প্রধান উপদেষ্টার ধারাবাহিক সংলাপে গণহত্যার অভিযোগে আওয়ামী লীগের বিচার দাবি

প্রকাশিতঃ 10:47 pm | October 19, 2024

মো.শামসুল আলম খান, কালের আলো:

চলমান সংস্কার প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে চতুর্থ দফা সংলাপ করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ধারাবাহিক সংলাপের অংশ হিসেবে তিনি গণফোরাম, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), জাতীয় পার্টি-বিজেপি (পার্থ), ১২ দলীয় জোট, লেবার পার্টিসহ আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে সংলাপে বসেন। শনিবার (১৯ অক্টোবর) বিকাল ৩টায় প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনায় এ সংলাপ শুরু হয়। সংলাপ শেষ হয় সন্ধ্যা ৭টায়। আওয়ামী লীগের সময়ের ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দল জাতীয় পার্টিকে প্রথম দফায় সংলাপে ডাকা হলেও এবারও তাঁরা বাদ পড়েছে। সংলাপে রাষ্ট্র সংস্কারের পর দ্রুত সময়ের মধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন চেয়েছে গণফোরাম। আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করাসহ নতুন ২৩ দফা দাবি জানিয়েছে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি)। গণহত্যার অভিযোগে আওয়ামী লীগের বিচার চেয়েছে কোন কোন রাজনৈতিক দল। এর আগে গত ৫ অক্টোবর বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, গণতন্ত্র মঞ্চ, হেফাজতে ইসলাম, বাম গণতান্ত্রিক জোট, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদের সঙ্গে সংলাপ করেন প্রধান উপদেষ্টা। চতুর্থ দফা সংলাপ শেষে সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে সংলাপে নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম বলেন, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের লক্ষ্যে সরকার শিগগিরই একটি সার্চ কমিটি গঠন করবে। রীতি অনুযায়ী এ কমিটিতে ৬ জন সদস্য থাকবেন।

  • দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচন চায় গণফোরাম
  • আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করাসহ নতুন ২৩ প্রস্তাব এলডিপির
  • আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে বলেছে বিজেপি
  • নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের লক্ষ্যে শিগগিরই সার্চ কমিটি

রাষ্ট্র সংস্কারের পর দ্রুত সময়ের মধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন
এবার প্রথমে সংলাপে অংশ নিতে ইমেরিটাস সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে গণফোরামের নয় সদস্যের প্রতিনিধি দল যমুনায় প্রবেশ করে। প্রতিনিধি দলের অন্যরা হলেনÑ গণফোরামের সমন্বয় কমিটির চেয়ারম্যান মোস্তফা মহসীন মন্টু, কো-চেয়ারম্যান এস এম আলতাফ হোসেন, সুব্রত চৌধুরী, সদস্য সচিব মিজানুর রহমান, সদস্য একেএম জগলুল হায়দার আফ্রিক, মহিউদ্দিন আবদুল কাদের, মোশতাক আহমেদ ও সুরাইয়া বেগম। পরে বিকেল পৌনে ৪টায় প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনার সামনে সাংবাদিকদের সঙ্গে বিস্তারিত কথা বলেন মোস্তফা মহসীন মন্টু।

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সংলাপের দলটির সমন্বয় কমিটির চেয়ারম্যান মোস্তফা মহসীন মন্টু জানান, রাষ্ট্র সংস্কারের পর দ্রুত সময়ের মধ্যে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন চেয়েছে গণফোরাম। সংবিধান, বিচার বিভাগ, আইনশৃঙ্খলা নিয়ে সংলাপে গণফোরামের ইমেরিটাস সভাপতি ড. কামাল হোসেন কথা বলেছেন বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘বাজারে পরিস্থিতি নিয়ে জোর দিয়েছি। সিন্ডিকেটকে অবশ্যই ভাঙতে হবে।’

বাজারে পরিস্থিতি নিয়ে জোর দিয়েছি, সিন্ডিকেটকে অবশ্যই ভাঙতে হবে
-মোস্তফা মহসীন মন্টু

