পরিবর্তনের হাওয়া কারা অধিদপ্তরেও, অপরাধে জড়িত কর্মকর্তাদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে আইনি সংস্কারের উদ্যোগ
প্রকাশিতঃ 8:46 pm | December 04, 2024
বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান খুলে দিয়ে সম্ভাবনার নতুন এক দুয়ার। সৃষ্টি হয়েছে ন্যায়ভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নতুন বাংলাদেশ গড়ার আকাঙ্ক্ষা। যুগান্তকারী এই পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পরিবর্তনের হাওয়া লেগেছে কারা অধিদপ্তরেও। দেশের ৬৯টি কারাগারকে খোলনলচে পাল্টে বদলে দিতে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন। দায়িত্বভার গ্রহণ করেই ৫ আগস্ট পরবর্তী প্রতিটি কারাগারের ঘটনা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করেছেন। অভ্যন্তরীণ ও বাইরের নিরাপত্তার দুর্বলতা শনাক্ত করেছেন। অবহিত করেছেন সরকারকে। অপরাধমূলক কার্যক্রমে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একচুলও ছাড় দিচ্ছেন না। তাদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে গ্রহণ করেছেন আইনি সংস্কারের উদ্যোগও।
- ঝুঁকিপূর্ণ ১৭ কারাগার, ৭০ জঙ্গিসহ ৭০০ বন্দি এখনও পলাতক
- আবেদনের প্রেক্ষিতে ডিভিশনের নির্দেশ
- লোগো পরিবর্তনসহ সংস্কারের উদ্যোগ, চালু হচ্ছে হটলাইন-ডগ স্কোয়াড
- বিশেষ প্রকৃতির বন্দিদের সিসি ক্যামেরা দ্বারা সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ
- গত তিন মাসে কারা অধিদপ্তরের কর্মযজ্ঞের ফিরিস্তি
বন্দি ব্যবস্থাপনায় অধিকতর স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিতে জোর দিয়েছেন। ২৪ ঘণ্টা হটলাইন সেবা চালু ও কারা অভ্যন্তরে মাদকরোধে ঝুঁকিপূর্ণ কারাগারসমূহে ডগ স্কোয়াড মোতায়েন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করেছেন। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, ‘রাখিব নিরাপদ দেখাব আলোর পথ’ এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে বাংলাদেশের সব কারাগারকে সংশোধনাগার হিসেবে গড়ে তোলার মানসে কারা অধিদপ্তর কাজ করে যাচ্ছে। বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন পরবর্তী সময়ে দেশের প্রশাসনিক কাঠামোর সংস্কারের উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় কারা প্রশাসনেও বেশ কিছু সংস্কার ও পরিবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শৃঙ্খলা আনাসহ বন্দিদের সকল প্রকার প্রাপ্যতা বিধি বিধানের আলোকে নিশ্চিতের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।’
কারা নিরাপত্তার হালহকিকত ও নানাবিধ গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে গণমাধ্যমকে অবহিত করতে দ্বিতীয়বারের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে সামগ্রিক বিষয়াদি নিয়ে কথা বলেছেন কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন্স) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন। বুধবার (৪ ডিসেম্বর) সকালে রাজধানীর বকশিবাজারের কারা অধিদপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান তিনি। এর আগে চলতি বছরের মঙ্গলবার (১৭ সেপ্টেম্বর) বিকেলে প্রায় ঘন্টাব্যাপী এক ব্রিফিং করেছিলেন কারা মহাপরিদর্শক। প্রায় ২ মাস ১৮ দিন পর পুনরায় জনাকীর্ণ এই সংবাদ সম্মেলনে তিনি উপস্থাপন করেন যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত। সোজা-সাপ্টা জবাব দিয়েছেন গণমাধ্যমের নানা প্রশ্নেরও।
