সরকার ও সেনাবাহিনীর সম্মিলিত প্রয়াসে পোশাক শিল্পে কর্মচাঞ্চল্যে স্বস্তির নি:শ্বাস

প্রকাশিতঃ 10:52 pm | October 17, 2024

এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, অ্যাকটিং এডিটর, কালের আলো:

শান্তিতে নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ ড.মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর পুরোদমে অস্থিরতা শুরু হয় পোশাক শিল্পে। আজ এখানে, কাল সেখানে গণ্ডগোল পাঁকে। একেকদিন একেক কারখানার শ্রমিকরা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে বের হয়ে যান। সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক অসন্তোষে স্থবির হয়ে পড়ে উৎপাদন। আইন-শৃঙ্খলার অবনতিতে বন্ধ হয়ে যায় অনেক কারখানা। প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে কলকাঠি নাড়তে থাকে বহিরাগতরা। ১৮ দফা দাবি তোলা হয় শ্রমিকদের পক্ষ থেকে। ছড়িয়ে দেওয়া হয় নানাবিধ গুজব। বিদেশী ক্রেতা হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। তবে সব শঙ্কা কাটিয়ে সরকার, মালিক ও শ্রমিক ত্রিপক্ষীয় বৈঠকে ১৮ দফা দাবি মেনে নেওয়ার পর ক্রমশ স্বস্তি ফিরতে শুরু করেছে দেশের অর্থনীতির মজবুত ভিত্তির হাতিয়ার পোশাক খাতে। সরকারের আন্তরিক সদিচ্ছা ও দেশপ্রেমিক বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ‘রাউন্ড দ্য ক্লক’ তৎপরতার কারণেই এখন দেশের ৯৯ শতাংশ পোশাক কারখানা চালু রয়েছে। শ্রমিকদের কর্মচাঞ্চল্যে ফিরেছে কারখানাসমূহের স্বাভাবিক চেহারা। আস্থা ফিরেছে বিদেশী ক্রেতাদের মাঝেও। কারখানাগুলোতে আসছে নতুন নতুন অর্ডার। সব মিলিয়ে স্বস্তির নি:শ্বাস ফেলছেন তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকরা।

জানা যায়, অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকেই গাজীপুর, সাভার, আশুলিয়াসহ বিভিন্ন পোশাক কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষ চরমে ওঠে। কোনো কারখানায় বকেয়া বেতনের দাবিতে, আবার কোনোটিতে হাজিরা বোনাস ও টিফিন বিল বৃদ্ধি করাসহ বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভ করেন শ্রমিকেরা। এমনকি শ্রমিক ছাঁটাই বন্ধ ও শ্রমিক নিয়োগের দাবিতেও আন্দোলন করেন তাঁরা। অনেক কারখানার শ্রমিকেরা সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ করেন। এসব মহাসড়কে চলাচলকারীরা পড়েন চরম দুর্ভোগে। সঙ্কটময় এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে প্রধান উপদেষ্টা ড.মুহাম্মদ ইউনূসের নির্দেশে কয়েক দফা সরকারের শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তা এবং শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনায় বসেন।

কারখানাগুলোতে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। মজুরি বৃদ্ধি ও বছর শেষে ১০ শতাংশ হারে ‘ইনক্রিমেন্ট’ প্রদানসহ শ্রমিকদের ১৮ দফা দাবি মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সরকার ও মালিকপক্ষ। এরপর স্বাভাবিক কর্মপরিবেশ ফিরলেও পুনরায় গুজব ছড়িয়ে কারখানাগুলো থেকে শ্রমিকদের নামিয়ে আনা হয়। মূলত বাইরে থেকে একটি পক্ষ পরিকল্পিতভাবে অরাজকতা তৈরি করে। অত্যন্ত ধৈর্য্য ও বিচক্ষণতার সঙ্গে পুরো পরিস্থিতি হ্যান্ডেল করে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এতে করে ভেস্তে যায় শ্রমিক ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর অপচেষ্টা। দুর্গাপূজার ছুটি শেষে গত ১৩ অক্টোবর থেকে শ্রমিকরা পুনরায় নিজেদের কর্মস্থলে ফিরতে শুরু করেন। এরপর থেকে আর কোনো শিল্পকারখানায় শ্রমিক অসন্তোষের খবর পাওয়া যায়নি।

