প্রধান উপদেষ্টা ও সেনাপ্রধানের সুচিন্তিত বক্তব্যে বেড়েছে আস্থা-বিশ্বাস

প্রকাশিতঃ 12:38 am | September 28, 2024

এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, সম্পাদক:

ক্ষমতা কারও চিরস্থায়ী জমিদারি নয়। ছাত্র-জনতার রক্তঝরা গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার রেজিমের অবসানের পর চিরন্তন এই সত্য আবারও মোটাদাগে প্রতীয়মান হয়েছে। দেশের মানুষের বিপুল প্রত্যাশার মাঝে গত ৮ আগস্ট তিন দিনের শুন্যতা কাটিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস এর নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। দীর্ঘ সময় অপরাজনীতির যাঁতাকলে পিষ্ট দেশের মানুষের স্বপ্নপূরণের পথে শুরু হয় নবযাত্রা। পরবর্তী নির্বাচনের জন্য যুক্তিসঙ্গত সময় চেয়ে তাদের অদম্য পথযাত্রা রাজনীতির আকাশে ঘন কালো মেঘ সরিয়ে উন্মুক্ত করেছে সম্ভাবনার নতুন দিগন্ত।

জাতিকে একতাবদ্ধ করে গণতন্ত্র উত্তরণে নিজের আন্তরিকতা, সক্রিয়তা, উপযোগিতা, মনোবল ও সৃজনশীলতা বজায় রেখে জাতির কাণ্ডারি ড.ইউনূস কাজ করে চলেছেন প্রতিনিয়ত। এক্ষেত্রে তাকে পূর্ণ সহযোগিতা করছেন জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এর নেতৃত্বে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। তিনি দৃঢ়চিত্তে বারবার বলেছেন, কোন অবস্থাতেই এই সরকারকে ব্যর্থ হতে দেওয়া যাবে না। তাঁরা এক সঙ্গে থাকলে ব্যর্থ হওয়ার সুযোগ নেই। ড.ইউনূস যেন সফলভাবে তাঁর মিশন সম্পন্ন করতে পারেন সেজন্য তাঁর সর্বাত্মক সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে। তাদের মিলিত প্রয়াস প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে দ্রুত ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন উপহার দিতে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে সুন্দর ও কলুষিত মুক্ত করার পথ দেখাচ্ছে।

একটি দেশে গণতন্ত্রের মূল কথা হলো, জনগণের প্রতিনিধি নির্বাচন বা বাছাইয়ের অবাধ স্বাধীনতা। আর বাংলাদেশের গণতন্ত্রের সংজ্ঞা হয়ে দাঁড়িয়েছে- জনগণের দ্বারা ‘আমাদের’ জন্য ‘আমাদের’ শাসন। কিন্তু চিরায়ত এই প্রথা ভেঙে জনগণের জন্য জনগণের দ্বারা জনগণের শাসন উপহার দিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ অন্তর্বর্তী সরকার। ইতোমধ্যেই অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বহুত্ববাদী গণতন্ত্রে উত্তরণ নিশ্চিত করতে এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবেশ তৈরিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হিসেবে নিজের দৃঢ় প্রতিশ্রুতির কথা জানান দিয়েছেন ড.ইউনূস। এতে আশাবাদী দেশের রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরা।

তবে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও সময় নিয়ে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছ থেকে একটি রোডম্যাপ চান বিভিন্ন দলগুলোর নীতিনির্ধারকরা। সম্প্রতি সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এর দেওয়া বক্তব্যে আশ্বস্তও হয়েছেন তাঁরা। নির্বাচন নিয়ে তাদের বক্তব্যকে ইতিবাচক হিসাবে দেখছেন সবাই। বিশেষ করে বাংলাদেশের পুনর্জন্ম এবং পুনরারম্ভে তাদের পৃথক পৃথক দায়িত্বশীল ও সুচিন্তিত শব্দচয়ন মানুষকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। আস্থা ও বিশ্বাস বাড়িয়েছে বহুগুণে।

অন্তর্বর্তী  সরকারের পক্ষ থেকে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় নিয়ে একটি ন্যুনতম ধারণা মিলেছে। নিউইয়র্কে গত মঙ্গলবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভার সঙ্গে এক বৈঠকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, দেশের সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছে ভোটার তালিকা তৈরি হয়ে গেলে নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হবে। এর আগে গত সোমবার আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান যে কোনো পরিস্থিতিতে ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারকে সমর্থনের অঙ্গীকারের কথা জানান। ওই সাক্ষাৎকারে তিনি ১৮ মাসের মধ্যে যাতে নির্বাচন হতে পারে, সেজন্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলো সম্পন্ন করতে এ সরকারকে সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দেন। প্রধান উপদেষ্টা ও সেনাপ্রধানের এ বক্তব্যে নির্বাচনের সময় নিয়ে স্পষ্ট আভাস পাওয়ায় উচ্ছ্বসিত রাজনীতিকরা।

ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুছ আহমাদ একটি গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপে বলেছেন, ‘দেশের দুই শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তি কথার মধ্যে তেমন একটা তফাত নেই। আমরাও বলে আসছি প্রয়োজনীয় সংস্কার আগে, নির্বাচন পরে। কারণ, যেনতেন কায়দায় নির্বাচন হলে তা ভালো ফল বয়ে আনবে না। এজন্য সংস্কারে সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে সেটিকে আমরা সাধুবাদ জানাই।’

একই রকম কথা বলেছেন গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ও সেনাবাহিনী প্রধানের বক্তব্যে দেশবাসী আশ্বস্ত হয়েছে। নির্বাচনের জন্য এক থেকে দেড় বছর লাগবে বা সময়টা কী হবে, তা সরকারের সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে নির্ধারণ জরুরি। নির্বাচন কমিশনই এখন পর্যন্ত গঠিত হয়নি। নির্বাচনি ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তনসহ অনেক গণতান্ত্রিক সংস্কার করা অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। সেই কাজগুলো করার সঙ্গে নির্বাচন করাটা জড়িত।’

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘গত ৫ আগস্টের পর দেশে যে ক্রাইসিস, সেখানে সেনাবাহিনীর ভূমিকা অতুলনীয়। আমরা একটা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলাম, আমাদের সেনাপ্রধান তার বক্তব্যে বলেছেন, ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচন যাতে হতে পারে, এটা আমাদের জন্য একটা ইতিবাচক দিক। কতদিন লাগতে পারে, কী হতে পারে-এসব প্রশ্ন কাজ করছিল, সেখানে একটা গাইডলাইন পেয়েছি। আর প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যকেও ইতিবাচকভাবে দেখি। নির্দিষ্ট তারিখটা কবে হবে, সেজন্য কিছু হোমওয়ার্ক আছে, কিছু সংস্কার আছে-এসব গুরুত্বপূর্ণ। ভোটার হালনাগাদ খুব একটা কঠিন ব্যাপার না। কারণ, সব ডিজিটালাইজড। আমার মনে হয় দেড় বছরের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব। তারিখ তো সরকারই দেবে, নির্বাচন কমিশনই দেবে। নতুন নির্বাচন কমিশনও তো নিতে হবে। কিছু কাজ তো আছেই।’

গণতন্ত্রের সার কথা হলো সমঝোতা, আলোচনা এবং সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। পতিত সরকারের রাজনৈতিক নেতৃত্ব কখনোই এসব বিষয়কে আমলে নেননি। জনগণ যাকে পছন্দ করবে, ভোট দেবে, তাঁরাই নির্বাচিত হবে, এ তত্ত্বের বিপরীতে পথ হেঁটে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটিকেই অকার্যকর ও অপাঙেক্তয় করে ফেলেছেন। উদগ্র ক্ষমতালিপ্সায় তাঁরা উল্টে দেন গণতন্ত্রের মহান স্বপ্ন। ‘রাষ্ট্রের চেয়ে দল বড়, দলের চেয়ে ব্যক্তি বড়’তে পরিণত হয় সেই সময়। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড.মুহাম্মদ ইউনূস ও সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ক্ষমতার প্রতাপ, শক্তির দম্ভ ও অহমিকায় বিশ্বাসী নন। তাদের কাছে গণতন্ত্র মানেই সহযোগিতার, সৌহার্দ্যের—তাঁরা এই মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখতে বদ্ধপরিকর।

আর এ কারণেই সম্ভবত দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনীকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখতে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতার মধ্যে ভারসাম্য চান সেনাপ্রধান। বর্তমান সঙ্কটময় মুহুর্তে দেশের ভালো-মন্দ, মঙ্গল-অমঙ্গল দেশের এই দু’শীর্ষ ব্যক্তির ওপর অনেকটাই নির্ভর করছে। তাদের বিচার-বিবেচনা, যুক্তিবাদিতা, দায়িত্বশীলতা ও দূরদর্শিতায় সুদৃঢ় হতে পারে রাষ্ট্রের ভিত্তি। সেই লক্ষ্যপূরণেই তাঁরা কাজ করছেন এবং সফলও হবেন বলেই মনে করেন বিশ্লেষকরা। দেশের রাজনীতিকদের সহযোগিতায় তাদের বিচার-বিবেচনা, যুক্তিবাদিতা, দায়িত্বশীলতা ও দূরদর্শিতায় সুদৃঢ় হতে পারে রাষ্ট্রের ভিত্তি। সেই লক্ষ্যপূরণেই তাঁরা কাজ করছেন এবং সফলও হবেন বলেই মনে করেন বিশ্লেষকরা।

কালের আলো/এমএএএমকে