ভবিষ্যত নেতৃত্বের পরিকল্পনায় উজ্জ্বল তরুণ অফিসাররা, দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় প্রস্তুত থাকার নির্দেশ সেনাপ্রধানের
প্রকাশিতঃ 9:29 pm | December 03, 2024
এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, অ্যাকটিং এডিটর:
সাজ সাজ রব চারদিকে। সামরিক ছন্দে দৃষ্টিনন্দন প্যারেড। মঙ্গলবার (০৩ ডিসেম্বর) চট্টগ্রামের ভাটিয়ারিস্থ বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি (বিএমএ) প্যারেড গ্রাউন্ডে নতুনের অবগাহনে অন্যরকম এক আবহ। দুরন্ত গতিতে এগিয়ে চলেছেন তরুণ অফিসাররা। দৃষ্টিনন্দন পোশাক থেকে শুরু করে দুর্দান্ত শারীরিক কসরত, কী ছিল না সেখানে? দৃষ্টি জুড়িয়ে যায় বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে চৌকস প্যারেড অবলোকনে। দীর্ঘ ৩ বছরের কঠোর সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে ৮৭ বিএমএ দীর্ঘমেয়াদি কোর্সের ২১৩ জন অফিসার ক্যাডেট, ৫৯ বিএমএ স্পেশাল কোর্সের ১৪ জন অফিসার ক্যাডেট ও ৪ জন ট্রেইনি অফিসার বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। মনোজ্ঞ কুচকাওয়াজ পরিদর্শন ও প্যারেডের অভিবাদন গ্রহণ করেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান।
অবারিত আনন্দের স্রোতধারায়, ভাতৃত্বের সীসা ঢালা প্রাচীরের অবিচ্ছেদ্য এক বন্ধন। হৃদয় গহিনে আনন্দ-উচ্ছ্বাসের দোলায় অদম্য পরিণত মেধাবী তরুণ অফিসারদের পথনির্দেশকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমিতে ৮৭তম বিএমএ দীর্ঘমেয়াদি ও ৫৯তম বিএমএ স্পেশাল কোর্সের অফিসার ক্যাডেটদের রাষ্ট্রপতি কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে নিজের দীর্ঘ বর্ণাঢ্য সামরিক জীবনের অভিজ্ঞতায়, পেশাদারিত্বের গভীর নির্যাসে ও দূরদৃষ্টিতায় নির্মোহ বস্তুনিষ্ঠ এবং দিকনির্দেশনামূলক এক দীর্ঘ বক্তব্যই উপস্থাপন করলেন তিনি।
সাহসিকতার সঙ্গে সকল পরিস্থিতি মোকাবিলার পাশাপাশি দেশপ্রেমকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানালেন। নির্দেশ দিয়েছেন দেশের সার্বভৌমত্ব ও জনগণের জানমাল রক্ষায় নতুন ক্যাডেটদের সর্বদা নিজেকে উৎসর্গ করারও। বর্ণিল এই প্যারেডকে ঘিরে নিজের মুগ্ধতার কথা প্রকাশ করলেন সেনাপ্রধান। তিনি প্যারেডে অংশগ্রহণকারীদের অভিনন্দন জানান। নবীন নেতৃত্ব তৈরির লক্ষ্যে ফোর্সের প্রশিক্ষণ সফলভাবে সম্পন্ন করার জন্য বিএমএ’র কমান্ড্যান্ট ও সংশ্লিষ্টদের জানান আন্তরিক ধন্যবাদ।
অন্তরমথিত ভালোবাসায় সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান এর বক্তব্যে পরিপাটিভাবেই ওঠে এসেছে- একটি দক্ষ, আধুনিক এবং দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ সেনাবাহিনীর গুরুত্ব, মাতৃভূমির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষাই জীবনের প্রথম এবং প্রধানতম ব্রত এবং নিজ বাহিনীর গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস-ঐতিহ্য। নবীনদের গড়তে এদেশের খেটে-খাওয়া মানুষের অবদানকে স্মরণে রেখে আগামীতে কাজ করার তাগিদও দিলেন। যেকোন বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে নিজেদের বিবেকের দ্বারস্থ হওয়ার বার্তা দিয়েছেন। উপদেশ দিলেন প্রতিনিয়ত নিজেদের সক্ষমতা এবং পেশাদারিত্ব বৃদ্ধি করতে সচেষ্ট থাকতে।
- একটি দক্ষ, আধুনিক এবং দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ সেনাবাহিনীর গুরুত্ব
