সম্পর্কের ‘কালো মেঘ’ দূর করতে বাংলাদেশ-ভারত মতৈক্য
প্রকাশিতঃ 10:51 pm | December 09, 2024
কালের আলো রিপোর্ট:
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের টানাপোড়েনের মধ্যেই ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি বিশেষ ফ্লাইটে ঢাকায় এসেছেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি। দুই নিকট প্রতিবেশী দেশের মধ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যেই বৈঠক হয়েছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিন ও ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি’র। সাংবাদিকদের সঙ্গে পৃথক পৃথকভাবে কথা বলেছেন দু’পররাষ্ট্র সচিবই। বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে নিজ দেশ ভারতের আগ্রহের কথা জানিয়েছেন মিশ্রি। বিপরীতে দেশটির সঙ্গে বিদ্যমান সম্পর্ক এগিয়ে নিতে একমত হয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিনও। তিনি দু’দেশের সাধারণ জনগণের ভেতর আস্থা ও বিশ্বাস বিনির্মাণের গুরুত্বের বিষয়ে জোর দিয়েছেন। একই সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচারণা রোধে ভারতের সক্রিয় ভূমিকার আশা করেছেন।
গত সপ্তাহে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগে আগরতলায় বাংলাদেশ মিশনে নজিরবিহীন হামলা করে স্থানীয় হিন্দুত্ববাদী কয়েকটি সংগঠন। এর প্রতিবাদে পরদিন ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনারকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানায় বাংলাদেশ। শেষ মুহূর্তে দুই পররাষ্ট্রসচিবের পূর্বনির্ধারিত বৈঠক নিয়ে কিছুটা হলেও সংশয় তৈরি হয়েছিল। তবে সব শঙ্কা কাটিয়ে ঠিকই সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে তাদের বৈঠক। একই দিন মিশ্রি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক করেছেন।
এই বৈঠকের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কের মধ্যে যে কালো মেঘ তৈরি হয়েছে সেটি দূর হবে বলে আশা প্রকাশ করেছে উভয় দেশ। এ নিয়ে মতৈক্য হয়েছে দু’দেশের। সোমবার (৯ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনার গেটে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপে বাংলাদেশের বন, পরিবেশ ও জলবায়ু বিষয়ক উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, ‘ভারতীয় সচিবের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিভিন্ন কারণে সম্পর্কের মধ্যে যে মেঘ এসেছে, এ মেঘটা দূর করতে হবে। আমরাও বলেছি, মেঘটা দূর করতে হবে। দুপক্ষ একমত হয়েছি, পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট আরও অনেক বিষয় আছে, যেগুলো নিয়ে একসঙ্গে কাজ করার অনেক সুযোগ রয়েছে।’
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তিনি ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। এই বিষয়টি নিয়েই বাংলাদেশ ভারতের প্রথম টানাপোড়েন শুরু হয়। এরই মধ্যে বাংলাদেশিদের ভারতীয় ভিসা দেওয়া প্রায় বন্ধ রয়েছে। বাংলাদেশও ভিসানীতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে যাচ্ছে। সনাতনী জাগরণ মঞ্চের চিন্ময় দাস ব্রহ্মচারীকে গ্রেপ্তারের পর পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা ও বাংলাদেশের পতাকা পোড়ানোর পর দুই কূটনীতিককে ফেরত এনেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশিদের ভারতে চিকিৎসা, হোটেল ভাড়া না দেওয়ার ব্যাপারেও কোনো কোনো রাজ্যে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। স্থলপথে পণ্য আমদানিও বন্ধ আছে কোথাও কোথাও। এছাড়া মমতা ব্যানার্জির বাংলাদেশে শান্তিরক্ষী মোতায়েনের প্রস্তাব পরিস্থিতিকে আরও উত্তপ্ত করেছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে জাতীয় ঐক্যের ডাক দেওয়া হয়েছে। ভারতের বিরুদ্ধে বাংলাদেশেও নানা ধরনের প্রতিবাদ হচ্ছে। ভারতের কিছু সংবাদ মাধ্যমের ‘অপপ্রচার ও ফেক নিউজ’ হচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের যেসব খবর ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে প্রচার হচ্ছে, তাকে ‘অপপ্রচার’ বলছে বাংলাদেশ। এসব ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে ঢাকায় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তাদের প্রথম এই বৈঠকের মাধ্যমে সাম্প্রতিক সময়ে নানা কারণে টালমাটাল দু’দেশের সম্পর্কের বরফ অবশেষে গলার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। সেই সঙ্গে চলমান অস্থিরতারও নিরসন হবে বলে ধারনা করা হচ্ছে। দু’পররাষ্ট্র সচিবের ব্রিফিং ও গণমাধ্যমের সঙ্গে সরকারের প্রভাবশালী উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এর বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে সেই ইঙ্গিতই স্পষ্ট হয়েছে।
বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে আগ্রহী ভারত
সোমবার (৯ ডিসেম্বর) বিকেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে ভারতের আগ্রহের কথা জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘গত ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টার টেলিফোনে আলাপ হয়েছে। আজকের বৈঠকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে আমার বেশ কিছু বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।’ মিশ্রি আরও বলেন, ‘ভারত চায় দুই দেশের ইতিবাচক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সম্পর্ক। অতীতেও আমাদের সেই সম্পর্ক ছিল, সেটি ভবিষ্যতেও আমরা অব্যাহত রাখতে চাই। এই সম্পর্ক জনগণকেন্দ্রিক, যা সবার জন্য কল্যাণকর।’ বিক্রম মিশ্রি বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ইতিবাচক, গঠনমূলক এবং পারস্পরিক স্বার্থনির্ভর সম্পর্ক চায় ভারত। আমাদের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় এবং কূটনৈতিক সম্পত্তির ওপর আক্রমণের মতো সাম্প্রতিক দুঃখজনক কিছু ঘটনার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। ভারত আশা করে, সম্পর্ক বেগবান করতে বাংলাদেশ ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে বিষয়গুলো দেখবে। এসময় তিনি দুই দেশের মধ্যে পর্যটন এবং ব্যবসাক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা আছে সেগুলো দূর করতে কাজ চলছে বলেও জানান।
এরপর ভারতের পররাষ্ট্র সচিব প্রধান উপদেষ্টা ড.মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে প্রায় ৪০ মিনিট বৈঠক করেন। এই বৈঠকে সংখ্যালঘু ইস্যু, অপতথ্য প্রচার, শেখ হাসিনার ভারতে অবস্থান, আঞ্চলিক সহযোগিতা এবং জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থান নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে বিক্রম মিশ্রি বলেন, ‘নয়াদিল্লি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে এবং দুই প্রতিবেশীর মধ্যকার সম্পর্ক জোরদারে ‘সম্মিলিত ও সমন্বিত প্রচেষ্টা’য় আগ্রহী। তিনি বলেন, ‘সম্পর্ক বাড়ানো ছাড়া দ্বিতীয় কোনো চিন্তা নেই। আমরা এটিকে উভয় দেশের জন্যই লাভজনক হিসেবে দেখি। পারস্পরিক স্বার্থের বিষয়ে আলোচনায় তিনি বলেন, আমরা যেখানে ছিলাম সেখান থেকেই আবার শুরু করতে চাই।’
ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের বর্তমান সরকারের সঙ্গে কাজ করতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সম্পর্ককে ‘খুবই দৃঢ়’ এবং ‘ঘনিষ্ঠ’ হিসেবে উল্লেখ করেন। তিনি জানান, সাম্প্রতিক সময়ে দুই প্রতিবেশীর সম্পর্কে কিছু মেঘ জমে ছায়া তৈরি করেছে। এই ‘কালো মেঘ’ মুছে ফেলতে ভারতের সাহায্য চেয়েছেন অধ্যাপক ইউনূস। আলোচনায় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, যিনি এখন ভারতে অবস্থান করছেন, তার প্রসঙ্গও উঠে আসে। বিগত ১৫ বছরের নির্মম ও দুর্নীতিগ্রস্ত স্বৈরশাসনের বর্ণনা করে ভারতের পররাষ্ট্রসচিবকে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমাদের লোকজন উদ্বিগ্ন। কারণ তিনি সেখান (ভারত) থেকে অনেক বক্তব্য দিচ্ছেন। এটা উত্তেজনা সৃষ্টি করছে।