মোস্তফা মহসীন মন্টু বলেন, পতিত স্বৈরাচার ও তাদের বিদেশি এজেন্টরা বাংলাদেশটাকে ধ্বংস করার প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। এ থেকে উদ্ধারের জন্য আমাদের সবাইকে জাতীয়ভাবে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। গণফোরাম অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন চায় জানিয়ে তিনি বলেন, সবাইকে একমত্য হয়ে দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। এ সরকার জনগণের সরকার। এ সরকারকে রক্ষার স্বার্থে অর্থাৎ আমাদের নিজেদের রক্ষার স্বার্থে ভবিষ্যতে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হবে।

মোস্তফা মহসীন মন্টু বলেন, আমরা সরকারকে সার্বিক সহযোগিতা করবো। তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) যেকোনও বিষয়ে আমাদের সহযোগিতা চাইবেন। আমরা যেটা উপলব্ধি করবো, সেটাই পরামর্শ দেবো। জনগণের জন্য দরজা খোলা আছে বলে প্রধান উপদেষ্টা আমাদের বলেছেন। তিনি বলেন, পাচার হয়ে যাওয়া লাখো কোটি টাকা ফেরত আনতে হবে। দেশের অর্থনীতি বিপর্যস্ত অবস্থায় আছে। সেটা উত্তরণের জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। সেটা কোনও দলীয় চিন্তা-চেতনা নয়, জাতীয় ঐকমত্যের চিন্তায় এগোতে হবে।

আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে
কর্নেল (অব.) অলি আহমদ

নির্বাচন নিয়ে কথা হয়েছে জানিয়ে মোস্তফা মহসীন মন্টু বলেন, স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে, এটার জন্য সার্চ কমিটি বা কিছু করার প্রয়োজন আছে, ভালো লোক নিয়োগ দেওয়ার দরকার আছে। যাতে অতীতের মতো কোনও সমস্যা না হয়।

রোডম্যাপ নিয়ে আলোচনা হয়েছে কি না, এমন প্রশ্নে মোস্তফা মহসীন মন্টু বলেন, আমরা কোনও তারিখ উল্লেখ করিনি। বলেছি সংস্কার শেষে অতিদ্রুত নির্বাচন দেওয়ার জন্য। তবে সংস্কার শেষ না হলে সব একই হবে। নির্বাচনের আগে থাকি রাম, নির্বাচনের পরে হই রাবণ। ওই ধরনের নির্বাচন কমিশন চাই না। অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশন কমিশন চাই।

আ.লীগের বিরুদ্ধে একটা ব্যবস্থা নেওয়াটা খুব জরুরি
আন্দালিব রহমান পার্থ

সংবিধান সংশোধনের জন্য প্রস্তাব দিয়েছেন কি না, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, দু-এক দিনের মধ্যে আলোচনা করে লিখিত আকারে দেবো। আটটি দিবস বাতিল করা হয়েছে, এ নিয়ে কোনও আলোচনা হয়েছে কি না, এমন প্রশ্নে মোস্তফা মহসীন মন্টু বলেন, জাতীয় দিবস ছাড়া কোনও দিবসই রাখা উচিত নয়।

সংলাপ ফলপ্রসূ হয়েছে উল্লেখ করে গণফোরাম সমন্বয় কমিটির সদস্য সচিব মিজানুর রহমান বলেন, বৈঠকে নির্বাচনব্যবস্থা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি ও নিয়ন্ত্রণ, আইনশৃঙ্খলা পুনরুদ্ধারসহ স্বাধীন নির্বাচন কমিশন সংস্কারসহ বেশ কিছু ব্যাপারে পরমার্শ দিয়েছি। সরকার সেটা ইতিবাচক হিসেবে গ্রহণ করেছে বলে জানান মিজানুর রহমান। সরকার গঠিত কমিশনের বিষয়ে লিখিত প্রস্তাব কয়েক দিনের মধ্যে প্রধান উপদেষ্টার দফতরে দেওয়ার কথা জানান মিজানুর রহমান।

আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করাসহ নতুন ২৩ প্রস্তাব এলডিপির
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হত্যার জন্য আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করাসহ নতুন করে আরও ২৩ দফা প্রস্তাব দিয়েছে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি)। একইসঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের মতো আওয়ামী লীগ নেতাদের বিচার করে ফাঁসি দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন দলটির চেয়ারম্যান কর্নেল (অব.) অলি আহমদ। সংলাপ শেষে শনিবার (১৯ অক্টোবর) বিকাল সোয়া ৪টা সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন তিনি।

সংলাপে লিখিত ও মৌখিক প্রস্তাব তুলে ধরার কথা উল্লেখ করে অলি আহমদ বলেন, দুই দফা সংলাপের প্রথমবারে ১০৩ দফা প্রস্তাব দিয়েছিলাম। দ্বিতীয় দফায় এবার আরও ২৩টি প্রস্তাব দিয়েছি। এসব প্রস্তাব কাউকে সুবিধা দেওয়ার জন্য নয়, কাউকে জেল থেকে মুক্ত করার জন্য নয়, দেশের জনগণের জন্য দিয়েছি। অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন এবং সুন্দর প্রশাসন চালানোর জন্য, ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার জন্য, নিত্যপণ্যের বাজার ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে আনাসহ বিভিন্ন প্রস্তাব রয়েছে।

জুলাই-আগস্টে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ১৮ কোটি মানুষ যুদ্ধ করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারা পুলিশসহ প্রশাসনকে অন্যায়ভাবে ব্যবহার করেছে, জনগণের সঙ্গে মুখোমুখি করে দিয়েছে, দেশকে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিয়েছে, দুর্নীতিগ্রস্ত হয়েছে, আমাদের হাজার হাজার ছেলে-মেয়েকে হতাহত করেছে।

অলি আহমদ বলেন, আমরা মনে করি, একাত্তরে জামায়াতে ইসলামী মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল, তখন আমরা তাদের নিষিদ্ধ করেছিলাম। তাহলে আজ কী কারণে আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা হবে না? আমরা আবার বলেছি, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করতে হবে। তারা ১৮ কোটি মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। তাদের রাজনীতি করার অধিকার নেই। ক্ষমতায় টিকে থাকতে তারা সব কিছু করেছে। শেষ পর্যন্ত জনতার চাপে টিকে থাকতে পারেনি, ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের নেতারা পালিয়েছে, চোর কী করে ভালো থাকে। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধে জামায়াত নেতাদের তো ফাঁসি হয়েছে। এখন ওদের (আওয়ামী লীগ নেতাদের) ফাঁসি দিতে হবে। জামায়াতকে তো ফাঁসি দিয়েছেন, এখন আওয়ামী লীগকে ফাঁসি দেন। এটা আপনাদের দায়িত্ব। এ ছাড়া দুর্নীতিবাজদের ধরা, জনগণের লুণ্ঠন করা টাকা ফেরত আনা, অভ্যুত্থানের সময় হত্যায় অংশ নেওয়াদের বিচারের আওতায় আনা এবং সংস্কার প্রক্রিয়া আরও দ্রুত করাসহ বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন এলডিপি প্রধান অলি আহমদ।

আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখা উচিত
সংলাপ শেষে এক প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিজেপি) চেয়ারম্যান আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, ‘শুধু আওয়ামী লীগ কেন যারাই গণহত্যার সঙ্গে ছিল, নৈতিকভাবে তাদেরকে রাজনীতি করার সুযোগ দেওয়া উচিত না। এটি অবশ্যই একটা বিচার কার্যের ব্যাপার। ওই পর্যন্ত, আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধ হবে কী হবে না। ওই পর্যন্ত আওয়ামী লীগ এবং ১৪ দলে যারা আছেন, তাদেরকে সব ধরনের নির্বাচন থেকে দূরে রাখা উচিত।’

আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন জানিয়ে আন্দালিব রহমান পার্থ আরও বলেন, আওয়ামী লীগসহ ১৪ দল, রাজনৈতিক দল হিসেবে ওনাদের বিরুদ্ধে কেন কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না? নিষিদ্ধ করতে হবে, নিষিদ্ধ হবে সেটা মুখ্য না, কিন্তু একটা ব্যবস্থা নেওয়াটা খুব জরুরি তাদের বিরুদ্ধে। কোনও রাজনৈতিক দল যদি এভাবে পাবলিকলি গণহত্যাকে সাপোর্ট করে বা আরও বেশি কঠোর হতে বলে, পুলিশকে বা অন্যান্য বাহিনীকে। আমি মনে করি, রাজনীতিটা নৈতিক জায়গা থেকে করা উচিত। আওয়ামী লীগ তিনটি অবৈধ নির্বাচন করেছিল, সেই বিষয়ে কোনও স্টেপ নেওয়া যায় কিনা, আমরা সেই ব্যাপারে বলেছি।

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপে বিগত বছরগুলোতে আওয়ামী লীগের পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে ‘লন্ডার্ড মানি রিকভারি’ নামে একটা কমিশন করার প্রস্তাব দিয়েছেন তিনি। এ প্রসঙ্গে বিজেপি চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকারের গণহত্যা ও গণতন্ত্র হত্যার বাইরে আরেকটা বড় বিষয় ছিল দুর্নীতির টাকা। তাই ‘লন্ডার্ড মানি রিকভারি’ নামে একটা কমিশন করা হোক। পাচারের মাধ্যমে যে টাকা চলে গিয়েছে সে টাকাটা যাতে ফেরত আসে।’

বিজেপি চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘ড. ইউনূসের যে প্রোফাইল, উনি যদি সেটা ব্যবহার করেন, তাহলে ইউকে, দুবাই, সিঙ্গাপুর থেকে শুরু করে বিভিন্ন দেশে যে তিন-চার কোটি টাকা পাচার হয়েছে, সেই টাকাটা ফেরত আসবে। এই টাকাটা আওয়ামী সরকারের দুর্নীতির টাকা। না হলে এই টাকা আমাদের বিরুদ্ধে, বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হবে। আমি মনে করি, এই কমিশন করাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।’

আওয়ামী লীগের প্রেতাত্মাদের প্রশাসন থেকে অপসারণ দাবি
সংলাপ শেষে সন্ধ্যায় ১২ দলীয় জোটের প্রধান ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার বলেছেন, ফ্যাসিস্ট সরকারের (আওয়ামী লীগ) যেসব পেতাত্মা এখনও প্রশাসনে ঘাপটি মেরে বসে আছে তাদের আমরা অপসারণ করতে বলেছি। তিনি বলেন, জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ায় ঢাকাসহ গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোতে ট্রাকের মাধ্যমে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র বিক্রির ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছি। সরকারকে ভর্তুকি দিয়ে হলেও অবিলম্বে এই পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য যা করা প্রয়োজন তিনি সেই পদক্ষেপ নেবেন।

১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, উপদেষ্টা পরিষদের পরিসর বাড়িয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে এনে সুশাসন কায়েম করতে হবে। আমরা সংস্কারের বিষয়ে একমত পোষণ করেছি। ইউনিয়ন পরিষদ বাতিল করে তৃণমূল থেকে স্বৈরাচারকে উৎখাতের কথা বলেছি। সংস্কার শেষে যৌক্তিক সময়ের মধ্যে নির্বাচন দেওয়ার কথা বলেছি।

বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, ছাত্র জনতার বিপ্লবে গঠিত সরকারকে এখন বিপ্লবী আচরণ করতে হবে, ফ্যাসিজমের মূলোৎপাটন করতে হবে। যেসব দল ফ্যাসিজমকে সহযোগিতা করেছে তাদেরও আইনের আওতায় এনে বিচার করতে হবে। ১২ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টাকে ১৪ দফা লিখিত প্রস্তাবনা দেওয়া হয়।