- মাতৃভূমির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষাই জীবনের প্রথম এবং প্রধানতম ব্রত
- এদেশের খেটে-খাওয়া মানুষের অবদানকে স্মরণে রেখে আগামীতে কাজ করার তাগিদ
- চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে নিজেদের বিবেকের দ্বারস্থ হওয়ার বার্তা
- প্রতিনিয়ত নিজেদের সক্ষমতা এবং পেশাদারিত্ব বৃদ্ধি করতে সচেষ্ট থাকতে উপদেশ
এর আগে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বিএমএ প্যারেড গ্রাউন্ডে এসে পৌঁছলে আর্মি ট্রেনিং এন্ড ডকট্রিন কমান্ডের (আর্টডক) জিওসি লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো.মাইনুর রহমান, ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি ও চট্টগ্রামের এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল মীর মুশফিকুর রহমান ও বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির (বিএমএ) কমান্ড্যান্ট মেজর জেনারেল খন্দকার মোহাম্মদ শাহিদুল এমরান তাকে অভ্যর্থনা জানান।
আন্ত:বাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর (আইএসপিআর) জানায়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত অফিসারদের মধ্যে ২০৭ জন পুরুষ ও ২৪ জন মহিলা অফিসার রয়েছেন। ব্যাটালিয়ন সিনিয়র আন্ডার অফিসার আব্দুল্লাহ আল আরাফাত ৮৭ বিএমএ দীর্ঘমেয়াদি কোর্সের সেরা ক্যাডেট হিসেবে অসামান্য গৌরবমণ্ডিত ‘সোর্ড অব অনার’ এবং সামরিক বিষয়ে শ্রেষ্ঠত্বের জন্য ‘সেনাবাহিনী প্রধান স্বর্ণপদক’ অর্জন করেন। প্রশিক্ষণ শেষ করা ক্যাডেটরা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণের পর তাদের বাবা-মা নবীন অফিসারদের র্যাংক-ব্যাজ পরিয়ে দেন। অনুষ্ঠানে বন্ধু প্রতিম দেশ শ্রীলংকান মিলিটারি একাডেমির কমান্ড্যান্ট, দেশি-বিদেশি উচ্চপদস্থ সামরিক ও অসামরিক কর্মকর্তা এবং সদ্য কমিশনপ্রাপ্ত অফিসারদের অভিভাবকরা উপস্থিত থেকে এই বর্ণাঢ্য কুচকাওয়াজ উপভোগ করেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় শাহাদতবরণকারী বীর সেনানীদের আত্মত্যাগ প্রেরণার উৎস
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান তাঁর বক্তব্যের শুরুতেই গভীর শ্রদ্ধা জানান মহান মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষা ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শান্তি প্রতিষ্ঠায় শাহাদতবরণকারী বীর সেনানীদের। তিনি বলেন, ‘তাদের মহান আত্মত্যাগ সব সময় আমাদের প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। আমি তাদের রুহের মাগফিরাতও কামনা করি।’ মাতৃভূমির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ন রাখার জন্য একটি দক্ষ দক্ষ, আধুনিক এবং দেশপ্রেমের চেতনায় উদ্বুদ্ধ সেনাবাহিনীর গুরুত্ব অপরিসীম উল্লেখ করে এই চার তারকা জেনারেল বলেন, ‘এই সেনাবাহিনীর নেতৃত্বের দায়িত্ব মূলত অফিসারদের ওপরই বর্তায়। এই লক্ষ্যে ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হয়। কালক্রমে এই একাডেমি সুনামের সঙ্গে তার দায়িত্ব পালন করে এবং আজকে এটি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মিলিটারি একাডেমিতে পরিণত হয়েছে। এই একাডেমি থেকে কমিশনপ্রাপ্ত অফিসারদের নেতৃত্বে শৃঙ্খলা, আনুগত্য, ন্যায়পরাণতা ও কর্তব্যের প্রতি উজ্জীবিত হয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আজ দেশের সীমানা পেরিয়ে বহির্বিশ্বে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে চলেছে।’