বিক্রম মিশ্রি জানান, তিনি জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের সময় প্রায় প্রতি ঘণ্টায় বাংলাদেশের ঘটনাবলি পর্যবেক্ষণ করেছেন। প্রধান উপদেষ্টা জুলাই-আগস্টে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে শিক্ষার্থী, শ্রমিক ও জনতা কীভাবে এক হয়ে শেখ হাসিনার দুর্নীতিগ্রস্ত শাসনামলের অবসান ঘটিয়েছে তার একটি বিস্তারিত বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, আমাদের কাজ হলো তরুণদের স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখা। এটি একটি নতুন বাংলাদেশ। এসময় অন্তর্র্বতী সরকারের যেসব সংস্কার উদ্যোগ নিয়েছে সেসবের সংক্ষিপ্ত রূপরেখা তুলে ধরেন তিনি। বিক্রম মিশ্রি বলেন, অধ্যাপক ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর যেসব বিদেশি নেতা তাকে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন তাদের মধ্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সামনের সারিতে আছেন। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে গণমাধ্যমের ন্যারেটিভ এবং ভারত সরকারের ধারণা ভিন্ন উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা আপনার সাফল্য কামনা করি।
‘বাংলাদেশের একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক রয়েছে এটি ভুল ধারণা’ উল্লেখ করে বিক্রম মিশ্রি বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক কোনো নির্দিষ্ট দলের জন্য নয়, বরং সবার জন্য। বৈঠকে অধ্যাপক ইউনূস বন্যা এবং পানি ব্যবস্থাপনায় ঘনিষ্ট দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা এবং সার্ককে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য ভারতকে তার উদ্যোগে সাড়া দেওয়ার আহ্বান জানান। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা আমাদের সবার জন্য একটি সমৃদ্ধ নতুন ভবিষ্যৎ গড়তে চাই। বিক্রম মিশ্রি জানান, ভারত সার্কের সঙ্গে কাজ অব্যাহত রেখেছে, যদিও কিছু বাধা রয়েছে।
সংখ্যালঘু ইস্যু সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিটি নাগরিকের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে এবং ধর্ম, বর্ণ, জাতি ও লিঙ্গ নির্বিশেষে সবার অধিকার রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তিনি বলেন, আমরা একটি পরিবার। আমাদের একসঙ্গে কাজ করতে হবে। ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বলেন, ভারত গত মাসে বাংলাদেশিদের জন্য ভিসার সংখ্যা দ্বিগুণ করেছে এবং আগামী দিনে এ সংখ্যা আরও বাড়াবে। ‘আমরা আমাদের সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই’, বলেন তিনি।
অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্য দেশের মন্তব্য সমীচীন নয়
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের ফরেন অফিস কনসালটেশন (এফওসি) বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিন বলেন, ‘বাংলাদেশে বসবাসরত সব ধর্মের মানুষ স্বাধীনভাবে ধর্ম চর্চা করে আসছে। এ বিষয়ে কোনো বিভ্রান্তি ও অপপ্রচারের সুযোগ নেই। তবে, এটি আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়, এ নিয়ে অন্য দেশের মন্তব্য সমীচীন নয়। বাংলাদেশ অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকে, অন্যদেরও একই ধরনের শ্রদ্ধাবোধ আমাদের প্রতি দেখানো উচিত।’
তিনি বলেন, ‘ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি দু’দেশের মধ্যকার ফরেন অফিস কনসালটেশন (এফওসি) উপলক্ষে একদিনের সফরে আজ সকালে বাংলাদেশে এসেছেন। আমি ও ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি দু’দেশের মধ্যে অনুষ্ঠিত এফওসি এ নিজ নিজ দেশের নেতৃত্ব দিয়েছি। আলোচনার পর ভারতের পররাষ্ট্র সচিব প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তার কার্যালয়ে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। ভারতের সঙ্গে আমাদের বিদ্যমান সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে তার আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি দু’দেশের মধ্যে বিদ্যমান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের নানা দিক নিয়ে আলোচনা করেন।’
