আগরতলার হাইকমিশনে ভাঙচুর ও মমতার বক্তব্যে ক্ষুব্ধ বাংলাদেশ
প্রকাশিতঃ 10:35 pm | December 02, 2024
কূটনৈতিক প্রতিবেদক, কালের আলো:
ভারতের ত্রিপুরার আগরতলার কুঞ্জবনে অবস্থিত বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশন প্রাঙ্গণে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় ক্ষুব্ধ ঢাকা। অবিলম্বে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ। সোমবার (২ ডিসেম্বর) রাতে এক বিবৃতিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতের সরকারের কাছে এমন আহ্বান জানিয়েছে। এক্স-বার্তার (সাবেক টুইটার) প্রতিবাদটি মাধ্যমে করা হয়েছে এবং সেখানে হ্যাশট্যাগ করা হয়েছে ইন্ডিয়াকে। এর আগে ভারত নিয়ে কয়েকবার টুইট করা হলেও প্রথমবারের মতো ‘হ্যাশট্যাগ ইন্ডিয়া’ ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলাদেশ ও ভারতের চলমান অস্বস্তিকর সম্পর্ক এবার ডিজিটাল মাধ্যমে গড়িয়েছে। যদিও হামলা-ভাঙচুরের ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করেছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
এরই মধ্যে আবার বাংলাদেশে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী পাঠাতে ভারত সরকারকে উদ্যোগ নিতে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী উস্কানিমূলক বক্তব্য দিয়েছেন। এ বক্তব্যেও তীব্র আপত্তি জানিয়েছে ঢাকা। অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন তাঁর এই বক্তব্যকে ‘সঠিক পদক্ষেপ নয়’ বলে মন্তব্য করেছেন। সোমবার (২ ডিসেম্বর) বিকেলে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কূটনীতিকদের ব্রিফিংকালে তিনি বলেন, ‘মমতা ব্যানার্জীর বক্তব্যকে আমি ‘মমতা ব্যানার্জী ধরনের বক্তব্য’ হিসেবেই দেখতে চাই। কারণ, উনি এই বক্তব্য কেন দিলেন সেটি বুঝতে পারছি না। ব্যক্তিগতভাবে আমি তার সঙ্গে পরিচিত। তার বাসায় আমার যাতায়াত ছিল। আমি মনে করি এটি তার জন্য সঠিক পদক্ষেপ নয়।’
এদিকে, মমতার এই বক্তব্যকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি ‘হুমকিস্বরূপ’ বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি অবিলম্বে এ ধরনের বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন। সোমবার (২ ডিসেম্বর) রাতে লন্ডন থেকে দলের পক্ষে এমন প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব। মির্জা ফখরুল তার প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘পশ্চিমবঙ্গের মুখমন্ত্রী বাংলাদেশ সম্পর্কে যে উক্তি করেছেন সে বিষয়ে আমি বক্তব্য না রেখে পারছি না। তিনি (মমতা বন্দোপাধ্যায়) যে উক্তি করেছেন বাংলাদেশে শান্তিরক্ষী পাঠানোরৃ এটি সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকিস্বরূপ। আমরা মনে করি এই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে ভারতের নেতাদের যে দৃষ্টিভঙ্গি তা কিছুটা হলেও প্রকাশিত হয়েছে।’
জানা যায়, বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ এনে চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে সোমবার (২ ডিসেম্বর) বিক্ষোভ সমাবেশ ডাকে আগরতলার হিন্দুত্ববাদী একটি সমিতি। আগরতলা সার্কিট হাউসে অবস্থিত গান্ধী মূর্তির সামনে এই বিক্ষোভ সমাবেশ হয়। পরে বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে ৬ জনের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনে গিয়ে স্মারকলিপি দেয়। এক পর্যায়ে সমিতির বিক্ষুব্ধ সদস্যরা সহকারী হাইকমিশনের ভেতরে প্রবেশ করে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা নামিয়ে ফেলেন এবং সেই পতাকা ছিঁড়ে ফেলেন। এরপর ভবনের সামনে থাকা সাইনবোর্ড ভেঙে সেটিতে আগুন ধরিয়ে দেন।
এ ঘটনার পরপরই দুঃখ প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। বিবৃতিতে বলা হয়, আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশন প্রাঙ্গণে ভাঙচুরের ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক। কোনো অবস্থাতেই কূটনৈতিক এবং কনস্যুলার সম্পত্তি লক্ষ্যবস্তু করা উচিত নয়। ভাঙচুরের ঘটনায় কড়া প্রতিবাদ জানায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও।
