উদ্ভুত পরিস্থিতিতে অপরিহার্য জাতীয় ঐক্যের বার্তা প্রধান উপদেষ্টার

প্রকাশিতঃ 10:39 pm | December 03, 2024

মো.শামসুল আলম খান, কালের আলো:

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবি থেকে শুরু হওয়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন খুব দ্রুততার সঙ্গে রূপ নেয় সরকার পতনের এক দফায়। গণ-অভ্যুত্থানের পথ ধরে সবার অলক্ষ্যে দেশত্যাগ করে তৎকালীন সরকারপ্রধান। প্রথমবারের মতো এমন ঘটনার মুখোমুখি হয়েছে দেশের মানুষ। গঠিত হয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। সম্প্রতি তাঁরা ১০০ দিন পার করেছে। সরকার ও দেশকে অস্থিতিশীল করতে নানামুখী ষড়যন্ত্র চলছে। এমন কঠিন সময়ে ধৈর্য, সহিষ্ণুতা ও জাতীয় ঐক্য অপরিহার্য। নয়তো গণ-আন্দোলনের ফল পর্যবসিত হবে ব্যর্থতায়। দিন কয়েক আগে প্রধান উপদেষ্টা ড.মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করে দেশের প্রধান দু’রাজনৈতিক দল বিএনপি ও জামায়াত জাতীয় ঐক্য গড়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। দু’দলের ভাবনায় সায় দিয়েছিলেন প্রধান উপদেষ্টাও। দেশের উদ্ভুত পরিস্থিতিতে তিনি পুনরায় ঐক্যের বার্তা দিয়েছেন।

মঙ্গলবার (৩ ডিসেম্বর) রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানিয়েছেন, দেশের চলমান নানা ইস্যুতে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এ লক্ষ্যে তিনি সব রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। ইতোমধ্যেই সেই তৎপরতা শুরু হয়েছে। এদিন সন্ধ্যায় ছাত্র নেতাদের সঙ্গে বসেন প্রধান উপদেষ্টা। বুধবার (০৪ ডিসেম্বর) তিনি সব রাজনৈতিক দল এবং পরদিন বৃহস্পতিবার (০৫ ডিসেম্বর) তিনি ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে বসবেন। বুধবার (৪ ডিসেম্বর) বিকেল চারটায় ফরেন সার্ভিস অ্যাকাডেমিতে এই বৈঠকটি হবে। এতে সরকারের উপদেষ্টারাও অংশ নেবেন।

মঙ্গলবার রাতে বিভিন্ন দলের নেতারা জানিয়েছেন, ইতোমধ্যে তারা বৈঠকে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছেন। নেতারা ধারণা করছেন, ইতোমধ্যে ভারত ইস্যুতে প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় ঐক্য আহ্বান করেছেন। এই পরিস্থিতি তিনি নিজেই এই বৈঠকের উদ্যোগ নিলেন। জানতে চাইলে গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বিভিন্ন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘বুধবার বিকাল চারটায় প্রধান উপদেষ্টা সব দলের সঙ্গে একসাথে বৈঠক করবেন বলে জেনেছি। তবে কী নিয়ে আলাপ হবে জানি না।’ মঞ্চের অন্যতম নেতা নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘আমি যাবো বৈঠকে।’

  • সব রাজনৈতিক দল, ছাত্র সংগঠন ও ধর্মীয় সম্প্রদায়ের নেতাদের সঙ্গে হবে বৈঠক
  • ত্রিপুরায় হামলার ঘটনাকে ‘বাংলাদেশ নিয়ে অপতথ্য প্রচারের ফলাফল’ হিসেবে দেখছেন প্রেস সচিব
  • সীমান্তে ‘অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি’ রোধে সব ধরনের প্রস্তুতি বিজিবি’র

জানা যায়, সম্প্রতি প্রতিনিয়ত অনেকের অসংলগ্ন, অসহিষ্ণু ও অপরিণত আচরণের মুখোমুখি হচ্ছে দেশ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও আসল-নকল আর সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্ব চলছে। আন্দোলন-পরবর্তী ব্যক্তিগত মতামত প্রকাশের হঠাৎ সীমাহীন স্বাধীনতা কলুষিত করে ফেলছে ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। মাত্রাজ্ঞান শূন্যের মতো যা খুশি পোস্ট করছেন সবাই। পাশাপাশি বাংলাদেশ নিয়ে ভারতীয় গণমাধ্যমের মাত্রাতিরিক্ত উস্কানি ঘোলাটে করছে পরিস্থিতি। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের নির্যাতনের অভিযোগ নিয়ে বেশ সরব ভূমিকায় রয়েছে তাঁরা; যাকে ‘অতিরঞ্জিত’ এবং ‘সংঘবদ্ধ অপপ্রচার’ হিসাবে বর্ণনা করে আসছে বাংলাদেশ সরকার। এসবসহ নানাবিধ ঘটনায় শুরু থেকেই অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কের টানাপোড়েন চলছে। সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে দুদেশের সরকারের মধ্যে কয়েকবার বিবৃতি, পাল্টা বিবৃতি দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