উপদেষ্টা পরিষদের সংস্কার চায় লেবার পার্টি
লেবার পার্টির সভাপতি মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেছেন, আমরা বলেছি যতো সংস্কার করুক না কেন, সবার আগে সংস্কার করতে হবে উপদেষ্টা পরিষদের। এ পরিষদের হাতেগোনা কয়েকজনের সফলতা ছাড়া বাকি সবাই ব্যর্থ। তাই ব্যর্থদের দ্রুত অপসারণ করতে হবে। তিনি সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে এ কথা বলেন।

মোস্তাফিজুর রহমান ইরান বলেন, উপদেষ্টা পরিষদের ছাত্ররা ভালো করেছে (নাহিদ ও আসিফ)। আমরা ভেবেছিলাম তারা ভালো করবে না। কিন্তু বড় বড় সাবেক সচিব, উপদেষ্টাদের চেয়ে তারা ভালো করেছে। আমরা আলী ইমাম মজুমদারের ব্যাপারে বলেছি। তাকে অপসারণ করতে হবে। আলী ইমাম মজুমদার প্রশাসনে আওয়ামী লীগদের বেছে বেছে নিয়োগ দিচ্ছেন। ইতোমধ্যে ক্ষমতা নেওয়ার পরে ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত আওয়ামী লীগকে পুর্নবাসনের অনেকগুলো কথা বলেছেন, সুপ্রদীপ চাকমা শপথ নেওয়ার পর আওয়ামী লীগের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তিনি আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী।

তিনি বলেন, বিভিন্ন এনজিও প্রধানদের এনে এটা একটা এনজিওগ্রাম সরকার করা হয়েছে। এখানে যারা যোগ্য, কর্মঠ তাদের আনতে হবে। ইরান বলেন, শেখ হাসিনা যেমন গণহত্যাকারী, জাতীয় পার্টি-মহাজোটের দলগুলো শেখ হাসিনার সমপরিমাণ অপরাধী। এ জন্য জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতারের আবেদন জানিয়েছি।

নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের লক্ষ্যে শিগগিরই সার্চ কমিটি
সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম বলেন, সরকার তার দল নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে নিরপেক্ষ ও যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের লক্ষ্যে একটি সার্চ কমিটি গঠন করবে। সার্চ কমিটি সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে নির্বাচন কমিটি পুনর্গঠনের কাজ করবে। পুনর্গঠিত নির্বাচন কমিশন ভোটার তালিকা হালনাগাদসহ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তুতিমূলক যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করবে।

এক প্রশ্নের জবাবে মাহফুজ আলম বলেন, গত তিনটি নির্বাচনে তরুণরা ভোট দিতে পারেননি। এই বিপুল সংখ্যক তরুণকে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করাসহ অনেকগুলো প্রসিডিউল জিনিস আছে, সেগুলো সার্চ কমিটির মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনাররা এসে ঠিক করবেন। এসময় সরকারের শুরু করা সংস্কার কার্যক্রমও সমান্তরালভাবে চলমান থাকবে বলেও জানান বিশেষ সহকারী।

প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপের বিষয়ে জানাতে আয়োজিত এ সংবাদ সম্মেলনে বিদ্যমান আইনে নির্বাচন কমিশন নিয়োগে সার্চ কমিটি করা হবে জানিয়ে মাহফুজ আলম বলেন, সার্চ কমিটি গঠনের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক কোনও চাপ বা হস্তক্ষেপ গ্রহণ করা হবে না। সংলাপের বিষয়ে মাহফুজ আলম বলেন, নির্বাচন ও সংস্কার বিষয়েই বেশি কথা হয়েছে। এছাড়া দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ, তিনটি নির্বাচন অবৈধ ঘোষণা, গণহত্যার অভিযোগে আওয়ামী লীগের বিচার এসব বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।

আওয়ামী লীগের বিচার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অন্তর্র্বতী সরকার এককভাবে এ ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্ত নেবে না। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় গণহত্যার জন্য আওয়ামী লীগ, ১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলো নিষিদ্ধ করা এবং তাদের রাজনীতি সীমিত করার বিষয়ে সংলাপে রাজনৈতিক দলগুলো মতামত দিয়েছে বলে জানান প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম। তিনি বলেন, ওনারদের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অবস্থান তৈরিতে বাধা সৃষ্টি করা হবে, সেটা কীভাবে বাস্তবায়িত হবে তা দেখতে পারবেন। এটার আইনি ও প্রশাসনিক দিক আছে, তা অচিরেই দেখতে পারবেন। নির্বাচনি কার্যক্রম শুরু হলে বিষয়গুলো স্পষ্ট হবে।