সূত্র মতে, দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড পোশাক শিল্পকে রক্ষায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। শিল্প কারখানার নিরাপদ ও স্বাভাবিক পরিস্থিতি তৈরি করতে তিনি ৮ আগস্ট থেকে সেখানে সেনাবাহিনী মোতায়েন করেন। সেনাপ্রধান নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি ও সাভারের এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল মো. মঈন খানকে ডেকে নিয়ে কথা বলেন। সেই সময় নবম পদাতিক ডিভিশনের মাধ্যমে গঠন করা হয় ইন্ডাষ্ট্রিয়াল সিকিউরিটি টাস্কফোর্স। সেনাবাহিনীর দু’টি ব্রিগেড এই টাস্কফোর্স পরিচালনা করে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শুরু থেকেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনী মাঠে থেকে অত্যন্ত সংবেদনশীলভাবে পোশাক শিল্পে অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে জোর তৎপরতা শুরু করে। এ সময় তাঁরা বহিরাগতদের আক্রমণ, শ্রমিকদের যৌক্তিক ও অযৌক্তিক দাবি ও ঝুট ব্যবসার আধিপত্যকে অস্থিরতার প্রধান কারণ হিসেবে সনাক্ত করে। শিল্পাঞ্চলসমূহের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সেনাপ্রধান বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) ঢাকা সেনানিবাসে আর্মি মাল্টিপারপাস কমপ্লেক্সে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তিনি সেই বৈঠকে দেশে বিরাজমান পরিস্থিতিতে শিল্পাঞ্চলের নিরাপত্তা বিধানে সেনাবাহিনীর সামগ্রিক ভূমিকা তুলে ধরেন। একই সঙ্গে সেনাপ্রধান শিল্প-কারখানা চালু রাখার ব্যাপারে সেনাবাহিনীর নিরাপত্তা সহযোগিতা অব্যাহত রাখার বিষয়ে সকলকে আশ্বস্ত করেন।

এর ঠিক তিন সপ্তাহের মাথায় নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি পোশাক শিল্পের উদ্যোক্তা এবং শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে এক আলোচনা সভায় সেনাপ্রধানের নির্দেশে নিজেদের বহুমাত্রিক তৎপরতার কথা সবাইকে অবহিত করেন। নিজেদের সচেতনতা ও পূর্ণ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকার কথা জানিয়ে সেদিন তিনি বলেন, ‘ইন্ডাষ্ট্রিয়াল সিকিউরিটি টাস্কফোর্স এর অধীনে দু’জন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল তার দু’টি ব্রিগেড নিয়ে আশুলিয়া, টঙ্গি, গাজীপুর, ভালুকা এসব জায়গায় সব কিছু মিলিয়ে আমরা এখানকার শান্তি শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ করছি। সঙ্গে আমাদের ইন্ডাষ্ট্রিয়াল পুলিশ, সাধারণ পুলিশ আছে, ৮ প্লাটুন বিজিবি ও র‌্যাব মিলিয়ে আমরা যৌথ বাহিনীর একটি কাঠামো তৈরি করেছি। একেকটি এলাকাতে কতগুলো ইন্ডাষ্ট্রি নিয়ে আমরা একটি ক্লাস্টার তৈরি করেছি। সেই ক্লাস্টারের চারিদিকে ব্যুহ তৈরি করেছি। সেই ব্যুহতে আমাদের সৈনিক মোতায়েন রয়েছে আমাদের এপিসিসহ। আমরা সেখানকার ভেতর-বাইরের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছি। আমরা দিন-রাত পেট্রোলিং করছি, যাতে করে কেউ ইন্ডাষ্ট্রির আশেপাশে কোন রকম অরাজক পরিস্থিতি তৈরি করতে না পারে।’

‘আমাদের ঢাকা, সাভার ও ময়মনসিংহে ক্যান্টনমেন্টে কুইক রিয়েকশন ফোর্স (কিউআরএফ) প্রস্তুত করে রেখেছি। এছাড়া এই মিলিটারি লাইন অব অপারেশন্স’র পাশাপাশি আমরা জনসংযোগ করছি। বিভিন্ন জায়গায় রাতে-দিনে যাচ্ছি, মাইকিং করছি। যারা এই সেক্টরের সঙ্গে পরোক্ষভাবে জড়িত ওই এলাকার বাড়িওয়ালা ও দোকানদার তাদেরকে আমরা সেনসেটাইজ করছি। আমরা মিলিটারি লাইন অব অপারেশন্স ও অন্যান্য সবকিছু মিলিয়ে আমরা একটি পরিবেশ নিয়ে আসতে পারছি। আমাদের সাফল্য হচ্ছে-কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া আমরা মেজর কোন বেণ্ডালিজম হতে দেইনি। আপনাদের প্রতিষ্ঠানগুলো যথাযথভাবে আছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ক্ষতি হয়েছে এজন্য দু:খ প্রকাশ করছি। রাজনৈতিক ও নীতি নির্ধারক মহলের আলোচনার মাধ্যমে আপনারা সমস্যার সমাধান করবেন বলে আমরা আশাবাদী’-যোগ করেন মেজর জেনারেল মো. মঈন খান।