বিবৃতিতে বলা হয়, আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশন প্রাঙ্গণে সোমবার স্থানীয় হিন্দু সংগ্রাম সমিতির বিক্ষোভকারীদের একটি বড় দল দ্বারা হিংসাত্মক বিক্ষোভ ও আক্রমণে বাংলাদেশ সরকার ক্ষুব্ধ। প্রাপ্ত তথ্য চূড়ান্তভাবে প্রমাণ করে যে, বিক্ষোভকারীদের পূর্ব পরিকল্পিত উপায়ে বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনের প্রধান ফটক ভেঙে প্রাঙ্গণে আগ্রাসনের অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। এ প্রক্রিয়ায় স্থানীয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্যদের উপস্থিতিতে তারা পতাকার খুঁটি ভাঙচুর করে। বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা অবমাননা করে এবং সহকারী হাইকমিশনের অভ্যন্তরের সম্পত্তিও ক্ষতিগ্রস্ত করে।
বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়, প্রাঙ্গণ রক্ষার দায়িত্বে থাকা স্থানীয় পুলিশ সদস্যরা শুরু থেকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় ছিল না। সহকারী হাই কমিশনের সব সদস্য গভীর নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। বাংলাদেশ সরকার আরও উল্লেখ করতে চায় যে, গত ২৮ নভেম্বর কলকাতায়ও বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনের ওপর এই ধরনের জঘন্য হামলা এবং বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার অবমাননা করা হয়। আগরতলার এই ঘটনা ১৯৬১ সালে ভিয়েনা কনভেনশন লঙ্ঘন করেছে। যেহেতু কূটনৈতিক মিশনগুলোকে যে কোনো ধরনের অনুপ্রবেশ বা ক্ষতি থেকে রক্ষা করা স্বাগতিক সরকারের দায়িত্ব, তাই বাংলাদেশ সরকার ভারত সরকারকে অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়ার লক্ষ্যে ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত করার জন্য আহ্বান জানায়। একই সঙ্গে ভারতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনের বিরুদ্ধে যে কোনো ধরনের সহিংসতা প্রতিরোধ, কূটনীতিক, অ-কূটনৈতিক সদস্য এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের আহ্বান জানায়।
বাংলাদেশ প্রতিবাদপত্রটি এক্স-বার্তার (সাবেক টুইটার) মাধ্যমে করেছে। এ বিষয়ে সাবেক একজন কূটনীতিক বলেন, ‘এখন হাইব্রিড যুদ্ধের যুগ। শুধু অস্ত্র ও গোলাবারুদ দিয়ে যুদ্ধ হয় না। এখন সাইবার স্পেসে যুদ্ধ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’ সামাজিক গণমাধ্যম বা প্রচলিত গণমাধ্যম ব্যবহার করেও জনমত গঠন করা হয় এবং এর একটি বিশেষ গুরুত্ব আছে বলে তিনি জানান। সোমবার (২ ডিসেম্বর) বিদেশি কূটনীতিকদের ব্রিফিং শেষে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘বাংলাদেশের বিরুদ্ধে গ্লোবাল ক্যাম্পেইন চলছে। কিছু নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান এই ক্যাম্পেইন চালাচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘গত কিছুদিনের বিশেষ করে হিন্দু সমাজের পরিস্থিতি নিয়ে আমরা চেয়েছিলাম যাতে কোনো ভুল ধারণা সৃষ্টি না হয়। কারণ ভুল ধারণা সৃষ্টি করার মতো প্রচুর পরিবেশ আছে, বিশেষ করে গণমাধ্যমের একাংশ। কোন দেশের সেটা আমি বলছি না। তারা এটাকে যতটুকু পারা যায় একটা খারাপ পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। কাজেই আমাদের মনে হয়েছে, এখানে কূটনীতিক যারা আছেন তাদের প্রকৃত অবস্থার ব্যাখ্যা দেওয়া উচিত। আমাদের অবস্থান পরিষ্কার করার জন্য তাদের ঢেকেছি, প্রায় সবাই এসেছেন’- যোগ করেন উপদেষ্টা।
তৌহিদ হোসেন বলেন, আমরা আমাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করেছি। আমি বলেছি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি হচ্ছে সমাজের অংশ, আর সরকার এটা বজায় রাখতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। কোনো মানুষ তার ধর্মীয় বা সাম্প্রদায়িক পরিচয়ের কারণে নিপীড়িত হবে না, এটা আমরা অবশ্যই নিশ্চিত করব। গত চার মাসে মালমসলা ছিল গন্ডগোল হওয়ার হতো, তবুও আমরা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছি সবার সহযোগিতায়।’ তিনি বলেন, তবে দুএকটা ঘটনা ঘটেছে। আমি এ লাইনে কূটনীতিকদের ব্রিফ করেছি, তাদের বলেছি বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িকভাবে একটা খারাপ অবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছি, এরকম পরিস্থিতি সৃষ্টির অভ্যন্তরীণ এবং দেশের বাইরের প্রচেষ্টা আছে। সেই প্রচেষ্টা যেন সফল না হয় সেই চেষ্টা করছি।
কালের আলো/এমএসএমকে