শাহজালালে দুই চীনা নাগরিককে ছেড়ে দেওয়ার ‘অপতথ্য’; এভসেককে ‘বিতর্কিত’ করতেই কী এমন ‘অপপ্রচার’?
প্রকাশিতঃ 7:37 pm | November 12, 2024
রাইসুল ইসলাম খান, কালের আলো:
পারিবারিক সম্মতিতেই চীনা নাগরিক মে পেনগাইকে বিয়ে করেন বাংলাদেশী মালিনা মারাক (১৯)। গত ২৬ অক্টোবর তাদের একত্রে দেশত্যাগের কথা ছিল। কিন্তু হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে চায়না ইস্টার্ন ফ্লাইটে উড়াল দেওয়ার আগে মন ঘুরে যায় মালিনার। চীনে যেতে মন সায় না দেওয়ায় কাঁদতে শুরু করেন। দূর থেকে এই দৃশ্য দেখে ছুটে যান আকস্মিক বিমান বন্দরে উপস্থিত রানী আক্তার। তিনি উত্তরার একটি চাইনিজ কোম্পানির পরিচ্ছন্নতাকর্মী। পুরো ঘটনা শুনে এই নারী কথা বলেন মালিনার সঙ্গে। ডিপারচার এলাকায় চায়না ইস্টার্ন ফ্লাইটের চেক-ইন কাউন্টারের সামনে ঘটে যাওয়া এই ঘটনার খবর পেয়ে দ্রুত সেখানে উপস্থিত হন সিভিল এভিয়েশন নিয়ন্ত্রিত এভিয়েশন সিকিউরিটি (এভসেক)।
দু’চীনা নাগরিক মে পেনগাই (পাসপোর্ট নম্বর ঊগ৪৪৮৩৭০৯) ও তিয়ান জেংওয়েনকে (পাসপোর্ট নম্বর ঊঔ৪৩৭৪২৯৯) এবং বাংলাদেশি দুই তরুণী মালিনা মারাক (পাসপোর্ট নম্বর অ১৪৭৬৬৮৮৯) ও ২৬ বছর বয়সী রানী আক্তার (পাসপোর্ট নম্বর অ১৫২৭১৮৪৪) কে নিরাপত্তা হেফাজতে নিয়ে যান। ঘটনার নিরিখে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে প্রথমে বিমান বন্দরের বিজ্ঞ ম্যাজিষ্ট্রেট ও ইমিগ্রেশন পুলিশের দ্বারস্থ হয় এভসেক। তাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশে সোপর্দ করতে উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। কিন্তু এপিবিএন বিষয়টি মানবপাচার অপরাধ সংক্রান্ত হওয়ায় এভসেকের সদস্যদের মানবপাচার সংশ্লিষ্ট শাখায় যোগাযোগ করার অনুরোধ করেন। এরপর সিআইডির মানবপাচার সেলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তাঁরা মালিনা মারাককে বিস্তর জিজ্ঞাসাবাদ শেষে এ ঘটনায় তাকে মামলা দায়েরের পরামর্শ দেন। কিন্তু এতেই বেঁকে বসেন ওই নারী।
- ডেটলাইন ২৬ অক্টোবর
- সেই মালিনা মারাককে সিআইডির মানবপাচার সেলের বিস্তর জিজ্ঞাসাবাদ
- পারিবারিকভাবেই বিষয়টির আপোস রফার সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন মালিনা
- এভসেক’র হাতে মালিনা ও পেনগাই’র বিয়ের কাবিননামা সংরক্ষিত
- মালিনার পাশাপাশি লিখিত বক্তব্য দিয়েছেন বোনের স্বামীর টিউপল সাংমাও
কোন রকম মামলা মোকদ্দমায় না জড়িয়ে পারিবারিকভাবেই বিষয়টির আপোস রফার সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন মালিনা। এরপর এভসেক দুই চীনা নাগরিক ও বাংলাদেশি দুই তরুণীকে এপিবিএন অফিসে জিম্মায় রাখে। এ ঘটনায় থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করা হয়, যার নম্বর ৩৩৮, তারিখ ২৬/১০/২০২৪)। পরে তাদেরকে এভসেক’র কাছে হস্তান্তর করা হয়। এভসেক’র পক্ষ থেকে মালিনা মারাক এর পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। এ সময় মালিকানা মারাক এর বোনের স্বামী টিউপল সাংমা’র কাছে হস্তান্তর করা হয়। তিনিও মামলা করতে অপারগতা প্রকাশ করে একটি লিখিত বক্তব্য প্রদান করেন। এরপর ওইদিন রাত ১২টার দিকে বাংলাদেশি ও চীনা যাত্রীদের ছেড়ে দেওয়ার পর সবাই আগমনী ক্যানোপি-২ দিয়ে টার্মিনাল বিল্ডিংয়ের বাইরে চলে যান। মালিনা ও মে পেনগাই এর বিয়ের কাবিননামা সংরক্ষিত রয়েছে এভসেক’র হাতে।
পুরো ঘটনা প্রবাহ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, কার্যত দুই নারীকে চীনে পাচারের চেষ্টার খবরটি নিছক প্রোপাগাণ্ডা। শুধুমাত্র সিভিল এভিয়েশন নিয়ন্ত্রিত এভিয়েশন সিকিউরিটিকে (এভসেক) বিতর্কিত করতেই দুই চীনা নাগরিককে ছেড়ে দেওয়ার অপপ্রচার চলছে বলেও অভিযোগ ওঠেছে। এ বিষয়ে এভসেকের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশে আপত্তি জানিয়ে কালের আলোকে বলেন, ‘ওইদিনের ঘটনার সঙ্গে মানব পাচারের কোন সম্পৃক্ততা নেই। মূলত এভসেক’র সুনাম ক্ষুণ্ন করতেই পরিকল্পিতভাবে অপতথ্য ছড়ানো হচ্ছে। আমরা আমাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করছি।’
