সশস্ত্র বাহিনী দিবসে সেনাকুঞ্জে নক্ষত্রের মেলা, সশস্ত্র বাহিনীকে জনগণের আস্থা-বিশ্বাসের প্রতীক হিসেবে স্বীকৃতি প্রধান উপদেষ্টার
প্রকাশিতঃ 11:22 pm | November 21, 2024
এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, অ্যাকটিং এডিটর, সেনাকুঞ্জ থেকে :
ঝা চকচকে মঞ্চ। লাল গালিচায় পা মাড়িয়ে যাচ্ছেন প্রত্যেকেই। শীতল অনুভূতিতে সোনাঝরা রোদ্দুর। জাঁকজমকভাব চারিদিকে। বর্ণিল সাজে সুসজ্জিত ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের সেনাকুঞ্জ। বৃহস্পতিবার (২১ নভেম্বর) সশস্ত্র বাহিনী দিবসের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। দেশবরেণ্য রাজনীতিক, খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা, শিক্ষাবিদ, গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, সংস্কৃতিসেবী, ব্যবসায়ী, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের প্রধান থেকে শুরু করে কে ছিলেন না অনন্য আয়োজনটিতে? বিভিন্ন শ্রেণী পেশার উজ্জ্বল সব নক্ষত্রের উপস্থিতি। তাদের মহাসম্মিলনে গোটা অনুষ্ঠান হয়ে ওঠলো আরও রঙিন। অবারিত আনন্দের এক ফল্গুধারা।
যেন সব নক্ষত্রকে একীভূত করেছে দেশপ্রেমিক সশস্ত্র বাহিনী। স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টা ড.মুহাম্মদ ইউনূস অভ্যাগতদের এই মিলনমেলাকে অভিহিত করলেন মহাসম্মিলন ও বাংলাদেশের নক্ষত্রসমূহ হিসেবে। তাঁর ভাষ্যে-‘বাংলাদেশের ‘নক্ষত্রসমূহকে’ এক যোগে এই মহাসম্মিলনে আনতে পেরেছেন, সেটা দেখে অবাক লাগছে আজকে। অত্যন্ত আনন্দিত বোধ করছি আপনাদের সবাইকে দেখে।’ আলোকোজ্জ্বল অনুষ্ঠানটি ছিল চমকে ঠাসা। প্রায় এক যুগ পর সশস্ত্র বাহিনী দিবসের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার স্বশরীরে উপস্থিতি, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তাঁর হাস্যোজ্জ্বল কুশল বিনিময় মন ছুঁয়েছে সবার। অনুষ্ঠানে যোগ করেছে বাড়তি মাত্রা। অতিথিদের একে অপরের সঙ্গে সাধ মিটিয়ে ছবি তোলার দৃশ্য। পোজ দিতে ক্লান্ত নন। ভালো লাগা আর আনন্দের নির্যাস নিতে ভুলেননি কেউই। নতুন দিনের নতুন স্বপ্নে বিভোর প্রত্যেকেই।
সশস্ত্র বাহিনী দিবসে সেনাকুঞ্জে আয়োজিত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বিকেল ৩টা ৫৫ মিনিটে অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছান অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড.মুহাম্মদ ইউনূস। ঠিক ৪টায় জাতীয় সংগীতের মধ্য দিয়ে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান শুরু হয়। তারপর প্রধান উপদেষ্টা গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। এ সময় তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে ছিলেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল এম নাজমুল হাসান, বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন ও সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) লেফটেন্যান্ট জেনারেল এস এম কামরুল হাসান। প্রধান উপদেষ্টা তাঁর বক্তব্যে সশস্ত্র বাহিনী দেশের জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতীক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে বলে মন্তব্য করেন।
- সঙ্কটকালে সশস্ত্র বাহিনী দেশের জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে
- যেই নক্ষত্র সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে আছে তাদেরকে সালাম
- সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের উন্নত প্রশিক্ষণ ও আধুনিক প্রযুক্তি সংযুক্তির প্রয়াস অব্যাহত
- মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নপূরণে অঙ্গীকারাবদ্ধ
- প্রতিবেশীসহ সব রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ শ্রদ্ধাশীল সহযোগিতা কামনা