সামরিক চেতনার মূল্যবোধকে সমুন্নত রেখে যেকোন চ্যালেঞ্জ গ্রহণে সবসময় প্রস্তুত থাকতে নির্দেশ
এ সময় তরুণ ক্যাডেট অফিসারদের উদ্দেশে সেনাপ্রধান বলেন, ‘আজকের দিনটি আমাদের সকলের জন্য অত্যন্ত আনেন্দের। কারণ, বিএমএতে দীর্ঘ তিন বছরের কঠোর প্রশিক্ষণ শেষে আজকে তোমরা সেনাবাহিনীতে কমিশন পেতে যাচ্ছো। এজন্য তোমাদের সকলকে জানাই আন্তরিক অভিবাদন। তোমাদের কাছে আমার প্রত্যাশা নেতৃত্বের সর্বোচ্চ গুণাবলী যেমন- সততা, সত্যবাদিতা, কর্তব্যনিষ্ঠা ও কঠোর পরিশ্রম দ্বারা সেনাবাহিনীর ওপর অর্পিত সকল দায়িত্ব তোমরা আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করবে। তোমাদেরকে যেকোন চ্যালেঞ্জ গ্রহণে সবসময় প্রস্তুত থাকতে হবে। সামরিক চেতনার মূল্যবোধকে সর্বোচ্চ সমুন্নত রাখতে ও যেকোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে দেশপ্রেমকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। সাহসিকতার সঙ্গে সকল পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে। তোমরা প্রতিনিয়ত নিজেদের সক্ষমতা এবং পেশাদারিত্ব বৃদ্ধি করতে সচেষ্ট থাকবে।’
শৃঙ্খলা সেনাবাহিনীর প্রধান চালিকাশক্তি; সর্বদা নিজেদের শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি বজায় রাখার আহ্বান
প্রশিক্ষণ সমাপ্তকারী অফিসার ক্যাডেটদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘সেনাবাহিনীর দীর্ঘদিনের ঐতিহ্য, রীতি-নীতি, সুনিয়ন্ত্রিত জীবন পদ্ধতি ও রেজিমেন্টেড লাইফকে তোমরা মনেপ্রাণে গ্রহণ করে সর্বদা নিজেদের শারীরিক ও মানসিক প্রস্তুতি বজায় রাখবে। মনে রাখবে তোমাদের ওপর অর্পিত হবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ভবিষ্যৎ নেতৃত্বদানের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মূলমন্ত্র ‘সমরে আমরা শান্তিতে আমরা সর্বত্র আমরা দেশের তরে’ এটিতে উজ্জীবিত হয়ে মাতৃভূমির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষাই হবে তোমাদের জীবনের প্রথম এবং প্রধানতম ব্রত। সেনাবাহিনী এমন একটি প্রতিষ্ঠান যেখানে শৃঙ্খলা প্রধান চালিকাশক্তি। এখানে সকল বিষয় নির্ধারিত নিয়ম, প্রথা ও অনুশাসন দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকে। যেকোন বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে নিজেদের বিবেকের দ্বারস্থ হবে। তোমরা ভুলে যাবে না, তোমাদের গড়ে তুলতে এই দেশের খেটে-খাওয়া মানুষের অনেক অবদান রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘মনে রাখবে, সামরিক জীবনে ধর্মীয় মূল্যবোধের চর্চা ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলার গুরুত্ব অপরিসীম। যার মাধ্যমে একজন সেনা সদস্য কর্মক্ষেত্রে নিজেকে আদর্শবান, মর্যাদাবান ও উন্নত চরিত্রের অধিকারী হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়। প্রশিক্ষণ শেষে তোমরা নতুন জীবনে পদার্পণ করছো। তোমাদের সেখানে দায়িত্ব ও কর্তব্য অনেক বেশি। তোমরা অধীনস্তদের প্রতি সহানুভূতিশীল হবে এবং তাদের ভালো-মন্দের প্রতি খেয়াল রাখবে। সর্বদা অধীনস্তদের সুপ্রশিক্ষিত করে গড়ে তুলবে এবং তাদের সামনে নিজেকে উদাহরণস্বরূপ উপস্থাপন করবে। তোমাদের প্রশিক্ষণের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য সর্বদা সচেষ্ট থাকবে। তাহলেই তোমরা কর্মক্ষেত্রে সফল হতে পারবে।’
কালের আলো/এমএএএমকে