ভয়ঙ্কর মোহাম্মদপুরে কঠোর সেনাবাহিনী

প্রকাশিতঃ 10:19 am | October 29, 2024

নিজস্ব প্রতিবেদক , কালের আলো:

রাজধানীতে দিনের আলোয় ছিনতাই ও ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। রাত নামতেই অলিগলি থেকে রাজপথের অধিকাংশ এলাকা চলে যায় ছিনতাইকারীদের দখলে। বিশেষ করে ঢাকার মোহাম্মদপুরে গত কয়েক দিন একের পর এক ছিনতাইকার- শুধু ওই এলাকার অধিবাসীই নয়, পুরো নগরবাসীকে ভীষণ আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছে। রাতের ঢাকায় টহল পুলিশের দেখা কম মেলায় ঢাকার অনেক এলাকাতেই মানুষকে গন্তব্যে পৌঁছতে হয় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে। সর্বাধিক আতঙ্ক তাড়া করছে মোহাম্মদপুর ও আশপাশ এলাকার বাসিন্দাদের। এমন প্রেক্ষাপটে ক্রাইম জোন হিসেবে খ্যাত মোহাম্মদপুর এলাকার ছিনতাই, ডাকাতি রোধসহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সেনাবাহিনী। ইতোমধ্যে মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন হাউজিংয়ে অস্থায়ী ক্যাম্প বসিয়েছে সেনাবাহিনী। এ এলাকায় ছিনতাই-ডাকাতির নেপথ্যে থাকা অপরাধী চক্রগুলোর বিরুদ্ধে শুরু হয়েছে সেনাবাহিনীর

বিশেষ অভিযান। গত দুদিনে মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে ৫১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে যৌথ বাহিনী।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ধারালো অস্ত্র নিয়ে একদল তরুণ এক তরুণীকে ঘিরে ধরে টানাহেঁচড়া করছে, ওড়না টেনে রাস্তায় ফেলে দিচ্ছে আর তরুণী দৌড়ে বাঁচার চেষ্টা করছেন। আবার মিনি সুপারশপে চাপাতি হাতে কয়েকজন ঢুকে লুটপাট চালানোর ঘটনা সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। এসব দৃশ্য দেখে আঁতকে উঠেছে মানুষ। বিশেষ করে মোহাম্মদপুরে ডাকাতি ও এক তরুণীর পেছনে পেছনে চাপাতি হাতে দৌড়ানোর ঘটনায় এলাকাবাসীর বিক্ষোভের পর গত শনিবার দিবাগত রাতে সেনাবাহিনীসহ যৌথ বাহিনীর অভিযান শুরু হয়। এ অভিযানে ৪৫ জনকে আটক করা হয়েছে। গতকাল রবিবার বিহারি ক্যাম্প এলাকা থেকে ৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে যৌথ বাহিনী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, গণ-অভ্যুত্থানে বিতর্কিত ভূমিকার জেরে পুলিশের মনোবল ও তৎপরতা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। কারাগার থেকে অপরাধীরা ঢালাওভাবে বেরিয়ে আসছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অতিসতর্কতার সঙ্গে ব্যবস্থা নিলেও যৌথ বাহিনীর জোরালো ও সাঁড়াশি উদ্যম নেই। যৌথ বাহিনী এমন কোনো কাজ করতে চাইছে না, যার জেরে বিতর্কিত হতে পারে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উদ্যম কম থাকার পাশাপাশি রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে প্রতিরোধ না থাকায় ছিনতাই-ডাকাতির মতো ঘটনা ঘটছে এবং আতঙ্ক ছড়াচ্ছে।