সংবাদ সম্মেলনে ওঠে আসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন এক বন্দির ওপরে হামলার ঘটনার বিষয়টিও। এ বিষয়ে জানতে চাইলে কারা মহাপরিদর্শক বলেন, ‘যখন আমরা কোনো বন্দিকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাই, কারাগারের বাইরে হলেও সে জায়গাটা কিন্তু কারা অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণে বা আওতায় থাকে। সেখানে আসামির নিরাপত্তার জন্য কারারক্ষী থাকেন। নিরাপত্তা দুর্বলতার কারণে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বন্দির উপর হামলার ঘটনাটি ঘটেছিল। তবে সেখানে কারারক্ষী ছিল ও তাদের হস্তক্ষেপের কারণেই ঘটনাটি বেশি দূর গড়াতে পারেনি।’ ‘পরবর্তীতে এ ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে সেজন্য আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ গ্রহণ করেছি, সেটা হচ্ছে কারা হাসপাতাল। কারা হাসপাতালের কাজটি সম্পন্ন হলে কারাবন্দিদের আর সরকারি হাসপাতালে পাঠানোর প্রয়োজন হবে না, তখন নিরাপত্তাহীনতাও থাকবে না’- যোগ করেন তিনি।
সম্প্রতি কারাগারে বন্দিদের মোবাইল ফোন ব্যবহারসহ আয়েশী জীবন-যাপন করছে, বেশকিছু গণমাধ্যমে এমন সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। এ বিষয়টিও সংবাদ সম্মেলনে জানতে চাওয়া হয় কারা মহাপরিদর্শকের কাছে। এ বিষয়ে তিনি বলেছেন, ‘বিশেষ প্রকৃতির বন্দিদের নির্ধারিত এলাকায় মোবাইল ফোন জ্যামার এবং সিসি ক্যামেরা থাকায় মোবাইল ফোন ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই। বিধি মোতাবেক শ্রেণিপ্রাপ্ত বন্দি খাট, চেয়ার-টেবিল, পত্রিকার পাশাপাশি কিছু অতিরিক্ত খাদ্যদ্রব্য পেয়ে থাকেন, যা দিয়ে আয়েশী জীবন-যাপন কোনোভাবেই সম্ভব নয়।
অপরদিকে কোনো বন্দিকে কারাগারের বাইরে পাঠানোর সময় প্রধান ফটক পর্যন্তই কারা কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণ ও দায়-দায়িত্ব থাকে। এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তত্ত্বাবধানে বিধি মোতাবেক নিরাপত্তাসহ হাতকড়া/ডান্ডাবেড়ি পরানো, প্রিজন ভ্যান/মাইক্রোবাসে নেওয়া ইত্যাদি পরিচালিত হয়ে থাকে। তবে কয়েকটি গণমাধ্যমে কারাগার ও কারাবন্দিদের নিয়ে ধারণাগত সংবাদ প্রচার করার ফলে জনমনে কারাগার সম্পর্কে নেতিবাচক তথ্য পৌঁছাচ্ছে বলে কারা কর্তৃপক্ষ মনে করে।’
ঝুঁকিপূর্ণ ১৭ কারাগার, ৭০ জঙ্গিসহ ৭০০ বন্দি এখনও পলাতক
কারা মহাপরিদর্শক (আইজি প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন বলেন, দেশে এই মুহূর্তে ৬৯টি কারাগার রয়েছে। এর মধ্যে ১৭টি কারাগার অনেক পুরোনো ও ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। সরকার বিষয়গুলো জানে, এগুলো অতিদ্রুত সংস্কার, মেরামত ও পুননির্মাণ দরকার। তিনি বলেন, ‘এই কারাগারগুলোর ধারণ ক্ষমতা ৪২ হাজার। ৫ আগস্টের পর ৫০ হাজারের কিছু বেশি ছিল। তারপর কারাবন্দির সংখ্যা বেড়েছে। বর্তমানে ৬৫ হাজার কারাবন্দি রয়েছে। এছাড়া ৫ আগস্ট ও পরবর্তী সময়ে ২২’শর বেশি কারাবন্দি পালিয়েছিল। ১৫’শ জনকে গ্রেপ্তার করা গেলেও ৭০০ বন্দি এখনো পলাতক রয়েছে।’ এক প্রশ্নের জবাবে কারা মহাপরিদর্শক বলেন, ‘বিভিন্ন মামলায় দাগি আসামি বা যাদেরকে শীর্ষ সন্ত্রাসী বলা হচ্ছে তাদের ১১ জন মুক্তি পেয়েছেন। জঙ্গি সদস্যদের যাদের বলা হচ্ছে যারা জেএমবিসহ বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের সদস্য বলা হয়েছে তাদের ১৭৪ জন জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। পালানো বিভিন্ন আলোচিত মামলা ও জঙ্গি সদস্যের মধ্যে এখনো পলাতক ৭০ জন। তাদের গ্রেপ্তারে সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে।’ ‘চারজন জেল সুপারকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন পর্যায়ে বেশ কিছু অভিযোগের পর্যালোচনা ও তদন্ত চলছে। নির্দিষ্ট অভিযোগের তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে’ বলেও জানান তিনি।
আবেদনের প্রেক্ষিতে ডিভিশনের নির্দেশ
রাজনৈতিকভাবে যারা ডিভিশিন পাওয়ার উপযুক্ত তারা সবাই ডিভিশন পাচ্ছেন কি না জানতে চাইলে কারা মহাপরিদর্শক মোতাহের হোসেন বলেন, ‘ডিভিশন পাওয়ার দুটি বিধান আছে- একটি হচ্ছে প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তা। আরেকটি সমাজের গণ্যমান্য, মন্ত্রী এমপিরা। জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আবেদন করতে হয়। এটা তাদের এখতিয়ার- আবেদনের প্রেক্ষিতে তারা ডিভিশনের নির্দেশ দেন।’
চিকিৎসাধীন বন্দিদের নিরাপত্তা নিয়ে তিনি বলেন, ‘কোনো সরকারি হাসপাতালে কিন্তু প্রিজন সেল নেই। এটা আমাদের দুর্বলতা। সরকার কিছু কিছু ক্ষেত্রে সরকারি হাসপাতালে প্রিজন সেল স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করছে। অনেক ক্ষেত্রে অন্যান্য সাধারণ রোগীর সঙ্গে বন্দিদের চিকিৎসা দিতে হয়। কারা হাসপাতাল হয়ে গেলে এ সমস্যার সমাধান হবে।’
কারা কর্মচারীদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে জানতে চাইলে কারা মহাপরিদর্শক বলেন, ‘বিষয়টি তো সার্ভিস। সিভিল সার্ভিসের বিধানের আলোকে কারা কর্তৃপক্ষের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু কারা অধিদপ্তরে কর্মরতদের মধ্যে পোশাকধারী অস্ত্রধারী দুটোই আছে। একই আইনে কারা অধিদপ্তর পরিচালনায় প্রতিবন্ধকতা মনে করছি। সেজন্য আমরা ভিন্ন আইনের কথা বলছি।’
লোগো পরিবর্তনসহ সংস্কারের উদ্যোগ, চালু হচ্ছে হটলাইন-ডগ স্কোয়াড
কারা অধিদপ্তরের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পরিবর্তন হচ্ছে লোগো। পাশাপাশি বন্দি ব্যবস্থাপনা অধিকতর স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিতে ২৪ ঘণ্টা হটলাইন সেবা চালু ও কারা অভ্যন্তরে মাদকরোধে ঝুঁকিপূর্ণ কারাগারসমূহে ডগ স্কোয়াড মোতায়েন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন। ‘নানা মহলের দাবির প্রেক্ষিতে’ কারা অধিদপ্তরের লোগো পরিবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি এই মন্তব্য করেন।
এ প্রসঙ্গে কারা মহাপরিদর্শক বলেন, ‘কোনো রাজনৈতিক দল সরকার আমাদেরকে কারা অধিদপ্তরের লোগো পরিবর্তনের পরামর্শ বা মতামত দেয়নি। আমরা গত ৫ আগস্টের পর জনসাধারণের প্রচুর ফিডব্যাক পেয়েছি। সেটির মূল কথাই ছিল কারা অধিদপ্তর লোগো পরিবর্তনের বিষয়ে।’
বিশেষ প্রকৃতির বন্দিদের সিসি ক্যামেরা দ্বারা সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ
বন্দিদের খাবারের তালিকায় আমিষের পরিমাণ বৃদ্ধি, কারাগারগুলোকে উৎপাদনমুখী করা, কারাবন্দি ও কর্মচারীদের সুচিকিৎসা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় কারা হাসপাতাল নির্মাণ এবং প্রতিটি কারাগারে অ্যাম্বুলেন্স সরবরাহের ন্যায় দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। বলেন, ‘পরিবর্তিত সময়ে কারাগারসমূহে সাময়িকভাবে বন্দির সংখ্যা তুলনামূলকভাবে কমলেও বর্তমানে তা ঊর্ধ্বমুখী। এছাড়া বিশেষ প্রকৃতির বন্দির সংখ্যা নেহাত কম নয়। তবে সব সময়ের ন্যায় কারা বিধিসহ অন্যান্য বিধি বিধানের আলোকে তাদের নিরাপদ আটক ও প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা হচ্ছে। কারাগারে সব বন্দিকে আগমনের পর শ্রেণি/ঝুঁকি নির্ধারণপূর্বক প্রকৃতি অনুযায়ী নির্ধারিত ওয়ার্ড/সেল এলাকায় পাঠানো হয়।’
বিশেষ প্রকৃতির বন্দিদের ওয়ার্ড/সেল এ মোবাইল ফোন জ্যামার স্থাপন করাসহ সিসি ক্যামেরা দ্বারা সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ এবং প্রতিদিন কয়েক বার তল্লাশি করা হয় জানিয়ে কারা মহাপরিদর্শক বলেন, ‘যোগাযোগের ক্ষেত্রে আদালতের আদেশ ছাড়াও সব প্রকার বিচারাধীন বন্দি প্রতি ১৫ দিনে এবং সাজাপ্রাপ্ত বন্দি ৩০ দিনে, আইনজীবীসহ একবারে পরিবারের সবোর্চ্চ পাঁচ জন সদস্যের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারেন। এছাড়া প্রত্যেক বন্দিই প্রতি ৭ দিনে একবার আইনজীবীসহ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তিনটি নম্বরে ১০ মিনিটের জন্য কথা বলার সুযোগ পান। শ্রেণিপ্রাপ্ত বন্দিরা দিনে দু’বেলা এবং অন্য বন্দি দিনে একবেলা আমিষ জাতীয় খাবার পান। ভেতরের ক্যান্টিনের পণ্যের দাম ন্যায্যতার সহিত নির্ধারণসহ ক্যান্টিন সুবিধা সবার জন্যই উন্মুক্ত রাখা হয়েছে, তবে এ ক্ষেত্রে ব্যক্তি বিশেষে মাসিক সর্বোচ্চ ব্যয় নির্ধারণ করে দেওয়ার উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়েছে।’
গত তিন মাসে কারা অধিদপ্তরের কর্মযজ্ঞের ফিরিস্তি
৫ আগস্টের পর গত তিন মাসে কারা অধিদপ্তরের গৃহীত কার্যক্রমের ফিরিস্তি তুলে ধরে কারা মহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সৈয়দ মো. মোতাহের হোসেন বলেন, গত ৩ মাসে কারাগারগুলোতে অধিকতর স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা আনায়নের লক্ষ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কারা অভ্যন্তরের সব প্রকার তল্লাশি জোরদার করা হয়েছে। এছাড়া অবৈধ দ্রব্যাদির প্রবেশ রোধকল্পে প্রবেশপথে বডিস্ক্যানারসহ অন্যান্য আধুনিক সরঞ্জামাদি স্থাপন করা হয়েছে। কারা অভ্যন্তরে মাদক দ্রব্যের প্রবেশ রোধকল্পে ঝুঁকিপূর্ণ কারাগারসমূহে ডগ স্কোয়াড মোতায়েন প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। সৎ এবং যোগ্যতা সম্পন্ন অফিসার এবং কারারক্ষীদের তাদের পেশাগত যোগ্যতার ভিত্তিতে কারা সদর দপ্তরসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কারাগারগুলোতে পদায়ন করা হয়েছে। অসাধু কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে চাকরি থেকে অপসারণ, তাৎক্ষণিক বদলিসহ সব প্রকার বিভাগীয় কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। এক্ষেত্রে আইনি দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অনেকে আবার অপরাধমূলক কার্যক্রমে জড়িত হচ্ছেন বিধায় কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণে আইনি সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সব সময়ে বন্দিদের সঙ্গে মানবিক আচরণ নিশ্চিতের জন্য বেশ কয়েকটি নির্দেশনা জারি করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে বন্দিদের প্রাপ্যতা অনুযায়ী খাবার সহ প্রয়োজনীয় সরাঞ্জামাদির সরবরাহ নিশ্চিতের জন্য কঠোর তদারকি অব্যাহত রয়েছে। বন্দিদের দেখা সাক্ষাৎ, টেলিফোনে কথোপকথন, চিকিৎসা সেবা যথাযথভাবে নিশ্চিতের লক্ষ্যে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা জারিসহ তা বাস্তবায়নে কঠোর নজরদারি করা হচ্ছে।
