প্রধান উপদেষ্টা ও সেনাপ্রধানের দ্বন্দ্বের কল্পকাহিনী; সংঘবদ্ধ অসত্য তথ্যে রাতভর গুজবের মহামারি

প্রকাশিতঃ 12:03 am | October 10, 2024

এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, অ্যাকটিং এডিটর:

আবারও গুজবের এক রাত পার করলো ছাত্র-জনতার রক্তক্ষয়ী ও অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানে দ্বিতীয় স্বাধীনতার স্বাদ পাওয়া বাংলাদেশ। এবারও গুজব আর অসত্য তথ্যে অপপ্রচারের লক্ষ্যবস্তু অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড.মুহাম্মদ ইউনূস। সঙ্গে পুনরায় ‘টার্গেট’ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ও তাঁর নেতৃত্বাধীন দেশপ্রেমিক বাহিনীটি। দেশের সরকারপ্রধান ও সেনাপ্রধানকে ঘিরে কথিত দ্বন্দ্বের কল্পকাহিনী আর অগণিত অপতথ্যে মঙ্গলবার (০৮ অক্টোবর) রাতভর সোশ্যাল মিডিয়ায় বয়ে গেছে গুজবের বন্যা। বিশেষ করে সেদিন রাত ৯টার পর থেকে ‘প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সেনাপ্রধানের ‘দ্বন্দ্ব’, প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায় সেনা সদস্যদের ‘অনুপ্রবেশ’ এবং ড.মুহাম্মদ ইউনূসের সময় ‘ফুরিয়ে আসার’ মত আষাড়ে গল্পের কাহিনী ফেসবুকের সয়লাব হয়ে যায়। এসব নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় এক রকম উত্তেজনা তৈরি হয়।

  • পুরোনো ভিডিও ব্যবহার করে ছড়ানো হয়েছে গুজব
  • অসত্য ও বিভ্রান্তিকর বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ‘রিউমার স্ক্যানার’
  • দেশপ্রেমী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে স্বার্থান্বেষী মহলের অপচেষ্টা
  • সত্যের চেয়ে মিথ্যার কাটতি বেশি; বাস্তবতার চেয়ে গুজবের চল বেশি
  • অসৎ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এসব মিথ্যাচার ও অপপ্রচার

দেশের বিভিন্ন স্বনামধন্য গণমাধ্যমের আদলে ফটোকার্ড বানিয়ে কিংবা ভুল বানানে সংঘবদ্ধ মতলববাজদের অসত্য তথ্যে রাতভর চলে গুজবের মহামারি। অনেকেই বুঝে না বুঝে এসব কার্ড ফেসবুকে পোস্ট ও শেয়ার করেছেন। বুধবার (০৯ অক্টোবর) দিনমান গুজবের আঁতুড় ঘরে রূপ নেয় সোশ্যাল মিডিয়া। শুধু তাই নয়, গত ৯ সেপ্টেম্বর পাসপোর্ট ফেরতের দাবিতে ইতালির দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভকে প্রধান উপদেষ্টার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার সামনে সেনা সদস্যদের জড়ো হওয়ার ভিডিও বলে চালিয়ে দেওয়ার দৃশ্য জালিয়াতির নির্লজ্জ কসরতেরও প্রমাণ পেয়েছে ভুয়া খবর, মিথ্যা ও ভুল তথ্য খণ্ডনকারী স্বাধীন বাংলাদেশি ফ্যাক্ট চেকিং ওয়েবসাইট ‘রিউমার স্ক্যানার’। তাঁরা বলেছেন, একটি পুরোনো ভিডিও ব্যবহার করে প্রধান উপদেষ্টার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার সামনে সেনা সদস্যরা জড়ো হয়েছেন বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছেন বলে গুজব ছড়ানো হয়েছে। বিষয়টি অসত্য ও বিভ্রান্তিকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। পরে রাতে এ নিয়ে বিস্তারিত এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে ‘রিউমার স্ক্যানার’।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংও এমন সব ভুয়া পোস্টকে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়েছে। প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব অপূর্ব জাহাঙ্গীর বলেছেন, ‘এটা একেবারেই গুজব। সবকিছু ঠিক আছে।’ একই বিষয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া গুজব সম্পর্কে উপহাস করেছেন যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূইয়া। বুধবার (০৯ অক্টোবর) সকালে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে একটি পোস্টে তিনি লিখেন-‘শুধু চেয়ারই না, প্রধান উপদেষ্টাসহ দেশ ছাড়লেন বাকি উপদেষ্টারাও। সোর্স : চালাইদেন।’ কোনো তথ্য যাচাইবাছাই না কওে সোশ্যাল মিডিয়ায় চালিয়ে দেওয়ার বিষয়টি বুঝাতে গিয়ে তিনি ওই গুরুত্বপূর্ণ শব্দবন্ধটি ব্যবহার করেন।

