তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তনের কাউন্ট ডাউন
প্রকাশিতঃ 10:42 am | December 14, 2024
মো.শামসুল আলম খান, কালের আলো:
প্রায় ১৭ বছর যাবত তিনি দেশের বাইরে। তাঁর সঙ্গে জড়িয়ে আছে কোটি কোটি নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষের আবেগ-অনুভূতি। বিশেষ করে গত ৫ আগস্টে ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর তাঁর দেশে ফেরা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়। আগামী রাষ্ট্রনায়ক তারেক রহমানের অপেক্ষায় এখন গোটা দেশ। একের পর এক মামলার জাল থেকে বেরিয়ে আসার মধ্যে দিয়ে ক্রমশ উচ্চকিত হচ্ছে তাঁর দেশে ফিরে আসার বিষয়টি। পতিত সরকারের সময় দেওয়া ৮৪টি মামলার মধ্যে ইতোমধ্যেই ৪২টি মামলা থেকে খালাস পেয়েছেন বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান।
সম্প্রতি লন্ডন থেকে দেশে ফিরে বিএনপি’র মহাসচিব মির্জ ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়েছেন, মিথ্যা ও প্রতিহিংসামূলক সব মামলা প্রত্যাহার বা মীমাংসা শেষে দেশে ফিরবেন তারেক রহমান। দলটির দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতার এমন বক্তব্যের পর থেকেই শুরু হয়েছে কাউন্ট ডাউন। অনেকের ধারণা, নতুন বছরের ফেব্রুয়ারি মাসেই স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করতে পারেন বিএনপি’র এই শীর্ষ নেতা।
জানা যায়, মঈন-ফখরুদ্দিনের জরুরি সরকারের সময়ে ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে জামিনে মুক্তি নিয়ে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে যান বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এরপর থেকেই তিনি লন্ডনে অবস্থান করে দলের সার্বিক কার্যক্রমে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে তাঁর বিরুদ্ধে মোট ৮৪ মামলা দায়ের হয়। পাঁচটিটিতে দণ্ড হয় তারেক রহমানের বিরুদ্ধে। বিচার প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে এখন অবধি অন্তত ৪২টি মামলায় খারিজ, খালাস ও অব্যাহতি পেয়েছেন তিনি। সবশেষ ষড়যন্ত্রমূলক ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলা থেকে খালাস পেয়েছেন। এছাড়া সিলেটে দুই মামলা এবং পিরোজপুরে এক মামলা খারিজ করা হয়। এছাড়া অর্থপাচারের অভিযোগের মামলায় তাকে দেওয়া সাত বছরের দণ্ড স্থগিত করেছেন আপিল বিভাগ।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলের পাশাপাশি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের বিভিন্ন কর্মসূচিতে ভার্চুয়ালি সরাসরি যুক্ত থেকে নিয়মিতই বক্তব্য রাখছেন। তবে নিজের দেশে ফেরা নিয়ে তিনি কখনও নিজে কোন কথা বলেননি। বিভিন্ন পরিমণ্ডলে বলাবলি হচ্ছেÑ দেশে ফিরতে চূড়ান্ত গ্রিণ সিগন্যালের অপেক্ষায় রয়েছেন তিনি। পাশাপাশি কোন কোন সূত্র বলছে, বিদেশে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার চিকিৎসা শেষে আগামী ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে একসঙ্গে মা-ছেলে দেশে ফিরবেন।
একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায়ের পর গত ১ ডিসেম্বর জাতীয় প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত একটি কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান আমাদের মধ্যে সহিসালামতে ফিরে আসবেন খুব তাড়াতাড়ি।
সম্প্রতি লন্ডনে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, দল যখন মনে করবে, তখন তারেক রহমান দেশে ফিরবেন। এছাড়া তার আরও কিছু আইনি জটিলতা রয়েছে, সেগুলো শেষ করে দেশে যাবেন।
যদিও ভিন্ন কথা বলেছেন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের সভাপতি এবং বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদিন ও দলটির আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল। তাঁরা মনে করেন, মামলার সঙ্গে তারেক রহমানের দেশে ফেরার কোনো সম্পর্ক নেই। মামলা আইনের গতিতে চলবে। উনি কবে দেশে ফিরবেন এটি নির্ভর করছে তাঁর ইচ্ছার ওপর।’
জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক রাজিব আহসান বলেন, ‘তারেক রহমানের নামে অসংখ্য মামলা রয়েছে যেগুলো মিথ্যা ও বানোয়াট। সেই মামলাগুলোর প্রসেসিং চলছে। আশা করি সংশ্লিষ্ট সবাই সহযোগিতা করবে।’ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সভাপতি রাকিবুল ইসলাম রাকিব বলেন, ‘তারেক রহমান আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তার মামলাগুলো পর্যবেক্ষণ করছেন। সবমিলিয়ে তিনি দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নেবেন। আমরা চাই সরকার এই ডিসেম্বরের মধ্যেই তার নামে দায়ের হওয়া মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করে নেবে।’ ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ^বিদ্যালয় ছাত্রদলের প্রতিষ্ঠাতা সাবেক সভাপতি শাহাবুল আলম বলেন, ‘আগামীর রাষ্ট্রনায়ক তারেক রহমান বীরের বেশে দেশে ফিরবেন। আমরা আমাদের অভিভাবকের দেশে ফেরার প্রতীক্ষার প্রহর গুণছি। তিনি যেদিন দেশে ফিরবেন সেদিন জনসমুদ্রের মাধ্যমে প্রিয় নেতাকে অভিবাদন জানানো হবে।’
দলীয় সূত্র জানায়, এখনও তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং মামলা, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলা, জ্ঞাত আয় বহিভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা ও মানহানির মামলার সাজা রয়েছে। এর মধ্যে বিদেশে অর্থপাচারের অভিযোগে ২০১৩ সালের ১৭ নভেম্বর একটি মামলায় ঢাকার বিশেষ জজ আদালত তারেক রহমানকে খালাস দেন। ওই মামলায় বিশিষ্ট ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন আল মামুনকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তারেক রহমানকে খালাসের রায়ের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) হাইকোর্টে আপিল করে। ওই আপিল শুনানি শেষে হাইকোর্ট ২০১৬ সালের ২১ জুলাই বিচারিক আদালতের খালাসের রায় বাতিল করে তারেক রহমানকে সাত বছরের কারাদণ্ড দেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে সম্প্রতি গিয়াস উদ্দিন মামুনকে আপিলের অনুমতি দিয়েছেন আপিল বিভাগ। একইসঙ্গে হাইকোর্টের রায় স্থগিত করেছেন।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতির মামলায় ঢাকার বিশেষ জজ আদালত ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি তারেক রহমানকে ১০ বছর কারাদণ্ড দেন। এই মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে পাঁচ বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তবে দুদকের আপিলে খালেদা জিয়ার সাজা বাড়িয়ে ১০ বছর করেছিলেন হাইকোর্ট। পরে খালেদা জিয়াকে আপিলের অনুমতি দিয়েছেন আপিল বিভাগ। একইসঙ্গে হাইকোর্টের দেওয়া রায় স্থগিত করেছেন। একই সঙ্গে জ্ঞাত আয় বহির্ভূতভাবে সম্পদ অর্জন ও সম্পদের তথ্য গোপনের অভিযোগের মামলায় ২০২৩ সালের ২ আগস্ট ঢাকার সিনিয়র বিশেষ জজ আদালত তারেক রহমানকে নয় বছর ও তার স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমানকে তিন বছর কারাদণ্ড দেন। এছাড়া ২০১৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর লন্ডনে যুক্তরাজ্য বিএনপি আয়োজিত এক সমাবেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে বক্তব্য দেন তারেক। সেই খবর প্রকাশিত হয় দেশের একটি জাতীয় দৈনিকে। ওই বক্তব্যে শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মানহানি হয়েছে জানিয়ে সে সময় নড়াইলের মুক্তিযোদ্ধা শাহজাহান বিশ্বাস নড়াইল জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে তারেকের বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেন। এই মামলায় নড়াইলের একটি জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত ২০২১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি তারেক রহমানকে দুই বছরের কারাদণ্ড দেন।
জানতে চাইলে বিএনপির আইন বিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল জানান, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে গত ওয়ান ইলেভেন সরকারের সময় ২১টি মামলা ছিল। এরপর শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পরে একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা, অর্থপাচার মামলা হলো। পরবর্তীসময়ে ২০১৪-১৫ সালের দিকে তারেক রহমান লন্ডনে একটা বক্তব্য দিয়েছিলেন, সেই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে দেশের প্রায় ৬৪ জেলায় ছাত্রলীগ, যুবলীগ বা অনেক আইনজীবী মানহানির মামলা করেছিলেন। সবমিলিয়ে ৮৪টির মতো মামলা রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘ওয়ান ইলেভেনের সময়ে দায়ের হওয়া অনেকগুলো মামলা উচ্চ আদালতে বাতিল করা হয়েছে। মানহানিরও অনেকগুলো মামলা খারিজ হয়ে গেছে। আইনি প্রক্রিয়ায় সবগুলো মামলা বাতিল হয়েছে। যে সব মামলায় তিনি চার্জশিটভুক্ত ছিলেন না, এফআইআরেও নাম ছিল না সে সব মামলায় আমরা আদালতে গিয়েছি আদালত বাতিল করে দিয়েছেন।’
কালের আলো/এমএসএএকে/এমকে