য গর্বিত বলে জানান সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। গত মঙ্গলবার (২৪ সেপ্টেম্বর) ২৪ পদাতিক ডিভিশন ও চট্টগ্রাম এরিয়া এবং বুধবার (২৫ সেপ্টেম্বর) ৩৩ পদাতিক ডিভিশন ও কুমিল্লা এরিয়া পরিদর্শনকালে সেনাপ্রধান নিজের বক্তব্যের শুরুতেই লেফটেন্যান্ট তানজিম ছারোয়ার নির্জনের মৃত্যুতে তাঁর মাগফেরাত কামনা করেন এবং শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
‘প্রিয় মাতৃভূমির প্রয়োজনে সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট তানজিম ছারোয়ার নির্জন মহান আত্মত্যাগ করেছেন’ বলে মনে করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি নিহত সেনা কর্মকর্তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করেন এবং তার পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে এক শোক বার্তায় বলেছেন, তাঁর আত্মত্যাগ একটি সুখী ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ বিনির্মাণে আমাদের সংকল্পবদ্ধ হয়ে আত্মনিয়োগের ক্ষেত্রে প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।’ মঙ্গলবার (২৪ সেপ্টেম্বর) প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব গণমাধ্যমে পাঠানো শোক বার্তায় এ তথ্য জানান।
শোক বার্তায় প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘কক্সবাজারের চকরিয়ায় দুর্বৃত্তদের হামলায় লেফটেন্যান্ট তানজিম ছারোয়ার নির্জনের মৃত্যুতে আমি গভীর শোক প্রকাশ করছি এবং তার বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। তার পরিবারের সদস্যদের প্রতি আমি আন্তরিক সমবেদনা জানাই। একই সঙ্গে সমবেদনা জানাই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর আমার সব সহকর্মীর প্রতি। বাংলাদেশের শান্তি, শৃঙ্খলা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার অতন্দ্র প্রহরী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই তরুণ ও মেধাবী কর্মকর্তা মানুষের জান-মাল রক্ষার্থে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেছেন। দেশপ্রেমের আদর্শের নজির হিসেবে তার এ আত্মত্যাগ জাতি চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।’
ড. ইউনূস বলেন, ‘নির্জনের মৃত্যুর ঘটনাটি এমন এক সময়ে সংঘটিত হয়েছে যখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী ‘ইন এইড টু সিভিল পাওয়ার’-এর আওতায় জনমানুষের নিরাপত্তা বিধানে দেশব্যাপী দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছে। দুর্বৃত্তদের হামলায় তার এ অকাল মৃত্যু শুধু সেনাবাহিনীর জন্য নয় বরং দেশের জন্যও এক অপূরণীয় ক্ষতি।’
আকাশের রহস্যময় দিগন্ত পেরিয়ে স্বপ্নময় অন্তরীক্ষে শহিদ লেফটেন্যান্ট তানজিম ছারোয়ার নির্জন। আশ্বিনের বিষণ্নতা-ভরা মায়াবী প্রকৃতিতে মৃত্যুর অমোঘ পদচিহ্ণে মাত্র ২৩ বছরের জীবনের দাঁড়ি টেনে তিনি চলে গেলেন চিরতরে। দেশের জন্য জীবন দিয়ে স্থাপন করে গেলেন দৃষ্টান্ত। জৈবিক অর্থে তিনি চলে গেলেও চৈতন্যের অনুভবে তাকে বার বার খুঁজে পাওয়া যাবে দেশপ্রেমিক প্রতিটি সেনা সদস্যের হৃদয়ের অতলান্তিক মহাসাগরে। কবিগুরুর সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে তাই সবাই বলছেন- ‘তোমায় হৃদ মাঝারে রাখব ছেড়ে দিব না।’
কালের আলো/এমএএএমকে