কঠিন চীবর দান উৎসবে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি, সবাই মিলে সুন্দর দেশ গড়ার অঙ্গীকার সেনাপ্রধানের
প্রকাশিতঃ 10:54 pm | November 08, 2024
এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, অ্যাকটিং এডিটর:
রাজধানীর মেরুল বাড্ডায় আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ বিহারে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা আর ধর্মীয় ভাবগম্ভীর পরিবেশে কঠিন চীবর দান উৎসব। একই সঙ্গে জাতীয় বৌদ্ধধর্মীয় মহাসম্মেলন। সতত সুখের ও আনন্দের এই উৎসব সব সংকীর্ণতা ও ভেদাভেদ ভুলে একে অপরের সঙ্গে মিলিত হওয়ার শক্তিকে করেছে জাগ্রত। ঈদ থেকে শুরু করে দুর্গাপূজা, বড়দিন, বুদ্ধপূর্ণিমা বা কঠিন চীবর দান-ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানকে ছাপিয়ে যেন ঘোষণা করে মানুষে মানুষে মিলনের আহ্বান। পরস্পরের বন্ধুত্বপূর্ণ প্রতিবেশী হয়ে ওঠার এক অমোঘ বার্তা। প্রমাণ করে বাংলাদেশের চেয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ বিশ্বের আর কোথাও নেই।
বাংলাদেশ বুদ্ধিস্ট ফেডারেশনের আয়োজনে শুক্রবার (০৮ নভেম্বর) বিকেলে কঠিন চীবর দান উৎসব ও জাতীয় বৌদ্ধধর্মীয় মহাসম্মেলনে উৎসবের সঙ্গে শান্তির গভীর যোগসূত্র, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, সম্মান আর সহমর্মিতা যে উৎসবের আনন্দকে অনেক গুণ বাড়িয়ে দেয় সেটিও যেন অনুরণিত হয়েছে অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এর কণ্ঠে। তিনি এই অনুষ্ঠানস্থলেই ঘটে যাওয়া ধর্মীয় সম্প্রীতি ও মমত্ববোধের অনুকরণীয় এক উদাহরণ তুলে আনেন নিজের জবানীতে। নিজ নিজ সম্প্রদায়ের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি অতল শ্রদ্ধায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি উপস্থাপনে তিনি বলতে থাকেন-‘যখন আজান হচ্ছিল, তখন তাঁরাই বললেন যে কিছুক্ষণ পরে শুরু করি, আজানটা শেষ হয়ে যাক। এই যে ধর্মীয় বোঝাপড়া (আন্ডারস্ট্যান্ডিং), ধর্মীয় সম্প্রীতি, মমত্ববোধ দেখিয়েছেন, এটা অতুলনীয়।’
সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের মন্ত্রে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সব ধর্ম, ইসলাম-বৌদ্ধ-হিন্দু-খ্রিষ্টান, সবাই মিলে সুন্দর বাংলাদেশ গড়তে চান জানিয়ে বলেছেন, ‘অন্য যেসব ধর্ম আছে, সব ধর্ম, জাতি ও গোষ্ঠী সবাই মিলে সুন্দর বাংলাদেশ গঠন করতে চাই। এখানে সুন্দরভাবে শান্তিতে বসবাস করতে, দেশ ও জাতির উন্নতি করতে চাই।’
বৌদ্ধ শাস্ত্র মতে, প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে ভগবান গৌতম বুদ্ধের জীবদ্দশায় এই ধর্মীয় আচার প্রবর্তিত হয়। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সূতা কাটা শুরু করে কাপড় বয়ন, সেলাই ও রঙ করাসহ যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের দান করা হয়ে থাকে বলে একে কঠিন চীবর দান হিসেবে অভিহিত করা হয়। বুদ্ধিস্ট ফেডারেশন জানায়, তিন মাস বর্ষাবাস শেষে শুভ কঠিন চীবর দান বৌদ্ধদের জাতীয় জীবনে উৎসবমুখর পরিবেশের পাশাপাশি এক মহান ধর্মীয় অনুভূতির সৃষ্টি করে। উৎসবের বর্ণাঢ্যতায় কঠিন চীবর দান বাংলাদেশ তথা সমগ্র বিশ্বের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব। শুক্রবার (০৮ নভেম্বর) দিনব্যাপী অনুষ্ঠানমালার মাধ্যমে উদযাপন করা হয় চলতি বছরের শুভ কঠিন চীবর দান ও জাতীয় বৌদ্ধ মহাসম্মেলন।
