‘সুলতান ঝিঙে ফুল পছন্দ করেন’
প্রকাশিতঃ 10:00 am | March 09, 2019
আরিফ হাসান ::
“সুলতান” নামটা শুনলেই বলিউডের সালমান খানের সেই সুলতান মুভির নাম, আর মুভিতে এক বীরের জীবনের উত্থান-পতনের চিত্র আঁকে মানস পটে। পাঠক, সেই মুভির কুস্তিগীরের বীরগাথা কাহিনী আজ শুনাতে আসিনি। আমি আজ জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন গাড়িচালক মো. সুলতান মিয়া ভাইয়ের কিছু কথা বলতে চাই। আপনাদের সময় হবে একটু প্লিজ… অল্প সময় নেব, প্রমিজ!
নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বিচরণ তিন বছর চলছে। সুলতান ভাই তার অনেক আগে থেকেই “ঝিঙে ফুল” সিভিলিয়ান বাসটি চালাতেন যত দূর জানি! সুখের ব্যাপার হচ্ছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের হল, ডরমেটরি, বাস সবকিছুই জাতীয় কবির কোন না কোন রচনার নামে নামকরণকৃত। ভাবতে ভাললাগে! আমার সাথে সুলতান ভাইয়ের পরিচয় শুধু ৫টার বাসে ত্রিশাল থেকে ময়মনসিংহ যাওয়ার সময়। আর ময়মনসিংহ থেকে আমার সময়ে তার ০১৭১৮…..৯১ নাম্বারে ফোন দিয়ে, ‘সুলতান ভাই, আপনি কই ‘ বলতেন, ‘স্যার মাসকান্দা পার হইছি!’ আমি বলতাম, ‘নিয়ে যাইয়েন ভাই, নতুন বাজার মোড়ে বাটার নিচে আছি…!’ বলতেন, স্যার, ঠিক আছে, আসতাছি!’
সুলতান ভাই আপনি এত্ত বিনয়ী ছিলেন কেন? এত কম কথা বলতেন কেন? আমি শুধু একদিন এককাপ ফালতু ৫ টাকা দামি চা খাইয়েছিলাম আপনাকে! আপনার চোখের দিকে কখনোই তাকাইনি! কখনও খুব আন্তরিক হয়ে হয়তো জিজ্ঞেস করা হয়নি, ভাই কেমন আছেন? অথচ দেখেন আপনি যখন ঝিঙে ফুলের নন, তখন এই রাত ১.৪৫ মিনিটে জেগে জেগে আপনাকে নিয়েই লিখছি। কি নির্লজ্জ.. নিঃসহায়.. নির্বোধ এই আমি! আপনি আমাকে ক্ষমা করবেন না! করা উচিৎও না.!
ভাই, আপনি না থাকার পর জানতে পারলাম, আপনার চাকুরিটা মাষ্টাররোলে আছে, স্থায়ী হয়নি! আর কিছুদিন পর হয়তো স্থায়ী হতো, হয়তো হতো না! কিন্তু কেন হতো না? সামনেই তো ঈদ। ভাবী নিশ্চয়ই বলেছিলেন, শাড়ি না থ্রিপিস নেবেন! কি রংয়ের শাড়ি নেবেন! ক্লাস নাইনে পড়া ছেলেটা একটা স্মার্টফোনের বায়না ধরেছিল নিশ্চয়ই!
জানি, আপনি হেসেছিলেন, অপেক্ষায় আর প্রতীক্ষায় ছিলেন কবে বেতন আর বোনাসটা হাতে পাবেন এই আশায়! ভাই, গাড়ি চালানোর সময় কি আপনার বারবার মনে হচ্ছিল আপনার চাকুরিটা স্থায়ী না? আপনার বুকে ব্যাথা হচ্ছিল অনেক! জানতাম না! কারণ, জানার চেষ্টাও করিনি!
আপনি যখন ময়মনসিংহ মেডিকেলে পড়ে আছেন কার কথা মনে হচ্ছিল ভাই? খুব পানির তেষ্টা পাচ্ছিল কি? ডাঃ দেবী শেঠী কি জানতেন আপনি মেডিকেলের বিছানায় কাতরাচ্ছেন? সিরিয়াল নিয়েছিলেন? নেননি..! সিরিয়ালের লাইন অনেক লম্বা ছিল কি? হ্যাঁ, লম্বাই ছিল হয়তো যে লাইনের শুরু আছে শেষ নেই!
দুপুরে আপনার জন্য পছন্দের রান্নাগুলো করে ভাবী আর অপেক্ষা করবে না! ক্লাস নাইনে পড়া ছেলেটা বলবে না, আব্বা, একটা সাইকেল কিনে দেন! সুলতান ভাই জানেন, সেদিন বাজারে গিয়েছিলাম। গরুর মাংসের ৫০০ টাকা কেজি, একপিস ফুলকপি ৩০ টাকা দাম! ইচ্ছে হচ্ছিল নিই এককেজি গরুর মাংস! নিইনি! ভাই, আপনার জিপি নাম্বারটা চিরতরে বন্ধ করলেন! পঞ্চইন্দ্রিয়ের কোন ইন্দ্রিয় আর সিভিলিয়ানের ড্রাইভিং সিটে বসবে না! আপনি ছিলেন অপ্রতিষ্ঠিত অচ্ছুৎ আর আমি প্রতিষ্ঠিত অচ্ছুৎ!
কিন্তু হ্যাঁ, আমরা দুজনই অচ্ছুৎ! প্রগতির কোন গতিই আমাদের হোটেল রেডিসন ব্লু বা লা মেরিডিয়ান-এ চা-কফি খেতে ডাকেনি কোন কালে! আলু ভর্তা আর মসুর ডালে আমাদের দিব্বি কেটে যায়! আচ্ছা, এ কেমন জীবন ভাই! যেখানে মৌলিক অধিকার অপ্রতিষ্ঠিত, ক্ষণস্থায়ী, নড়বড়ে! আপনার জন্য নীরবতা আর কতবার পালন করবে সমাজ! পেটে ভাত নাই আর হাতে ফুলের শুভেচ্ছা দেয়ার মত হয়ে গেল না বিষয়টা! আপনাকে নিয়ে কি কোন দিবস পালন হবে! সাদাকালো ব্যানারে লেখা হবে “আমরা তোমাকে ভুলিনি”! হ্যাঁ, হবে, মিথ হয়ে গেলেই কেবল মিথস্ক্রিয়া কাজ করে আমাদের!
পাঠক, এই সুলতান.. এই সুলতান ভাইয়েরা একটা ফোন পেলে বিছানা থেকে এক লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়ায়! বলেন, স্যার, এই তো… এইখানে… আসতেছি… আর বড় জোড় দশ মিনিট স্যার…! দুঃখিত সুলতান ভাই! আপনাকে নিয়ে বাজে বস্তাপচা সস্তা আবেগী কথাগুলো লিখলাম! যে কথার কোথাও কোন যুক্তি নেই। আমি লজ্জিত, সংকুচিত, শংকিত! ক্ষমা করা যায় আমাকে সুলতান ভাই? ওপারে ভাল থাকুন… নিশ্চিন্তে ঘুমান… ওপারে যদি ত্রিশাল গোহাটা মোড় থাকে তাহলে সেখানে গড়গড়ি পিঠা আর গুল্লি পিঠা খাব দুজন! ঘুমান… আপনার জিপি নাম্বারে আর কেউ কক্ষনো ফোন দেবে না!
লেখক: গবেষক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ নাট্যকলা ও পরিবেশনাবিদ্যা বিভাগে কর্মরত