সংখ্যালঘুদের আট দফা দাবি আদায়ে মাঠে নামা সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারী রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেপ্তার হওয়ার পর দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনার পারদ আরো বেড়েছে। চিন্ময় কৃষ্ণ দাশের জামিন নাকচের দিন তার সমর্থকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের মধ্যে চট্টগ্রামে আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে হত্যা করা হলে, সেই ঘটনার জন্য ইসকনকে দায়ী করে বক্তব্য দেয় বিভিন্ন দল, সেই সঙ্গে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগকেও দায়ী করা হয়। এর মধ্যে গত সোমবার (০২ ডিসেম্বর) ত্রিপুরার আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাই কমিশন কার্যালয়ে হিন্দুত্ববাদী একটি সংগঠনের হামলা হয়, যাকে ‘পূর্বপরিকল্পিত’ হিসেবে বর্ণনা করে ‘ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া’ জানিয়েছে বাংলাদেশ। সীমান্তে ‘অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি’ রোধে সব ধরনের প্রস্তুতি থাকার কথা জানিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। বিশেষ করে আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাই কমিশনে ভারতের বিক্ষোভকারীদের হামলার ঘটনার পরদিন মঙ্গলবার (০৩ ডিসেম্বর) বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনীটির এই বার্তা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। বিজিবি সদর দপ্তর থেকে পাঠানো এক বার্তায় বলা হয়েছে, ‘সীমান্তে কোনো ধরনের অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি কিংবা অপতৎপরতা রোধে বিজিবি সম্পূর্ণ প্রস্তুত ও সতর্ক রয়েছে।’

অন্যদিকে, আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাই কমিশনে হামলার ঘটনাকে ‘বাংলাদেশ নিয়ে অপতথ্য প্রচারের ফলাফল’ হিসেবে দেখছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি বলেছেন, ‘এটার জন্য দায় চাপাব ভারতীয় গণমাধ্যমকে। এ গণমাধ্যম কোনো তথ্য নিশ্চিত হওয়া ছাড়া মিথ্যা অপতথ্য ছড়াচ্ছে। তারা আগেই নির্ধারণ করে দিচ্ছে বাংলাদেশে কী হচ্ছে। অবস্থান পূর্বনির্ধারিত থাকলে বেশি এগোনো যায় না। ফলে ভারতীয় জনগণ সহিংসতা করছে।’

এদিকে, আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাই কমিশন কার্যালয়ে হিন্দুত্ববাদী একটি সংগঠনের হামলার ঘটনায় ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে ডেকে পাঠায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। মঙ্গলবার (৩ ডিসেম্বর) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তলবে সাড়া দিয়ে ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব এম রিয়াজ হামিদুল্লাহর সঙ্গে কথা বলেন। এরপর ভারতীয় হাইকমিশনার সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে বলেন, ‘কোনো নির্দিষ্ট একটি ইস্যুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক মূল্যায়ন করা যাবে না।’

সরকার সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের উদ্ভুত এমন পরিস্থিতিতে জাতীয় ঐক্যের ডাক দিতে সংলাপে বসছেন প্রধান উপদেষ্টা ড.মুহাম্মদ ইউনূস। কী বিষয়ে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেবেন প্রধান উপদেষ্টা- এমন প্রশ্নে প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, ‘ইদানিং কিছু ঘটনা নিয়ে বৃহৎ পরিসরে অপতথ্য ছড়ানোর প্রয়াস আমরা দেখছি। অনেকাংশে দেখছি ভারতীয় গণমাধ্যম খুবই আক্রমণাত্মকভাবে এগুলো করছে। সেজন্য জাতীয়ভাবে ঐক্য তৈরি করতে আমাদের বলতে হবে, ‘তোমরা আসো, দেখ কি হচ্ছে।’ ‘একই সঙ্গে আমাদের জাতীয় ঐক্যটাও ধরে রাখতে হবে। আমাদের দেশকে নিয়ে অপতথ্য ছড়ানো হচ্ছে। এখানে ইমেজের প্রশ্ন আছে। সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে এ অপতথ্য প্রচারের বিরুদ্ধে নামতে হবে।’ সংবাদমাধ্যমের উদ্দেশে প্রেস সচিব বলেন, ‘বাংলাদেশ নিয়ে যে ভয়ানক ধরনের মিথ্যা তথ্য ছড়ানো হচ্ছে, তার জবাব দিয়ে প্রকৃত তথ্য তুলে ধরতে হবে। এটি জাতীয় দায়িত্ব বলে মনে করি।’

ভারতীয় ‘অপপ্রচারের’ বিষয়ে সরকারের কার্যক্রম তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘কূটনৈতিক চ্যানেলে কথাবার্তা হচ্ছে। বাংলাদেশের বিদ্যমান ব্যবস্থায় এর চেয়ে বেশি করণীয় নেই। আমরা আশা করি, আমাদের সিটিজেন গ্রুপ, ডায়াসপোরা গ্রুপ, রাজনৈতিক দল এবং সিভিল সোসাইটির এ বিষয়ে সোচ্চার হওয়া উচিত। তারা আমাদের নিয়ে অপতথ্য ছড়াচ্ছে। পুরো জাতিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর অপচেষ্টা করছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে শফিকুল আলম বলেন, ‘আমরা ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক চাই। তারা আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী। আমরা মনে করি, এ সুসম্পর্ক হতে হবে ন্যায্যতা ও সমতার ভিত্তিতে।’

কালের আলো/এমএসএএকে/এমকে