বাংলাদেশ বৌদ্ধ ফেডারেশনের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক সুকোমল বড়ুয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশে নিযুক্ত থাইল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত মাকাওয়াদি সুমিতমোর, ভিয়েতনামের রাষ্ট্রদূত ন্যুয়েন মান কুঅং এবং অস্ট্রেলিয়ার ডেপুটি হাইকমিশনার নারদিয়া সিম্পসন। এ সময় সেনাবাহিনীর নবম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি ও সাভারের এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল মঈন খানসহ উর্ধ্বতন সেনা কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। চলতি বছর পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সারাদেশে ২৬৬টি বৌদ্ধ বিহারে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে শুভ কঠিন চীবর দান উৎসব অনুষ্ঠিত হয়েছে।
আন্ত:বাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানায়, অনুষ্ঠানে সেনাপ্রধান সারা দেশব্যাপী বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী আয়োজিত অনুষ্ঠানসমূহ শান্তিপূর্ণভাবে উদযাপনে সেনাবাহিনীসহ সকল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা করায় বুদ্ধিস্ট ফেডারেশনের সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান। এর আগে গত ১০ অক্টোবর সেনাসদরে সেনাবাহিনী প্রধানের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন বাংলাদেশ বুদ্ধিস্ট ফেডারেশনের প্রতিনিধি দল। ওই সময় সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান তিন পার্বত্য জেলায় শুভ প্রবারণা পূর্ণিমা ও কঠিন চীবর দান উদযাপন উপলক্ষে আর্থিক ও নিরাপত্তা সহযোগিতা প্রদানের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। এছাড়া ব্যক্তিগতভাবে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে উৎসবসমূহ পালন করার জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আশ্বাস প্রদান করেন। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চিফ অব জেনারেল স্টাফ (সিজিএস) লেফটেন্যান্ট জেনারেল মিজানুর রহমান শামীম বাংলাদেশ বুদ্ধিস্ট ফেডারেশনের অনুকূলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এক কোটি টাকার চেক অনুদান হিসেবে প্রদান করেন।
অহিংসা, মৈত্রী ও সাম্যই যেন মূল উপজীব্য, সবাইকে আন্তরিক অভিনন্দন সেনাপ্রধানের
বিশ্ব পরিণ্ডলেও বাংলাদেশ ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির একটি উজ্জ্বল নজির। যেখানে সব ধর্মের লোক যুগ যুগ ধরে শান্তিতে বসবাস করে আসছে। সবার মাঝে গড়ে উঠেছে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন। এদেশের সংস্কৃতির অনন্য বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রতিটি ধর্মীয় উৎসবে অন্য ধর্মের মানুষের আন্তরিক অংশগ্রহণ ও উৎসবের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়ার প্রবণতা। মানুষের কল্যাণসাধনই সব ধর্মের মূল শিক্ষা। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে সবার মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন এখন আরও দৃঢ় ও মজবুত। আন্তর্জাতিক বৌদ্ধবিহারে পবিত্র কঠিন চীবর দান উৎসব ও জাতীয় বৌদ্ধধর্মীয় মহাসম্মেলনেও অহিংসা, মৈত্রী ও সাম্যই যেন মূল উপজীব্য হয়ে ওঠে। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সবাইকে শুভ কঠিন চীবর দান উপলক্ষে আন্তরিক অভিনন্দন জানান। সেই সঙ্গে পার্বত্য জেলাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আগত সকলকে ধন্যবাদ জানান।