আরও পদক্ষেপসমূহ হচ্ছে-বন্দি ব্যবস্থাপনা অধিকতর স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করণের লক্ষ্যে কারাগার ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত সফটওয়্যারসহ, আরএফআইডি এবং জিপিএস ব্যবহারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সেবা প্রত্যাশিদের সহায়তার জন্য ২৪ ঘণ্টা হটলাইন চালুর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। কারাগারকে সংশোধনাগার হিসেবে রূপান্তরের লক্ষ্যে বন্দিদের প্রশিক্ষণসহ তাদের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে থাকবে, নতুন পণ্যের উৎপাদনের লক্ষ্যে স্থাপনা তৈরি, পুরনো যন্ত্রপাতির আধুনিকায়ন। এছাড়া বিজিএমই এর সহায়তায় একটি পূর্ণাঙ্গ গার্মেন্ট ম্যানুফ্যাকচারিং লাইন স্থাপনের লক্ষ্যে তাদের সঙ্গে এমওইউ স্বাক্ষরসহ কারাগারে কর্মদক্ষতা অর্জনকারী বন্দিদের মুক্তির পর বিজেএমই আওতাভুক্ত ফ্যাক্টরিগুলোতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চাকরি দেওয়ার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করণের বিষয়ে আলোচনা চলছে। পরবর্তী সময়ে কারাগারে খাবার পানি বোতলজাতকরণ, মাস্ক তৈরির মতো কার্যক্রমও গ্রহণ করা হবে। অতি পুরাতন কারা আইন ও বিধি বিধান সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণসহ কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কল্যাণে নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে- জনবল বৃদ্ধি, পদ-পদবির আপগ্রেডেশন, নিয়োগবিধি পরিবর্তনসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা বৃদ্ধিকরণ। এ সব বিষয়সমূহ সরকারের সক্রিয় বিবেচনায় রয়েছে। নানা মহলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে কারা অধিদপ্তরের লোগো পরিবর্তনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত লোগো যেন কারা অধিদপ্তরের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় সে দিকে লক্ষ্য রাখা হবে। বন্দি ব্যবস্থাপনা উন্নয়নের জন্য কেন্দ্রীয় কারা হাসপাতাল স্থাপনসহ বেশ কয়েকটি ঝুঁকিপূর্ণ কারাগার পুনর্র্নিমাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এ ছাড়া জ্যামার, বডিক্যামসহ আধুনিক সরঞ্জামাদি ক্রয়ের উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিভিন্ন স্তরে নিয়মিত প্রশিক্ষণের আয়োজনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। এরকম বেশ কয়েকটি প্রশিক্ষণ ইতোমধ্যেই সম্পন্ন করা হয়েছে। কারাগারসমূহের ভবনগুলোর অব্যবহৃত ছাদসমূহ ব্যবহার করে সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এতে সরকারের বিপুল রাজস্ব সাশ্রয় হবে এবং বাড়তি বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করার ব্যবস্থাও রাখা হবে, যা দেশের সবুজ বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে।
সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল, কারা উপ-মহাপরিদর্শক মনির আহমেদ, সহকারী কারা মহাপরিদর্শক (প্রশাসন) মো. আবু তালেব, সহকারী কারা মহাপরিদর্শক (উন্নয়ন ও মিডিয়া) মো. জান্নাত উল ফরহাদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
কালের আলো/এমএএএমকে