ঢাকার মোহাম্মদপুরে গত কয়েক দিনে ছিনতাই ডাকাতির বিষয়ে সমাজ অপরাধ বিষয়ে এই বিশেষজ্ঞ বলেন, মাদক নিয়ে আধিপত্য ও কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য মোহাম্মদপুর এলাকার দীর্ঘদিনের সমস্যা। বিহারি ক্যাম্প ও আশপাশের এলাকায় ছিনতাই ও ডাকাতির মতো ঘটনা বেশি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি স্থানীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃত্বকে এখন তাই জোরালোভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, শেখ হাসিনা সরকারের বিদায়ের পর ব্যাপক হামলা, অনাস্থা আর আন্দোলনের সময় বিতর্কিত ভূমিকার জন্য পুলিশ কিছুটা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। সেই সুযোগে অপরাধী চক্র আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটাচ্ছে। ছিনতাই ও ডাকাতির মতো ঘটনা ঘটছে। তবে পুলিশ বাহিনী আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। ঢাকাসহ সারা দেশে পুলিশি কার্যক্রম স্থিতিশীল হওয়ায় এখন পরিস্থিতির উন্নতি হবে।

একজন অপরাধ বিশেষজ্ঞ বলছেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো জোরালো ভূমিকা রাখতে পারছে না বলেই অপরাধ চক্রগুলো সুযোগ নিচ্ছে। আবার নতুন করে বিরূপ পরিস্থিতিতে পড়ার ভয়েও অনেক ক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে গড়িমসি করছেন অনেক পুলিশ সদস্য। এসব কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে বলে তিনি মনে করেন, যা জনজীবনে উদ্বেগ তৈরি করছে।

মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দারা জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর মোহাম্মদপুরে ছিল ডাকাতির আতঙ্ক। আর এখন ছিনতাইয়ের। কিছুদিন ধরে দেখা যাচ্ছে দলবদ্ধভাবে কিশোর-তরুণরা ঘোরাঘুরি করছে, একে-ওকে হামলা করছে এবং তাদের কেউ কিছু বলতে পারছে না ভয়ে, অজানা আশঙ্কায়।

এর আগে গত ১১ অক্টোবর মোহাম্মদপুরে যৌথ বাহিনীর পরিচয়ে ব্যবসায়ীর বাসায় ডাকাতি সংঘটিত হয়। সেনাবাহিনী ও র‍‍্যাব পরা ডাকাতরা নিজেদের যৌথ বাহিনীর পরিচয় দিয়ে নগদ ৭৫ লাখ টাকা ও ৭০ ভরি সোনা লুট করে। এ ঘটনায় আটজনকে আটক করা হয়েছে।

জানা গেছে, ছিনতাই-ডাকাতি ও কিশোর গ্যাংয়ের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছিল মোহাম্মদপুর এলাকা। ক্ষুব্ধ এলাকাবাসী গত শনিবার বিকালে থানার সামনে বিক্ষোভ ও অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে ৭২ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দেওয়ার পর রাতেই এলাকাজুড়ে অভিযান চালায় সেনাবাহিনীসহ যৌথ বাহিনী।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) উপকমিশনার তালেবুর রহমান বলছেন, পটপরিবর্তনের পর কেউ কেউ হয়তো সুযোগ নিতে চেয়েছে। কিন্তু আমরা নিজেদের পুরোপুরি গুছিয়ে নিয়েছি। ডিএমপির সব থানা ও পুলিশি কার্যক্রম এখন পুরোপুরি সক্রিয় ও কার্যকর হয়েছে। বিচ্ছিন্ন কিছু ঘটলেও কেউ অপরাধ করে রেহাই পাবে না। শিগগিরই দেখবেন পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে।