তিনি বলেন, ‘সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন ও এর পরবর্তী সময় এবং সঙ্কটকালে সশস্ত্র বাহিনী দেশের জনগণের পাশে দাঁড়িয়েছে। ছাত্র-ছাত্রী এবং সাধারণ জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে সশস্ত্র বাহিনী আবারও দেশের জনগণের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাসের প্রতীক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।’ সশস্ত্র বাহিনীর অবদান স্মরণ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘স্বাধীনতার পর থেকে সশস্ত্র বাহিনী জনগণের পাশে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্র নির্মাণ, দুর্যোগ মোকাবিলা, দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজে নিয়োজিত রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালের এই দিনে বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী এবং সাধারণ মানুষ এক হয়ে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে আক্রমণ চালিয়েছিল।’ তিনি বলেন, ‘২১ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধের একটি মাইলফলক হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।’ প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘সশস্ত্র বাহিনী ১৯৭১ সালের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে জন্ম লাভ করে, যেখানে সেনা, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর সদস্যরা সাধারণ মানুষের সঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণ চালিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় সশস্ত্র বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা প্রশিক্ষণও দিয়েছে।’
তিনি বলেন, এই বিশেষ দিনে ‘আমি গভীরভাবে স্মরণ করছি মুক্তিযুদ্ধের শহীদ এবং সব সাহসী মুক্তিযোদ্ধাকে, বিশেষ করে যাদের আহত করা হয়েছিল’। এসময় প্রধান উপদেষ্টা জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের সব শহীদ এবং আহতদের স্মরণ করেন। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘তাদের আত্মত্যাগ দেশ পুনর্গঠনের নতুন সুযোগ সৃষ্টি করেছে এবং জাতি চিরকাল তাদের এই ত্যাগকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।
সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার উপস্থিত হওয়ায় তাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘আমরা বিশেষভাবে সৌভাগ্যবান এবং সম্মানিত যে বাংলাদেশের তিনবারের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া আজ আমাদের মাঝে উপস্থিত আছেন।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘বাংলাদেশের ‘নক্ষত্রসমূহকে’ এক যোগে এই মহাসম্মিলনে আনতে পেরেছেন, সেটা দেখে অবাক লাগছে আজকে। অত্যন্ত আনন্দিত বোধ করছি আপনাদের সবাইকে দেখে। আর যে ‘নক্ষত্ররা’ শরিক হতে পারেন নাই, জায়গার অভাবে জায়গা দিতে পারেন নাই তাদের কাছে দুঃখ প্রকাশ করছি। যেই নক্ষত্র সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে আছে তাদেরকে এখানে সবার পক্ষ থেকে সালাম জানাচ্ছি।’
বক্তব্যের শুরুতে ইউনূস মুক্তিযুদ্ধের বীর শহীদ ও যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও নির্যাতিতা নারীদেরকে স্মরণ করেন। পরে তিনি জুলাই-আগস্ট মাসের গণঅভ্যুত্থানে নিহত ও আহতদের দুঃসাহসিক আত্মত্যাগ ও সাহসের কথা উল্লেখ করেন। ‘দেশ পুনর্গঠনের’ একটি ‘নতুন সুযোগ’ সৃষ্টি হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘তাদের এই আত্মত্যাগ জাতি চিরদিন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।’
সশস্ত্র বাহিনী দেশের মানুষের কাছে ‘আস্থার প্রতীক’ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে মন্তব্য করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে এবং তৎপরিবর্তিত সময়ে দেশের ক্রান্তিলগ্নে সশস্ত্র বাহিনী বরাবরের মত মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। দেশের ছাত্র জনতা ও সাধারণের পক্ষে দাঁড়িয়ে সশস্ত্র বাহিনী আবারও দেশের মানুষের কাছে আস্থার প্রতীক হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে।’
প্রতিবেশীসহ সব রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ শ্রদ্ধাশীল সহযোগিতা কামনা করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘বাংলাদেশে শান্তিপ্রিয় এক দেশ। প্রতিবেশীসহ সকল রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ শ্রদ্ধাশীল সহযোগিতার মাধ্যমে সহাবস্থানই আমাদের মূল লক্ষ্য। তথাপি যেকোনো আগ্রাসী বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য আমরা সদা প্রস্তুত এবং দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ।’
সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের উন্নত প্রশিক্ষণ ও আধুনিক প্রযুক্তি সংযুক্তির প্রয়াস অব্যাহত রয়েছে বলে জানান প্রধান উপদেষ্টা। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে দক্ষতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের কাজের প্রসঙ্গও উঠে আসে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘শান্তি ও নিরাপত্তা বজায় রাখার প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ একটি দায়িত্বশীল ও নির্ভরযোগ্য নাম। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীরা ৪৩টি দেশে ৬৩টি মিশন সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছে। বর্তমানে ১২ মিশনে শান্তিরক্ষীরা নিয়োজিত আছেন। বাংলাদেশ বর্তমানে অন্যতম বৃহৎ নারী শান্তিরক্ষী প্রেরণ কারী দেশ হিসেবে বিশ্বে পরিচয় লাভ করেছে।’
মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নপূরণে অঙ্গীকারাবদ্ধ
এর আগে সকালে সশস্ত্র বাহিনী দিবস উপলক্ষে ঢাকা সেনানিবাসে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগ দেন প্রধান উপদেষ্টা ড.মুহাম্মদ ইউনূস। এ সময় তিনি বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা বৈষম্যহীন, শোষণহীন, কল্যাণময় এবং মুক্ত বাতাসের যে স্বপ্ন নিয়ে রাষ্ট্রকে স্বাধীন করেছিলেন, আমি তাঁদের সেই স্বপ্ন পূরণে অঙ্গীকারবদ্ধ। আমরা এখন থেকে বাংলাদেশকে এমনভাবে গড়তে চাই, যেখানে সত্যিকার অর্থে জনগণই হবেন সব ক্ষমতার মালিক।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘জুলাই-আগস্ট ছাত্র– জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে আমরা নতুন বাংলাদেশের সূচনা করেছি। এ নতুন দেশে আমাদের দায়িত্ব সব মানুষকে এক বৃহত্তর পরিবারের বন্ধনে আবদ্ধ করা। কেউ কারও ওপরে না, আবার কেউ কারও নিচেও না; এই ধারণা আমরা আমাদের জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই।’
বিশ্বদরবারে মানবিক ও কল্যাণকর রাষ্ট্র হিসেবে সমাদৃত বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘আমরা সব দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রাখব। আমাদের পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি হবে পারস্পরিক সম্মান, আস্থা, বিশ্বাস ও সহযোগিতা। জলবায়ু সংকট মোকাবিলা এবং বৈশ্বিক শান্তি ও অর্থনীতি সুসংহতকরণে আমাদের একত্রে কাজ করতে হবে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।’
প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া সব বাহিনীকে ‘বাংলাদেশ ফোর্সেস’ নামে সাংগঠনিক রূপ দেওয়া হয়। সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে সশস্ত্র বাহিনীর নেতৃত্বে যুদ্ধ পরিচালিত হয়। মাত্র দুটি গানবোট ‘পদ্মা’ ও ‘পলাশ’ নিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনী জলপথে যুদ্ধ শুরু করে। এ ছাড়া পাকিস্তান নৌবাহিনীতে কর্মরত বাংলাদেশি সাবমেরিনার এবং নাবিকদের সমন্বয়ে গড়ে তোলা অকুতোভয় নৌ কমান্ডো দল ‘অপারেশন জ্যাকপট’ নামক দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করে বিভিন্ন নদীবন্দরে খাদ্য ও রসদবোঝাই শত্রুজাহাজ ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হয়।’
তিনি বলেন, ‘বিমানবাহিনীর সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত ‘কিলো ফ্লাইট’ চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জের জ্বালানি ডিপোসহ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় সফল অভিযান পরিচালনা করে। মুক্তিযুদ্ধে সশস্ত্র বাহিনীর এই অবদানকে সাধারণ মানুষের আত্মত্যাগের সঙ্গে একীভূত করার উদ্দেশ্যে প্রতিবছর ২১ নভেম্বর পালিত হয় সশস্ত্র বাহিনী দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর অকুতোভয় সদস্য এবং বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ সম্মিলিতভাবে দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সমন্বিত আক্রমণ সূচনা করে। সেই আক্রমণের ফলে আমাদের বিজয় ত্বরান্বিত হয় এবং এর ফলে আমরা স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জন করি।’
কালের আলো/এমএএএমকে