পোশাক কারখানায় স্বাভাবিক পরিবেশ, আসছে নতুন নতুন অর্ডার
বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের কদর বেড়েছে। বাংলাদেশ এখন ডেনিম পোশাক রপ্তানির শীর্ষ দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। ২০৬টি সবুজ কারখানা নিয়ে সমগ্র বিশ্বে নেতৃত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ। অর্থনীতিতে শক্তি জোগানো এই খাতটিই নাজুক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল মাত্র ক’দিন আগেও। সরকার ও সেনাবাহিনীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তৈরি পোশাক শিল্পে কঠিন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ মিলছে। এখন প্রায় সব কারখানায় আসছে নতুন নতুন অর্ডার। চলতি অক্টোবরে গত মাসের তুলনায় প্রায় ১০ শতাংশ বেড়েছে অর্ডার। ক্রেতাদের মধ্যে আস্থা ফিরে আসছে। তারা বাংলাদেশ থেকেই পোশাক নিতে চান। তবে পরিবেশ আরও স্থিতিশীল ও স্থায়ীত্ব চান তারা। ক্রেতা আকৃষ্ট করতে বসে নেই বিজিএমইএও। বিভিন্ন দেশের দূতাবাস ও ক্রেতাদের সঙ্গে তাঁরা নিবিড় যোগাযোগ স্থাপন করেছেন। বৈঠক করছেন বিভিন্ন দূতাবাসের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও।

সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে- সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে পোশাক কারখানার উৎপাদন কার্যক্রম স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। এখন কোনো অস্থিরতা নেই। তবে সাভার ও আশুলিয়ায় ৪০৭টি কারখানার মধ্যে ৩টি ছাড়া সকল কারখাানা খুলেছে। বন্ধ ৩ কারখানার মধ্যে ২টি ১৩/১ ধারায় বন্ধ রয়েছে। গাজীপুরে ৮৭১ কারখানার মধ্যে ২টি ছাড়া বাকীগুলো চালু রয়েছে।

অভিন্নভাবে সবাই আশা প্রকাশ করেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শক্ত হাতে দেশের হাল ধরেছেন। দেশের অস্থির এক সময়ে আস্থা ফিরিয়ে সবার আস্থাভাজন হয়ে ওঠার চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন। তাঁর ‘ব্র্যান্ড নেম’ কাজে লাগিয়ে এই তৈরি পোশাক খাতটিও অনেক দূর এগিয়ে যাবে। ইতোমধ্যেই বিদেশি ক্রেতাদের মধ্যে ইতিবাচক মানসিকতা ও পরিবেশের নমুনাও দেখা যাচ্ছে। হাতছাড়া হতে যাওয়া অনেক অর্ডার ফেরত আসছে। ক্রেতাদের মাঝে একটি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি এসেছে। ড.ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণের পর গোটা বিশ্ব বাংলাদেশের প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। নিউইয়র্কে জাতিসংঘের অধিবেশনে বিশ্বের প্রভাবশালী নেতারা তার কাছে বাংলাদেশের জন্য সহায়তার দৃঢ় প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এসবের ফলে নতুন করে ভরসা পাচ্ছেন তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকরা। বাজার হাতছাড়া হওয়ার যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছিল তা অনেকটা কেটে গেছে। এই স্থিতিশীল পরিবেশ বজায় রাখার জন্য সব পক্ষই উদ্যোগী হবে বলে আশা রপ্তানিকারকদের।

জানতে চাইলে বিজিএমইএর পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘পরিবেশ আগের তুলনায় অনেক ভালো। কারখানাগুলোয় পুরোদমে কাজ চলছে। ক্রেতাদের মধ্যে আস্থা ফিরছে। ইতোমধ্যে ক্রেতারা যোযাযোগ শুরু করেছে। আশা করা যায়, আগামী মৌসুমের অর্ডার অন্য দেশে যাবে না। বর্তমান সরকারের প্রতি ক্রেতাদের আস্থা রয়েছে।’ বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশের পোশাকের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এই পোশাক খাতের হাত ধরেই অর্থনীতি একটি মজবুত ভিত্তির ওপর দাঁড়াবে বলে মনে করেন বিজিএমইএ নেতারা।

কালের আলো/এমএএএমকে