ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আহতদের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কা কাটাচ্ছে বিজিবি, ইতিবাচক ভূমিকার প্রশংসা দু’উপদেষ্টার

প্রকাশিতঃ 11:13 pm | December 08, 2024

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:

কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার স্বাদ পেতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-আন্দোলনে আহত অনেকের ঠাঁই হয়েছে হাসপাতালের বিছানায়। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কায় তাঁরা ও তাদের পরিবার। কারও বুকে, পেটে বা পায়ে গুলি লেগেছে। কারও নিভে গেছে চোখের আলো। তাদের বেশিরভাগই পাননি সহায়তা। টানাটানির সংসারে দীর্ঘ মেয়াদী চিকিৎসার সামর্থ্য নেই। তাদের বেদনাতুর কাহিনী জেনেই শুরু থেকেই আন্দোলনে আহত অনেককেই নিজেদের উদ্যোগে চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করেছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। বিজিবি হাসপাতালে পরিপূর্ণ চিকিৎসা পেয়ে অনেকেই ফিরতে শুরু করেছেন স্বাভাবিক জীবনে। কিন্তু নতুন জীবনে আবার ঘনীভূত হয়েছে অনিশ্চয়তার কালো মেঘ। এই কষ্টের মেঘ কাটাতেই আহতদের দীর্ঘস্থায়ী পুনর্বাসনে এগিয়ে এসেছে বিজিবি। তাদের উদ্যোগে প্রদান করা হচ্ছে মানবিক সহায়তা।

রবিবার (০৮ ডিসেম্বর) বিকেলে রাজধানী ঢাকার পিলখানাস্থ বিজিবি সদর দপ্তরের সীমান্ত সম্মেলন কেন্দ্রে জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানে আহত হয়ে বর্ডার গার্ড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছাত্র-জনতাকে দীর্ঘস্থায়ী পুনর্বাসনে একটি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এ সময় আহত ৪ জনকে আর্থিক সহায়তা ও ৩ জনকে জীবিকা উপকরণ তুলে দেয় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ। অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব:) মোঃ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা মিজ্ ফরিদা আখতার, বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী, বিশিষ্ট লেখক, গবেষক ও চিন্তক ফরহাদ মজাহার ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ উপস্থিত ছিলেন। এই আয়োজনে সরকারের দু’উপদেষ্টাসহ বক্তারা ছাত্র-জনতার আন্দোলনে বিজিবির ইতিবাচক ভূমিকার প্রশংসা করেছেন। বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী ‘সবার ওপরে দেশ’- এই মন্ত্রে উজ্জীবিত বিজিবির প্রতিটি সদস্য ‘সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী’ হিসেবে সদা প্রস্তুত এবং দেশের জন্য যেকোন পরিস্থিতি মোকাবিলায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ’ বলে জানিয়েছেন।

আহত ও পুনর্বাসিতদের বিজিবির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ
একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আমান উল্লাহ আমান। গত ২০ জুলাই রাজধানীর যাত্রাবাড়িতে তিনি গুলিবিদ্ধ হন। ঢামেকে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ার সময় বিজিবি সদস্যরা তাকে বর্ডার গার্ড হাসপাতালে নিয়ে আসে। তখনও ঠিকমতো হাঁটতে পারতেন না। বিজিবি হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসার ফলে হাঁটতে পারছেন। গণমাধ্যমের সঙ্গে আলাপে তিনি বলেন, ‘সর্বোচ্চ সেবা পেয়েছি। সঠিক সেবা ও চিকিৎসা দিয়ে তাঁরা আমাদের সুস্থ করে তুলেছে। তাঁরা আমাদের পুনর্বাসনেরও ব্যবস্থা করেছে। আমরা বিজিবির প্রতি কৃতজ্ঞ।’

চটপটে যুবক হিসেবেই সবাই জানতো মাদারীপুরের নূরে আলমকে। ছাত্র আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়ার পর তাঁর বুকে দু’টি গুলি লাগে। মর্মান্তিকভাবে আহত হলে ঢামেকে তাকে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে বিজিবি তাকে হাসপাতালটিতে নিয়ে আসে। আবেগতাড়িত নূরে আলম বলছিলেন, ‘সংসারের খরচ জোগাতেই আমাকে হিমশিম খেতে হতো। কিন্তু বিজিবি সহানুভূতির হাত বাড়িয়ে দেওয়ায় আমরা উন্নতমানের চিকিৎসা পেয়েছি। তাঁরা আর্থিকভাবেও আমাদের সহযোগিতা করছেন। এটি অবশ্যই আমাদের জন্য আনন্দের।’