একই সূত্র বলছে, বিভিন্নভাবে এই ঘটনায় দু’জন নারীকে পাচারের কথা বলা হলেও প্রকৃত অর্থে মালিনা মারাকের সঙ্গে রানী আক্তারের কোন পূর্ব পরিচয় ছিল না। তিনি সেদিন চায়না ইস্টার্ন ফ্লাইটের চেক-ইন কাউন্টারের সামনে এসেছিলেন মূলত একটি চাইনিজ কোম্পানির কর্মরতদের বিদায় জানাতে। মালিনা মারাকের কান্নার ঘটনা অবলোকন করে পরিস্থিতি জানতে তিনি তাঁর কাছে এগিয়ে যান। এ সম্পর্কিত পুরো বিষয়াদি মালিনার লিখিত বক্তব্যে উল্লেখ করা আছে। এই বক্তব্য এভসেক’র হাতে রয়েছে।
সূত্র জানায়, দেশের সবচেয়ে বড় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের নিরাপত্তার দায়িত্ব বাংলাদেশ বিমান বাহিনী ও সিভিল এভিয়েশন নিয়ন্ত্রিত এভিয়েশন সিকিউরিটিকে (এভসেক) দেওয়ার পর থেকেই চলছে একের পর এক ষড়যন্ত্র। যাত্রীদের লাগেজ হারিয়ে যাওয়া, লাগেজ ভাঙা এবং লাগেজ পেতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় লাগাসহ নানা ধরনের ভোগান্তির দীর্ঘদিনের অভিযোগের অবসান ঘটিয়ে বিমানবন্দরটি খোলনলচে নিজেদের পাল্টে ফেলে যাত্রীদের মনজয় করে ইতিবাচক ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করলেও ঘাপটি মেরে থাকা ফ্যাসিবাদের দোসররা চলমান পরিবর্তনের অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে ভেতরে-বাইরে অপপ্রচার অব্যাহত রেখেছে। এর মাধ্যমে তাঁরা প্রতিনিয়ত ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের অপচেষ্টা চালাচ্ছে বলেও অভিযোগ ওঠেছে।
জানা যায়, এয়ারপোর্ট আর্মড পুলিশ (এপিবিএন) গত ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর স্বেচ্ছায় হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরকে অরক্ষিত রেখে চলে যায়। বিমানবন্দরটির সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায় প্রায় ৬ ঘণ্টা শাহজালালে সেদিন বিমান উড্ডয়ন-অবতরণ বন্ধ থাকে। পরে শাহজালালের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে বিমান বাহিনীকে দায়িত্ব পালনে অনুরোধ জানায় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক)। বিমান বাহিনী ও এভসেক’র যৌথ প্রয়াসে শাহজালাল বিমান বন্দরের অনিয়ম, দুর্নীতি, পদে পদে হয়রানিসহ ইত্যাকার অভিযোগের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। মানোন্নয়ন ঘটে যাত্রীসেবার। নিশ্চিত হয় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা। এতে করে বিমান বাহিনী ও বেবিচক যাত্রীদের প্রশংসায় ভাসলেও মাথাব্যাথা শুরু হয়েছে একটি পক্ষের। তাঁরা নন ইস্যুকে ইস্যু করে নিরাপত্তা পরিস্থিতিকে ঘোলাটে দেখাতে ঘৃণ্য কায়দায় বেসুমার অপতথ্যে পরিবর্তনের পথযাত্রাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপতৎপরতা শুরু করেছে।
তবে এসব বিষয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মঞ্জুর কবীর ভুইঁয়া কালের আলোকে বলেন, ‘বিশ্বের সব বিমানবন্দরই এভিয়েশন সিকিউরিটির আওতায়। হযতর শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরও তাঁর ব্যতিক্রম নয়। আমরা এভসেক’র সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে জোর দিয়েছি। বর্তমানে এভসেকের প্রায় দেড় হাজার সদস্য রয়েছে। আমরা সদস্য আরও বাড়ানোর প্রক্রিয়া শুরু করেছি। সব মিলিয়ে প্রায় সাড়ে তিন হাজারের মতো সদস্য থাকবে। তখন এয়ারসাইট ও আউটার সাইট সবদিকেই এভসেকের সদস্যরা দায়িত্ব পালন করবেন। বর্তমানেও এখানে দায়িত্ব পালনে কোন রকম সমস্যা হচ্ছে না। সবাই সম্মিলিতভাবেই নিজেদের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। সবার প্রচেষ্টায় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পরিবর্তন এখন দৃশ্যমান।’
কালের আলো/আরআই/এমকে