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, ‘ভারত আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। এ পরিপ্রেক্ষিতে কনসালটেশনে উভয় প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিদ্যমান সম্পর্ক সামনের দিনে আরও এগিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে একমত হয়েছেন। কনসালটেশনে দুই দেশের পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। আমরা বলেছি, আমাদের নিকটবর্তী প্রতিবেশী দেশ ভারত। আমরা দু’দেশের মধ্যে বিদ্যমান অনিষ্পন্ন বিষয়গুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ভারতের সহযোগিতা কামনা করি। এ লক্ষ্যে আমরা একযোগে কাজ করার বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছি। আমি দু’দেশের সাধারণ জনগণের ভেতর আস্থা ও বিশ্বাস বিনির্মাণের গুরুত্বের বিষয়ে জোর দিই এবং এক্ষেত্রে বাংলাদেশের সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচারণা রোধে ভারতের সক্রিয় ভূমিকা আশা করেছি।’
ভারতের ভিসাপ্রাপ্তি সহজীকরণসহ অন্যান্য কনস্যুলার সেবা সহজ করার জন্য অনুরোধ করেছে বাংলাদেশ। এ প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিন বলেন, ‘প্রতি বছর পর্যটন এবং চিকিৎসা উপলক্ষে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি ভারত সফর করে। তাদের ভিসাপ্রাপ্তি সহজীকরণসহ অন্যান্য কনস্যুলার সেবা সহজ করার জন্য আমরা অনুরোধ জানিয়েছি। যেসব বাংলাদেশি নাগরিক ভারতের আদালতের দেওয়া সাজা বাংলাদেশে অথবা ভারতে ভোগ করছে তাদের সাজা মওকুফের বিষয়ে ভারতের যথাযথ বিবেচনার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। এছাড়া ভারতে আটক বাংলাদেশের জেলেদের মুক্তির বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনা আমাদের অগ্রাধিকার। আমরা বিশ্বাস করি প্রতিটি জীবন মূল্যবান। এই লক্ষ্যে ভারত সরকারকে দৃশ্যমান কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে আমরা অনুরোধ করেছি। তাছাড়া আন্তঃসীমান্ত অপরাধ, মাদক পাচারসহ অন্যান্য অপরাধমূলক কার্যক্রম নির্মূলে ভারতের সহযোগিতাসহ সীমান্ত সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি সমস্যা সমাধানে ভারত সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছি।’
আজকের আলোচনায় আন্তঃনদী বিষয়সমূহ গুরুত্ব পেয়েছে জানিয়ে সচিব বলেন, ‘আমি তিস্তা নদীর পানি চুক্তি সম্পন্ন করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছি। গঙ্গা-পানি চুক্তির মেয়াদ ২০২৬ সালে উত্তীর্ণ হয়ে যাবে। সে প্রেক্ষিতে তা নবায়নের প্রক্রিয়া শুরু করার প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্ব দেই। এছাড়াও আরও যে কয়টি আন্তঃসীমান্ত নদীর পানি বণ্টন সংক্রান্ত চুক্তি দুই পক্ষের মধ্যে আলোচনাধীন, সেসব সম্পন্ন করার জন্য বিশেষ জোর দেই। বন্যা পূর্বাভাস, উপাত্ত/ডাটা আদান-প্রদানসহ বন্যা প্রতিরোধে ভারতের সার্বিক সহযোগিতা কামনা করি এবং এ বিষয়ে একটি উচ্চ-পর্যায়ের মেকানিজম গঠন করার বিষয়ে আলোচনা করি।’
তিনি আরও বলেন, ‘ভারত আমাদের অন্যতম বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার। ভারতের সঙ্গে আমাদের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য বৃদ্ধির জন্য বিদ্যমান ট্যারিফ, প্যারা-ট্যারিফ এর মতো বাধাসমূহ দূর করার ওপর আমরা গুরুত্ব আরোপ করেছি। আমরা ভারত থেকে আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেছি। বর্তমানে ভারতের সঙ্গে জ্বালানি এবং বিদ্যুৎ খাতে আমাদের পারস্পরিক সহযোগিতা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমরা ভারত থেকে বর্তমানে প্রায় ২৬৫৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করছি। চলমান ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই সহযোগিতা বৃদ্ধি পেতে পারে। ভারতের মধ্য দিয়ে নেপাল ও ভুটান থেকে জলবিদ্যুৎ আনার বিষয়েও ভারতের সহযোগিতা প্রয়োজন।’ এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় এবং রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানে বাংলাদেশে অবস্থানরত ১.২ মিলিয়ন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে ভারতের সহযোগিতার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার করতে চায় ভারত