সারা দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে বৌদ্ধধর্মের অনুসারীরা উৎসব পালনে এখানে সমবেত হয়েছেন জানিয়ে সেনাপ্রধান বলেন, ‘আমরা দেখতে চাই, এভাবেই প্রতিনিয়ত, প্রতি সময় আপনারা আপনাদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলো পালন করবেন। সুখে-শান্তিতে থাকবেন। এজন্য যা কিছু করতে হয়, আমরা সেটা করব। এর আগে দূর্গাপূজাতেও আমরা নিরাপত্তা দিয়েছি। খুব সুন্দরভাবে তা উদ্যাপন করা হয়েছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আপনারা যখনই যে ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা চাইবেন, আমরা সেটা প্রদান করব।’
বৌদ্ধধর্মের মূলমন্ত্র শান্তি ও সম্প্রীতি; একে অপরের প্রতি সহমর্মিতা প্রদর্শনের আহ্বান
বৌদ্ধধর্মের মূলমন্ত্র শান্তি ও সম্প্রীতি উল্লেখ করে সেনাপ্রধান বলেন, ‘হাজার হাজার বছর ধরে আমরা এখানে আছি, এটাই আমাদের ঐতিহ্য। সবচেয়ে পুরোনো ধর্ম হচ্ছে সনাতন ধর্ম, তারপরে বৌদ্ধধর্মের আবির্ভাব হয় আড়াই হাজার বছর পূর্বে, পরবর্তীতে খ্রিষ্টধর্ম আসে এবং ইসলাম সবচেয়ে শেষে আমাদের দেশে আসে। এই প্রধানতম চার ধর্ম, আমরা অত্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করতে চাই। একে অপরকে সাহায্য করব, সহমর্মিতা প্রদর্শন করব; কারও কোনো অসুবিধা হলে, বিপদে পড়লে সাহায্য করব। এভাবে একটা সম্প্রীতির একটি দেশ গড়ে তুলতে চাই। সবাই মিলে ভালো থাকতে, সুখে-শান্তিতে থাকতে চাই।’
অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের উদ্দেশে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বলেন, ‘এখানে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনারদের দেখে ভালো লাগছে। বিশেষ করে থাইল্যান্ডের রাষ্ট্রদূতকে দেখে। তাঁরা এ দেশে অনেক বৌদ্ধমন্দির তৈরিতে আর্থিক সহায়তা করেছেন। বাংলাদেশের বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের জন্য এটা চমৎকার অবদান। এখানে ভিয়েতনাম ও অস্ট্রেলিয়ার হাইকমিশনারও আছেন। তাঁরাও বাংলাদেশে শান্তি-সম্প্রীতির জন্য অবদান রাখছেন।’
পাহাড়ে একসঙ্গে বসবাস করবে পাহাড়ি-বাঙালি
তিন পার্বত্য জেলা নিয়ে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান আরও বলেন, ‘পার্বত্য জেলায়, বিশেষ করে যেহেতু এখানে আমাদের একটু শান্তি-সম্প্রীতির কিছুটা ঘাটতি আছে, সেদিকটা পুষিয়ে নিতে চাই। একটি সুন্দর পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাই। পাহাড়ে সবাই পাহাড়ি-বাঙালি যেন একসঙ্গে বসবাস করতে পারি।’ তিনি নিজেও পার্বত্য জেলায় দায়িত্ব পালন করে এসেছেন জানিয়ে বলেন, ‘আপনাদের প্রতি আমার মমত্ববোধ-ভালোবাসা আছে। পার্বত্য জেলার শান্তির জন্য যা কিছু প্রয়োজন, আমাকে যদি বলা হয়, আমি সেটা করব। পার্বত্য জেলায় পাহাড়ি-বাঙালি, সবাই যেন সুন্দরভাবে বাস করতে পারি, সেই চেষ্টা আমার জারি থাকবে।’
সেনাপ্রধান বলেন, ‘আপনাদের (পাহাড়ি জনগোষ্ঠী) একটা ভাষা–সংস্কৃতি আছে। আমরা এটাকে সম্মান করতে চাই। সংস্কৃতি, ভাষা ও জীবন–বৈচিত্র্য, এটাকে আমরা রক্ষা করতে চাই। এটা আমাদের বিশাল বড় সম্পদ। এগুলোকে সংরক্ষণ করার জন্য যা কিছু করতে হয়, আমরা করব।’ পার্বত্য অঞ্চলে পর্যটন ও পাহাড়িদের শিক্ষার সুযোগ তৈরির বিষয়ে জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান আরও বলেন, ‘পার্বত্য জেলাগুলো চমৎকার প্রাকৃতিক দৃশ্যসংবলিত। এখানে পর্যটকদের গন্তব্য হতে পারে। পর্যটকদের আকর্ষণ করবে, এমন অনেক কাজ করার আছে। আর সেখানে স্কুল-কলেজ, মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় করলে পাহাড়ি ভাইবোনেরা সুন্দরভাবে সেখানে পড়াশোনা করতে পারবেন। পরবর্তী সময়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় দেশ-বিদেশে তাঁদের দক্ষতা নিয়ে ছড়িয়ে যেতে পারবেন।’
কালের আলো/এমএএএমকে