দেশ গঠনমূলক বিভিন্ন কাজে বিজিবির ভূয়সী প্রশংসা বক্তাদের
জুলাই-গণঅভ্যুত্থানে আহতদের পুনর্বাসন সহায়তায় পিলখানায় বিজিবির আয়োজনে আলোচনায় ঘুরেফিরে আসে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক প্রসঙ্গ। ফ্যাসিবাদে জড়িতরা কীভাবে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে পালালো তা জানতে চান বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ। তিনি বলেন, ‘ফ্যাসিবাদকে পুনর্বাসনেই বাংলাদেশ বিরোধী প্রোপাগাণ্ডা চালাচ্ছে ভারত।’ তবে চিন্তক ফরহাদ মজহার বলেন, ‘এটি নিছক প্রোপাগাণ্ডা নয় ভারতের সামরিক প্রস্তুতির অংশ। ভারতের আস্ফালনের উপযুক্ত উত্তর দিতে অবিলম্বে আমাদের প্রতিটি নাগরিকের সামরিক প্রশিক্ষণ দরকার।’ তিনি এ সময় র‌্যাব বিলুপ্তিরও দাবি জানান। অতি দ্রুত বিজিবিকে ফাস্ট লাইন অব ডিফেন্স ফোর্স আকারে গড়ে তুলতে হবে। তাঁরা সৈনিক, তারাই আমাদের রক্ষা করবে। অনুষ্ঠানে বক্তারা জুলাই বিপ্লব ও বিজয় পরবর্তী সময়ে দেশ গঠনমূলক বিভিন্ন কাজে বিজিবির ভূয়সী প্রশংসা করেন।

সীমান্তে বিজিবি পিঠ দেখাবে না, বুক দেখাবে
অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, বিজিবিকে অভ্যন্তরীণ কার্যক্রম কমিয়ে সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদারে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। পরে তিনি গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় তিনি বলেন, ‘সীমান্তে উত্তেজনা অনুযায়ী বিজিবিকে সেই রকমই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, প্রস্তুতিও সেই রকমই। কোনো সময় বিজিবি পিঠ দেখাবে না, বুক দেখাবে। বিজিবিকে বলা হয়েছে সীমান্তের কোনো ধরনের উত্তেজনায় কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। কোনো উসকানি আসলে প্রতিহত করতে হবে।

পঞ্চগড় সীমান্তে হত্যা ও সীমান্ত উত্তেজনা প্রসঙ্গ সম্পর্কে তিনি বলেন, আমরা বিজিবিকে নির্দেশনা দিয়েছি যে কোনো ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলার প্রস্তুতি রাখার জন্য। বিজিবি সীমান্তে সব সময় প্রস্তুত থাকবে। তবে সীমান্তে ওই অর্থে সে ধরনের কোনো বড় উত্তেজনা নেই। তিনি আরও বলেন, সীমান্তবর্তী বাংলাদেশি নাগরিকদের বলবো উদ্বেগের কোনো কারণ নেই। নিরাপত্তা নিশ্চিতে আমরা সবসময় প্রস্তুত। সীমান্তবর্তী নাগরিকরা সম্পূর্ণ নিরাপদ। বিজিবিকে কী ধরনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে জানতে চাইলে এই উপদেষ্টা আরও বলেন, বিজিবি অভ্যন্তরীণ ও সীমান্তে নিরাপত্তায় কাজ করবে। তবে অভ্যন্তরীণ কাজ কমিয়ে সীমান্তে মনোযোগ দিতে বলেছি।

ভারত যদি সীমান্ত উত্তেজনা বাড়ায় তাহলে বিজিবির উদ্দেশ্যে আপনাদের নির্দেশনা কি থাকবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ভারত একটা, ভারতের জনগণ অন্য বিষয়। ভারতের জনগণের উত্তেজনায় প্রতিকার করবে গণমাধ্যম, জনগণ আপনারা, আমরা। ওই রকমই নির্দেশনা রয়েছে, ওই রকমই নির্দেশা দেওয়া হয়েছে, প্রস্তুতিও সেই রকমই।

দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া জুলাই আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সারাদেশে বিজিবি অত্যন্ত সহনশীল, মানবিক ও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছে বলে মন্তব্য করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার বিজয় পরবর্তী সময়ে সারাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বিজিবি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও যেকোনো সময়ের চেয়ে সাহসী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, থানাসমূহকে কার্যকর, রাস্তায় ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ, কল-কারখানা সচল রাখাসহ পোশাক শ্রমিকদের বিক্ষোভ দমনে বিজিবি দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করেছে। ছাত্র-জনতার বিজয় অর্জনকে সুসংহত করতে বিজিবি সীমান্তে জোরদার ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।’

তিনি বলেন, তৎকালীন সরকারের প্রায় অর্ধশত বিতর্কিত ব্যক্তিকে সীমান্ত অতিক্রমের চেষ্টাকালে আটক করে আইনের হাতে সোপর্দ করেছে বিজিবি। নতুন প্রেক্ষাপটে বিজিবি দেশের সীমান্ত রক্ষায় জোরদার ভূমিকা পালন করে গত ৩ মাসে সীমান্তে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক চোরাকারবারিদের আটক ও বিপুল পরিমাণ ভারতীয় চোরাচালানী মালামাল জব্দ করতে সক্ষম হয়েছে।

উত্তাল সময়ে বিজিবির ইতিবাচক ভূমিকা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা মিস ফরিদা আখতার বলেন, জুলাই-আগস্ট মাসের উত্তাল সময়ে বিজিবির ইতিবাচক ভূমিকা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। ছাত্র-জনতার বিজয় পরবর্তী সময়ে বিজিবির ভূমিকার অত্যন্ত প্রশংসা করে বলেন, গত দুর্গাপূজা উপলক্ষে সীমান্ত দিয়ে ভারতে ইলিশ পাচার রোধে বিজিবি বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছে। তিনি চোরাচালানের মাধ্যমে বাংলাদেশের ইলিশ যেন ভারতে যেতে না পারে বিজিবিকে সজাগ থাকার আহ্বান জানান।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি এক নতুন বাংলাদেশের ঠিকানা পেয়েছে
অনুষ্ঠান শুরুতেই বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী তার স্বাগত বক্তব্যে জুলাই বিপ্লবে আত্মোৎসর্গকারী বীর যোদ্ধাদের গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করেন এবং তাঁদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করেন। বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি এক নতুন বাংলাদেশের ঠিকানা পেয়েছে। সেই অভিষ্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বিজিবিও ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে যাচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘জুলাই বিপ্লবের শুরু থেকেই বিজিবি স্ব-উদ্যোগে বর্ডার গার্ড হাসপাতালে আন্দোলনে আহতদের চিকিৎসাসেবা প্রদান করে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৫০ জন আহত ছাত্র-জনতাকে বিভিন্ন মেয়াদে বর্ডার গার্ড হাসপাতালে উন্নত চিকিৎসা প্রদান করা হয়েছে।’

সহযোদ্ধা হিসেবে আহত ছাত্র-জনতার পাশে দাঁড়াবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিজিবি মহাপরিচালক বলেন, ‘বিজিবি সারাদেশে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আহত ১০৭ জন ছাত্র-জনতাকে পুনর্বাসন করার জন্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় আজকের এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ৭ জন যোদ্ধাকে সহযোগিতা করা হয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিজিবি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা প্রদান ছাড়াও ইতোপূর্বে বিজিবির উদ্যোগে শহীদ আবু সাঈদ ফাউন্ডেশনে ৫ লক্ষ টাকা, জয়পুরহাটের শহীদ নজিবুল সরকার বিশাল এর পরিবারকে ৩ লক্ষ টাকা এবং রাজধানীর পপুলার হাসপাতালে আহত শিক্ষার্থীদের চিকিৎসা সহায়তা হিসেবে ৫ লক্ষ টাকা প্রদান করা হয়েছে। সীমান্তে যেকোনো অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি মোকাবিলায় বিজিবি সম্পূর্ণ প্রস্তুত রয়েছে উল্লেখ করে ‘সবার উপরে দেশ’ এই মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে বিজিবির প্রতিটি সদস্য ‘সীমান্তে অতন্দ্র প্রহরী’ হিসেবে কাজ করবে।

কালের আলো/এমএসএএকে/এমকে