সেনাপ্রধানের যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা সফরে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়নে নতুন মাত্রা

প্রকাশিতঃ 1:07 am | October 26, 2024

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের সাড়ে ৩ মাসের মাথায় প্রথমবারের মতো যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা সফর করেছেন জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। সফরকালে তিনি জাতিসংঘ সদর দপ্তরে শান্তিরক্ষা মিশনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, যুক্তরাষ্ট্রের সেনাপ্রধানসহ উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা এবং কানাডার উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা ও ব্যক্তিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। গুরুত্বপূর্ণ এই দুটি দেশের সরকারের আমন্ত্রণে ১০ দিনের সফরে তিনি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক উন্নয়ন ও স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলোচনা করেছেন। পরে শুক্রবার (২৫ অক্টোবর) তিনি দেশে ফিরেন।

এই সফরে দেশের জন্য অনেক কিছুই অর্জিত হয়েছে, যার বেশিরভাগই সুফল পাবে দেশ। দেশের স্বার্থের কথা বিবেচনা করেই তিনি সফরগুলোর অগ্রাধিকার চিহ্নিত করেন। বাংলাদেশের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ এই দু’দেশের বিরাজমান সম্পর্ককে নতুন মাত্রায় উন্নীত করতেও নিজের বহুমাত্রিক মেধা, বিচক্ষণতা ও পেশাদারিত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। আরও ঘনিষ্ঠ করেছেন দেশ দুটির সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ককে।

বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিশ্বের তাবৎ পরাক্রমশালী যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ বন্ধুরাষ্ট্র। গত সরকারের সময়ে এই সম্পর্কে তিক্ততা তৈরি হয়। কিন্তু শান্তিতে নোবেল জয়ী ড.ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনায় দায়িত্বে আসার পর এই সম্পর্ক নতুন মাত্রা পেয়েছে। ফলে নানা দিক থেকেই সেনাপ্রধানের এই সফরটির বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। গভীর তাৎপর্যপূর্ণ এই সফরটিতে তিনি নিজের কূশলী-বিচক্ষণ নেতৃত্বের অপূর্ব সমন্বয়ের মাধ্যমে নতুন এক উচ্চতায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছেন।

সফরের সারসংক্ষেপ, আলোচনা-অর্জনের চিত্র
আন্ত:বাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানিয়েছে, সেনাপ্রধান গত ১৭ অক্টোবর নিউইয়র্কে অবস্থিত জাতিসংঘ সদর দপ্তরে জাতিসংঘের ডিপার্টমেন্ট অব পিস অপারেশনস বিভাগের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল জ্যঁ পিয়েরে লেখোয়া, ডিপার্টমেন্ট অব অপারেশনাল সাপোর্ট বিভাগের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল অতুল খের এবং জাতিসংঘের মানবাধিকার–সংক্রান্ত হাইকমিশনের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল ইলজে ব্র্যান্ড কেহরিসসহ শান্তিরক্ষা মিশনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ সময় তাঁরা বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী, বিশেষ করে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমের ভূয়সী প্রশংসা করেন।

এ সকল বৈঠকে সেনাপ্রধান জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীদের অংশগ্রহণ বৃদ্ধি এবং নীতি নির্ধারণী বা ফোর্স কমান্ড পর্যায়ে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব বাড়াতে গুরুত্বারোপ করেন। পাশাপাশি সেনাবাহিনী প্রধান র‍্যাব ফোর্সেসে প্রেষণে নিয়োজিত থাকাকালীন সেনাবাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদেরকে শান্তিরক্ষা মিশনে নির্বাচিত না করার বিষয় সকলকে অবহিত করেন।

এছাড়াও, তিনি বাংলাদেশের চলমান পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকারের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চলমান কর্মকাণ্ডের ওপর আলোকপাত করেন। সেনাবাহিনী প্রধান বাংলাদেশ সরকার এবং সেনাবাহিনী পার্বত্য চট্টগ্রামে আর্থ-সামাজিক ও শান্তি শৃঙ্খলার উন্নয়নে গৃহীত নানান ইতিবাচক দিক তুলে ধরেন। তিনি বিভিন্ন শান্তিরক্ষা মিশনে নিয়োজিত বাংলাদেশী শান্তিরক্ষী কন্টিনজেন্টসমূহের উদ্যোগে স্থানীয় জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে হাসপাতাল ও ক্লিনিক পরিচালনার বিষয়ও তাদের অবগত করেন। মিশনে অংশগ্রহণকারী দেশসমূহের মধ্যে শান্তিরক্ষা বিষয়ক প্রশিক্ষণ বিনিময়, আভিযানিক সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ মিশন সংক্রান্ত অন্যান্য বিষয়াদি গুরুত্বের সাথে আলোচিত হয়। সেনাবাহিনী প্রধান জাতিসংঘের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিশ্ব শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশী শান্তিরক্ষীদের জোরালো ভূমিকা ও সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন। এছাড়াও সেনাপ্রধান নিউইয়র্কে অবস্থিত বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন পরিদর্শন করেন এবং স্থায়ী প্রতিনিধির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন।

