ছাত্র সংসদ নির্বাচনে চোখ অন্তর্বর্তী সরকারের
প্রকাশিতঃ 10:42 pm | November 01, 2024
কালের আলো রিপোর্ট :
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আবদুল কাদের গণমাধ্যমে যে ৯ দফা দাবি ঘোষণা করেছিলেন, তার ৭ নম্বর দাবিটি ছিল, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দলীয় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করে ছাত্র সংসদ কার্যকর করা। শিক্ষার্থীদের দাবির মুখে ওই সময় দেশের অন্তত ১৯টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ৪টি সরকারি কলেজ ও ১০টি সরকারি মেডিকেল কলেজে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এসব প্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু এরপর এ নিয়ে আর কোন আলাপ-আলোচনা হয়নি। শেখ হাসিনার পতনের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রিসার্চ সোসাইটির করা এক জরিপে দেখা গেছে, ৮৪% শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে দলীয় রাজনীতি নিষিদ্ধের পক্ষে।
তবে আগামীদিনে দক্ষ এবং যোগ্য নেতৃত্ব তৈরির জন্য দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদের নির্বাচনের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম। এর মাধ্যমে তিনি স্পষ্ট বার্তা দিয়েছেন, পরবর্তী সংসদ নির্বাচনের আগে বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন আয়োজনেই দৃষ্টি দিচ্ছে সরকার। এ প্রসঙ্গে সরকারের প্রভাবশালী এই উপদেষ্টা বলেছেন, ‘ছাত্রদের তাদের রাজনৈতিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে আমাদের সর্বপ্রথম কর্তব্য। আমি মনে করি, অন্তর্বর্তী সরকার সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন আয়োজন করবে, জাতীয় বা অন্য যেকোনো নির্বাচনের আগে।’
জানা যায়, আওয়ামী লীগের শাসনামলে দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্যাম্পাস ও আবাসিক হলে দলটির ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগের নির্যাতনসহ নানা অপকর্মে অতিষ্ঠ ছিলেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। ছাত্ররাজনীতি চালু থাকলে আবারও ক্যাম্পাসে একই অবস্থা তৈরি হতে পারে-এমন আশঙ্কার কথা উল্লেখ করে শিক্ষার্থীদের অনেকে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি তুলেন। সেই সময় ডুজা কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় ছাত্ররাজনীতি ও রাজনৈতিক কার্যক্রম বিষয়ে শিক্ষার্থীদের অভিমত’ শীর্ষক জরিপের ফল প্রকাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা সংসদ (ডিইউআরএস)। এতে জানানো হয়, তাদের জরিপটি ৩ সেপ্টেম্বর শুরু হয়ে ১১ সেপ্টেম্বর শেষ হয়। এতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ৭৮টি বিভাগ ও ১০টি ইনস্টিটিউটের ২ হাজার ২৩৭ শিক্ষার্থী অংশ নেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৭-১৮ থেকে ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা এই জরিপে অংশ নিয়েছেন।
জরিপের ফলাফল বলছে, ৮৩ দশমিক ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থী দলীয় ছাত্ররাজনীতি ‘একেবারেই নিষিদ্ধ’ চেয়েছেন। সংস্কারকৃত রূপে বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় ছাত্ররাজনীতি প্রত্যাশা করেছেন ১৬ শতাংশ শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় ছাত্ররাজনীতি যে অবস্থায় আছে, সেই অবস্থাতেই প্রত্যাশা করেছেন শূন্য দশমিক ২০ শতাংশ। ৮৮ শতাংশ শিক্ষার্থী ক্যাম্পাসে দলীয় ছাত্ররাজনীতির ‘কোনো গুরুত্ব নেই’ বলে মত দিয়েছেন। জরিপের ফলাফল অনুযায়ী, ডিইউআরএসের পক্ষ থেকে চারটি সুপারিশও তুলে ধরা হয় সংবাদ সম্মেলনে। এগুলো হলো দলীয় ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা, ডাকসুকে পুনরুজ্জীবিত ও সংস্কার করা, শিক্ষা ও গবেষণা উন্নয়ন কমিটি গঠন এবং শিক্ষা ও গবেষণার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররাজনীতি বন্ধের সিদ্ধান্ত ‘খারাপ পদক্ষেপ’ হিসেবে দেখেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তার মতে, এই সিদ্ধান্তে লাভবান হবে ‘অন্ধকারের মানুষরা।’ গত শনিবার (২১ সেপ্টেম্বর) ঢাকার গুলশানে দলীয় চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়ে এক প্রশ্নে বিএনপির এই শীর্ষ নেতা বলেন, ‘রাজনীতি উন্মুক্ত রাখতে হবে। রাজনীতিকে এমনভাবে উৎসাহী করতে হবে যেন ভালো রাজনীতি হয়, সুস্থ রাজনীতি হয়।’
তবে গত বুধবার (৩০ অক্টোবর) প্রেস ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআইবি) অডিটোরিয়ামে বাংলাদেশ সাংবাদিক কল্যাণ ট্রাস্ট থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের অনুদান চেক বিতরণ অনুষ্ঠানে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘ছাত্ররা দেশের ভালো চায় এবং দেশকে পুনর্গঠন করতে চায়। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলোর সহায়তা তারা কামনা করছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র রাজনীতির সংস্কার দাবি প্রবলভাবে উঠেছে। কিন্তু কোনো রাজনৈতিক দলই সেটি অ্যাড্রেস করছে না। জাতীয় নির্বাচনের কথা রাজনৈতিক দলগুলো যতবার বলেছে, ছাত্র সংসদ নির্বাচনের কথা তারা একবারের জন্যও বলেনি। ছাত্রদের কথা কিন্তু অবশ্যই মনে রাখতে হবে। তাদের সর্বোচ্চ প্রায়োরিটি দিতে হবে।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, সাধারণত শিক্ষার্থীদের যাবতীয় দাবি-দাওয়া তুলে ধরার অন্যতম প্লাটফর্ম হচ্ছে ছাত্র সংসদ। এটি শিক্ষার্থীদের পক্ষে স্বাধীনভাবে কাজ করে। ছাত্র সংসদ হচ্ছে এমন একটি কার্যনির্বাহী পরিষদ, যেটি ছাত্রদের মধ্যে প্রতিনিধি নির্বাচনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের যাবতীয় সমস্যার সমাধান ও দাবি-দাওয়া আদায়ের মাধ্যম হিসাবে কাজ করে। ছাত্র সংসদ নির্বাচনের মাধ্যমে নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চেতনা ও স্বাধিকার আন্দোলনের অন্যতম সূতিকাগার হলো এই ছাত্র সংসদ। বাংলাদেশের সামগ্রিক ইতিহাসে ছাত্র সংসদের রয়েছে এক গৌরবময় ভূমিকা। যেমন-৫২-র ভাষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এবং ’৭১-এর স্বাধীনতা আন্দোলন। এছাড়া সর্বশেষ ২৪-এর গণঅভ্যুত্থান থেকে শুরু করে দেশের সঙ্কটময় মুহূর্ত ও ক্রান্তিকালে এগিয়ে এসেছে এ দেশের ছাত্র সমাজ।
গত আগস্টে ছাত্র-জনতার রক্তস্নাত গণঅভ্যুত্থানে আবু সাঈদ থেকে শুরু করে মুগ্ধরা নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। এই লড়াইয়ে পঙ্গুত্বকেও সাদরে বরণ করে নিয়েছে হাজার হাজার শিক্ষার্থী। যে কোনো স্বাধীনতা আন্দোলনে ছাত্রসমাজের অগ্রণী ভূমিকার বিষয়টি গুরুত্বারোপ করে দেশের সর্বক্ষেত্রে বিশেষ করে রাজনৈতিক অঙ্গনে ছাত্রদের অংশগ্রহণ বা অংশীদারত্ব নিশ্চিতকরণ খুবই প্রয়োজন, যা সম্ভব হবে শুধু ছাত্র সংসদের মাধ্যমে। সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম এই প্রয়োজনীয়তার ওপরই গুরুত্বারোপ করেছেন। তাঁর এই বক্তব্য সময়ের দাবি ছিল। আক্ষরিক অর্থেই এটি বাস্তবায়ন সম্ভব হলে শিক্ষাঙ্গনে সুস্থ রাজনীতি চর্চা হবে। শিক্ষা ক্ষেত্রে মেধাবীরা এগিয়ে আসবে। জাতীয় পর্যায়ে অনেক দক্ষ ও যোগ্য নেতৃত্ব ওঠে আসবে, এমন ভাষ্য বিশ্লেষকদের।
কালের আলো/এমএসএকে/এমএএএমকে