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিসরির বৈঠকের বিষয়ে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, বৈঠকে ভারতের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তারা বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এগিয়ে নিতে এবং আরও জোরদার করতে আগ্রহী। জুলাই-আগস্ট বিপ্লব ভারত মনিটর করেছে, দেখেছে এবং অবগত। আমাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সার্ককে শক্তিশালী ভূমিকায় দেখতে চাই। আমরা যে একসঙ্গে বিমসটেকে আছি সেটাও বলেছি। আমাদের বিষয়ে বিভিন্ন যে প্রোপাগান্ডা চালানো হচ্ছে সে বিষয়ে উদ্বেগ জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। সেখান থেকে বিভিন্ন কথাবার্তা বলার মাধ্যমে এক ধরনের উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টা হচ্ছে। এ বিষয়ে উদ্বেগ আমাদের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ সম্প্রীতির দেশ উল্লেখ করে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশের ইমেজ প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছে। জুলাই-আগস্টের অভ্যুত্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। এগুলোর বিষয়ে তাদের বক্তব্য হচ্ছে, ভারতীয় সরকার কোনোভাবে দায়ী না। সরকার এগুলো করছে না, ‘ওন’ও করছে না। এগুলো মিডিয়া ও সংগঠনের পক্ষ থেকে করা হচ্ছে। ভিসার বিষয়ে উপদেষ্টা বলেন, ভারতের পক্ষ থেকে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে ভিসা বাড়ানোর উদ্যোগ তারা গ্রহণ করবেন।
বাংলাদেশের উপ-হাইকমিশনে হামলার বিষয়ে বৈঠকে আলোচনা হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নে সৈয়দা হাসান বলেন, উপ-হাইকমিশনে সহিংস আচরণের বিষয়ে আমরা আগেই প্রতিবাদ জানিয়েছি এবং তারা দুঃখ প্রকাশ করেছে। আজকে যেহেতু তারা অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নিয়ে যাওয়া ও জোরদার করার কথা বলছেন, তাই আমরা ধরেই নেবো সে ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশের অবস্থানে তারা এখনও আছে। নতুন করে এটা বলা হয়নি।
বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা যে শঙ্কার কথা বলেছেন এবং অপ্রচারের জবাব বাংলাদেশ কীভাবে দিয়েছে– এমন প্রশ্নে সৈয়দা হাসান বলেন, প্রোপাগান্ডার জবাব লিখিত ও মৌখিক বহুভাবে বলেছি। যতগুলো ঘটনা ঘটেছে সেগুলো সাম্প্রদায়িক হিসেবে দেখানোর সুযোগ কম। সেগুলো ব্যক্তিগত এবং বেশির ভাগ রাজনৈতিক। আমাদের স্পষ্ট অবস্থান হচ্ছে বাংলাদেশ সরকার এটার অংশ না, এবং কোনও ঘটনা বরদাস্ত করছে না, অভিযোগ এলে আইনগত প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ভারতীয় সচিবের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিভিন্ন কারণে আমাদের সম্পর্কের মধ্যে যে মেঘ এসেছে, এটা দূর করতে হবে। আমরাও বলেছি এ মেঘটা দূর করতে হবে। একই সঙ্গে দুপক্ষ একমত হয়েছি পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট আরও অনেক বিষয় আছে, সেগুলো নিয়ে একসঙ্গে কাজ করার অনেক সুযোগ রয়েছে।
তিনি বলেন, নির্বাচনের প্রশ্নে আমরা স্পষ্ট অবস্থান ব্যক্ত করেছি। নির্বাচন অবাধ, স্বাধীন ও নিরপেক্ষ হবে এবং একটা গণতান্ত্রিক দেশের দিকে যাত্রা শুরুর জন্য সরকার বদ্ধপরিকর। এ বিষয়ে সকলেই আমাদের পাশে থাকবে। সহায়তা করবে এবং একসঙ্গে কাজ করে যাবেন বলে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন।
কালের আলো/এমএএএমকে