আইএসপিআর আরও জানায়, সেনাপ্রধান গত ২২ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা সদর দপ্তর পেন্টাগনে দেশটির সেনাপ্রধান জেনারেল র‌্যান্ডি জর্জের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ ও আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন। সাক্ষাৎকালে তাঁরা দুই দেশের সেনাবাহিনীর স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়, বিশেষ করে শান্তি রক্ষা মিশন, প্রশিক্ষণসহায়তা, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়ন ও পারস্পরিক আস্থা সৃষ্টি, আঞ্চলিক নিরাপত্তা বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতা-সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। এ সময় যুক্তরাষ্ট্রের সেনাপ্রধানের বৈদেশিক নীতিবিষয়ক উপদেষ্টা উপস্থিত ছিলেন।

এছাড়া সেনাপ্রধান যুক্তরাষ্ট্রের সেক্রেটারি অব ডিফেন্স অফিসের ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় নিরাপত্তাবিষয়ক সহকারী সামরিক সচিব এলি র‌্যাটনারের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। এ সময় ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশসমূহ ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যে সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করা এবং পারস্পরিক সহযোগিতা বৃদ্ধি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়। সাক্ষাৎকালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের বিশেষ সহকারী এবং দক্ষিণ এশিয়া সংক্রান্ত জ্যেষ্ঠ পরিচালক এমএস লিন্ডসে ডব্লিউ ফর্ডসহ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের দক্ষিণ এশিয়া সংক্রান্ত উচ্চপদস্থ সামরিক ও অসামরিক কর্মকর্তারাও উপস্থিত ছিলেন।

আইএসপিআর বলছে, সেনাপ্রধান যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর সঙ্গেও সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাৎকালে সেনাপ্রধান দেশের সামগ্রিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি এবং সরকারের সমর্থনে সেনাবাহিনীর বিবিধ কর্মকাণ্ড সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করেন। বৈঠকে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

এদিকে, কানাডা সফরকালে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান দেশটির ভাইস চিফ অব কানাডিয়ান ডিফেন্স স্টাফ লেফটেন্যান্ট জেনারেল স্টিফেন কেলসির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাৎকালে তিনি বাংলাদেশি শিক্ষার্থী, কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত সামরিক বাহিনীর সদস্যদের জন্য ভিসা প্রক্রিয়াকরণ সহজতর করার কথা বলেন। তিনি প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে সহযোগিতা জোরদার করা বিশেষ করে সামরিক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রশিক্ষণার্থী বিনিময়ের কথা উল্লেখ করেন বলে জানায় আইএসপিআর।

এছাড়া কানাডিয়ান পার্লামেন্টের নাগরিকত্ব ও অভিবাসনবিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির সদস্য সালমা জাহিদ এমপির সঙ্গে সেনাপ্রধান সাক্ষাৎ করেন। সাক্ষাৎকালে তাঁরা দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেন। সেনাপ্রধান বিশেষ করে ছাত্রদের এবং কর্মরত অবসরপ্রাপ্ত সামরিক অফিসারদের ভিসা প্রক্রিয়া সহজতর করা, শিক্ষা বিনিময়ের জন্য বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে এমওইউ স্বাক্ষর, কৃষি ও অবকাঠামো উন্নয়নসহ পরিচর্যাকারী পাঠানোর মাধ্যমে স্বাস্থ্যখাতে সহযোগিতার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেন। এছাড়াও, বাংলাদেশে মনোনীত কানাডার হাইকমিশনার এইচই অজিত সিং এবং কানাডায় বাংলাদেশের হাইকমিশনার নাহিদা সোবহান সেনাপ্রধানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন।

কালের আলো/এমএএএমকে