ছাত্র-জনতার রক্তস্নাত গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর গত দুই মাসে অন্তর্বর্তী সরকার ও দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতীক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে নানা ধরনের গুজব মোকাবিলা করতে হচ্ছে। ফেসবুক-ইউটিউব থেকে শুরু করে সামাজিক মাধ্যমে কখনো কখনো চটকদার স্লোগানে মিথ্যার বেসাতির মাধ্যমে ভুয়া ফটোকার্ড আর মনগড়া গালগপ্পে ভিত্তিহীন তথ্য ছড়ানো হচ্ছে দেদার। কোটা সংস্কার থেকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেওয়ার পর ছাত্র-জনতার পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে দেশপ্রেমী বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। তৎকালীন সরকারের সহিংস ভূমিকায় লাশ আর বারুদের গন্ধে আরও রক্তবন্যা ঠেকাতে ছাত্র-জনতার গৌরবজনক লড়াইয়ের সামষ্টিক চেতনাকে হৃদয়ঙ্গম করে ঐতিহাসিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। হিমালয়সম সাহস নিয়ে তিনি নতুন উষার অভ্যুদয়ে তাদের পাশে দাঁড়ান। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড.মুহাম্মদ ইউনূস নিজেও সেনাবাহিনীর ভূমিকার প্রশংসা করেছেন কৃতজ্ঞচিত্তে। তিনি সম্প্রতি বলেছেন, ‘দেশের ক্রান্তিলগ্নে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশের মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করে দেশকে এক অস্থিতিশীল পরিস্থিতির হাত থেকে রক্ষা করেছে। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আবারও দেশের মানুষের কাছে আস্থার প্রতীক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।’

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিজেদের কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বারবার প্রমাণ করেছে তাদের কোন রাজনৈতিক উচ্চভিলাষ নেই। দেশের পক্ষে, দেশের মানুষের পক্ষে তাঁরা নিবেদিতপ্রাণ। দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার প্রশ্নে আপোসহীন। সেনাপ্রধান নিজেও রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষে নিজেদের শক্ত অবস্থানের বিষয়টি পরিস্কার করেছেন। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন, এ সরকারকে সফল করতে তাদের সব রকমের সমর্থন অব্যাহত থাকবে। প্রধান উপদেষ্টা ড.ইউনূস ও তাঁর মধ্যকার সুন্দর ও চমৎকার সম্পর্কের কথাও জানিয়েছেন। মূলত দেশের এ দু’শীর্ষ ব্যক্তিত্বের গভীর হৃদ্যতার মধুরতম প্রকাশ মেনে নিতে না পারা একটি চক্র মিথ্যা-ঊন-অতিরঞ্জিত-বিভ্রান্তিকর তথ্যের পসরা সাজিয়ে গুজবের বিষাক্ত ডালপালা ছড়িয়ে দিচ্ছে।

দৈনিক সন্ধানী বার্তার প্রধান সম্পাদক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মো.শামসুল আলম খান দেশপ্রেমী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে স্বার্থান্বেষী মহল এমন অপপ্রচার চালাচ্ছে বলে মনে করেন। ইসলামে গুজবের কোনো স্থান নেই এবং এ বিষয়টি ইসলামে খুবই গর্হিত কাজ হিসাবে চিহ্নিত বলেও জানান তিনি। এসব গুজবের পেছনে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের চেয়ে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকেই দায়ী করেন এই বিশ্লেষক। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সামাজিক মাধ্যমে গুজব ছড়ায় কথাটি ঠিক। কিন্তু সামাজিক মাধ্যম তো নিজে নিজে মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য তৈরি করে না। সে আধার মাত্র। কোন ব্যক্তিবিশেষ বা গোষ্ঠী গুজব বা অপতথ্য ছড়িয়ে দেয়। এসব ক্ষেত্রে তাঁরা এমন চটকদার শিরোনামের ব্যবহার করে যে দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়ারও সুযোগ নেই। একটি ভিডিও বা ছবি অন্যের তথ্যের গায়ে জুড়ে দিয়ে হাঁসজারু বানানো হয়। বেশিরভাগ সময়েই অসৎ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বা কোন সম্মানিত মানুষকে অসম্মানিত ও হেনস্তা করার উদ্দেশ্যে মিথ্যাচার, মানহানি ও অপপ্রচার করা হয়। এসব বিষয়ে আমাদের প্রয়োজনীয় জ্ঞান না থাকার কারণে আমরা বিভ্রান্ত হচ্ছি একদিন-প্রতিদিন। এজন্য আমাদের গণসচেতনতা দরকার। সুতীব্র প্রয়োজন গণনজরদারি।’

বিশ্লেষকরা বলছেন, সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে সত্যের চেয়ে মিথ্যার কাটতি বেশি। বাস্তবতার চেয়ে গুজবের চল বেশি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকার ও সেনাবাহিনীকে ঘিরে নেতিবাচক অপতথ্যে জেরবার করার অপপ্রয়াস প্রতিনিয়ত বাড়বাড়ন্ত হচ্ছে। দেশপ্রেমিক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উজ্জ্বল ভাবমূর্তি ও সুনাম ক্ষুণ্ন করতে পরিকল্পিতভাবে এসব অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। প্রযুক্তির ব্যবহারে অনেক ক্ষেত্রে কৃত্রিম অ্যাকাউন্ট তৈরি করে মানুষ সেজে গুজব ও মিথ্যা ছড়ানোর কাজও চলছে। প্রত্যেকেই যদি গুজবে বিশ্বাস না করে নিজ নিজ জ্ঞানের মূল্য দিতে পারেন তবেই মঙ্গল। নিজ জ্ঞানই উত্তর দিতে পারে কোনটা গুজব আর কোনটা ঠিক। কাজেই নিজ জ্ঞানের সঠিক ব্যবহার করতে হবে। সেটাই হবে গুজবে কান না দেওয়ার একমাত্র উপায়। নয়তো নাগরিক কবি শামসুর রাহমানের ‘পণ্ডশ্রম’ কবিতার চিল বারবার আমাদের কান নিয়ে যাবে। একবারও নিজ কান ঠিক জায়গায় আছে কি না, সেটা হাত দিয়ে দেখব না।’

কালের আলো/এমএএএমকে