ক্ষমতার পটপরিবর্তনে রাজপথ থেকে অলিগলিতে ধারাবাহিক ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে গত বুধবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে রাজধানীর তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে বিজি প্রেসের সামনে প্রাইভেট কারে থাকা চার সাংবাদিককে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে মানিব্যাগ, মোবাইল ফোনসেট ও ক্রেডিট কার্ড ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। গত আড়াই মাসে আধিপত্য বিস্তার ও মাদক কারবার নিয়ে সৃষ্ট বিরোধে মোহাম্মদপুরেই খুন হয়েছে ১০ জন। ৫ অক্টোবর রাজধানীর উত্তরার হাউস বিল্ডিং এলাকায় ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারিয়েছেন রিকশাচালক মো. সোহান। ১০ অক্টোবর মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান এলাকায় ছিনতাইয়ে বাধা দেওয়ায় রবিউল ইসলাম (৩৫) নামে এক নিরাপত্তাকর্মীকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে ছিনতাইকারীরা। ১৬ অক্টোবর রাতে ধানমন্ডিতে এক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও তার স্ত্রী ছিনতাইয়ের শিকার হন। গত ২০ অক্টোবর মোহাম্মদিয়া হাউজিং লিমিটেড ৩ নম্বর সড়কে নেসলে কোম্পানির পণ্য পরিবহনকারী একটি গাড়ি থামিয়ে ১২ লাখ টাকা ছিনতাই করে কয়েক ব্যক্তি। এর আগে ৩০ সেপ্টেম্বর যাত্রাবাড়ীর দক্ষিণ কুতুবখালী এলাকায় ছিনতাইয়ে বাধা দেওয়ায় মো. রাসেল শিকদার নামে এক যুবককে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

মোহাম্মদপুরে সেনাক্যাম্প : ডাকাতি, ছিনতাই ও চুরি প্রতিরোধে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করছে যৌথ বাহিনী। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে মোহাম্মদপুরের বেড়িবাঁধসংলগ্ন ঢাকা উদ্যান এলাকায় অস্থায়ী সেনাক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। জোরদার করা হয়েছে সেনা, র‍‍্যাব ও পুলিশের টহল।

গতকাল দুপুরে মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে অভিযান চালান সেনা, র‍‍্যাব ও পুলিশের সমন্বয় যৌথ বাহিনীর সদস্যরা। এ সময় ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে মাদক ও ছিনতাইয়ের অভিযোগ রয়েছে। এর আগে গত শনিবার মধ্যরাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুর, নবোদয় হাউজিং, চন্দ্রিমা উদ্যান, ঢাকা উদ্যান, চাঁদ উদ্যান, একতা হাউজিং ও নবীনগর হাউজিং এলাকায় অভিযান চালিয়ে ৪৫ জনকে গ্রেপ্তার করে যৌথ বাহিনী। তাদের বিরুদ্ধে এলাকায় ছিনতাই, ডাকাতি, সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজির অভিযোগ রয়েছে।

গত শনিবার দিনগত রাত ১টার দিকে বছিলায় সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ২৩ ইস্ট বেঙ্গলের উপ-অধিনায়ক মেজর নাজিম আহমেদ বলেন, মোহাম্মদপুরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রবিবার (গতকাল) থেকে বিভিন্ন হাউজিং এলাকায় অস্থায়ী ক্যাম্প করা হবে। দু-তিনটি হাউজিং এলাকার মধ্যে একটি করে এমন অস্থায়ী ক্যাম্প তৈরি করা হবে; যেখান থেকে সেনাসদস্যরা পুরো এলাকার আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে কাজ করতে পারবেন।

মোহাম্মদপুরে ২৭-২৮টি কিশোর গ্যাংয়ের সন্ধান পাওয়া গেছে উল্লেখ করে মেজর নাজিম বলেন, এর মধ্যে জেনেভা ক্যাম্পেই প্রায় ৩০-৪০ শতাংশ সদস্য রয়েছে। যাদের আটক করেছি, তাদের মধ্যে ১৫-১৬ জন গডফাদার বা লিডারকে আমরা ধরেছি। এদের সবাই চাঁদাবাজি, ডাকাতি করত। অফিসগামী মানুষ ও শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষ তাদের দ্বারা ভুক্তভোগী।

কালের আলো/ডিএইচ/কেএ