শনিবার (১৯ অক্টোবর) রাতে হেয়ার রোডের ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে এক সাংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি। এর আগে অন্তর্র্বতীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তার সরকারি বাসভবন যমুনায় সংলাপে অংশ নেয় কয়েকটি রাজনৈতিক দল, সে বিষয়ে জানাতে এ সংবাদ সম্মেলন করা হয়।

মাহফুজ আলম বলেন, আগে কিছু দলের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। বাকি দলগুলোর সঙ্গে আজ আলোচনা হলো। নির্বাচন এবং সংস্কার নিয়ে কথা বলেছে দলগুলো। আওয়ামী লীগের রাজনীতি, ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইমস, গণহত্যা এবং এর বিচার কার্যক্রম নিয়ে তারা কথা বলেছে।

তিনি বলেন, সংলাপে আবারও আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করার বিষয়টি এসেছে। ১৪ দলের শরিক দলগুলোকে নিষিদ্ধের কথা এসেছে। তাদের রাজনীতি কীভাবে সীমিত করা যায়, সে বিষয়টিও এসেছে। ১৪ দলের শরিক দল, যারা গণভবনে বসে জুলাইয়ের শেষে এবং আগস্টের শুরুতে আওয়ামী লীগের হাত শক্তিশালী করেছে, আওয়ামী লীগকে গণহত্যায় সহযোগিতা করেছে মাঠে এবং সরকারের নীতিনির্ধারণে, তাদের কীভাবে ফেলা হবে সে বিষয়ে সংলাপে কথা বলেছে এবং সরকারের কাছে জানতে চেয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো।

এক প্রশ্নের জবাবে মাহফুজ আলম বলেন, আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলীয় জোটের বিষয়ে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট। ওনারদের রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অবস্থান তৈরিতে বাধা সৃষ্টি করা হবে। সেটা কীভাবে বাস্তবায়িত হবে তা দেখতে পারবেন। এটার আইনি ও প্রশাসনিক দিক আছে, তা অচিরেই দেখতে পারবেন। নির্বাচনি কার্যক্রম শুরু হলে বিষয়গুলো স্পষ্ট হবে।

তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ বা ১৪ দল নিষিদ্ধ অথবা শরিক অনেকগুলো দল আছে। আমরা জাতীয় পার্টিকে আপাতত রাখছি না। তারা কিন্তু নীরব সমর্থন দিয়ে গেছেন এবং অবৈধ নির্বাচনগুলোতে অংশ নিয়েছে। তাদের বিষয়ে সরকার অবস্থান পর্যালোচনা করছে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আরও আলোচনা-পর্যালোচনার ভিত্তিতে এটা হবে। এটা সরকার একা সিদ্ধান্ত নেবে না। যারা ফ্যাসিবাদের দোসর ছিল এবং গণহত্যার পক্ষে অবস্থান ব্যক্ত করেছে এবং জনগণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে— সরকার তাদের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে বলে দিয়েছে।

আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে হওয়া গত তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন (২০১৪, ২০১৮, ২০২৪) কীভাবে অবৈধ ঘোষণা যায়, সে বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো সংলাপে অভিমত দিয়েছে বলে জানান প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম।

ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, যারা জুলাই-আগস্টের গণহত্যায় জড়িত, তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। যারা পালিয়েছেন, তারা কীভাবে গেলেন সে বিষয়েও অনুসন্ধান করা হচ্ছে। এ সময় তিনি জানান, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দেশে তিন দিন কোনও সরকার ছিল না। মূলত সেই সময়ই অনেকে পালিয়েছেন।

কালের আলো/এমএসএকে/এমএএএমকে