বিজয় নিশান ঘরে ঘরে
প্রকাশিতঃ 9:28 am | December 16, 2024
এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, অ্যাকটিং এডিটর, কালের আলো:
মহান মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহ দিনগুলোর সময় জন্ম হয়নি আমার। দেখা হয়নি ভয়ার্ত দিনগুলোতে হানাদারদের বীভৎসতা। তবে বই-পুস্তক, নাটক আর চলচ্চিত্রের পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনেছি কিংবদন্তিদের মুখে। বাঙালি জাতির সূর্য সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মুখ থেকেই আমি অনেকবার শুনেছি অগ্নিঝরা দিনের স্মৃতি। একাত্তরের রণাঙ্গনের বীর সেনানীরা বলতেন আর এক অদৃশ্য সেলুলয়েডে আমি মনে আঁকতাম মুক্তিযুদ্ধের চিত্রকল্প।
আমাদের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ ঘটনা একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর ৯ মাসের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির কয়েক হাজার বছরের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বপ্নসাধ পূরণ হয় ১৬ ডিসেম্বর। স্বাধীন জাতি হিসেবে বীরের জাতি বাঙালি সমগ্র বিশ্বে আত্মপরিচয় লাভ করে। অর্জন করে নিজস্ব ভূখণ্ড আর সবুজের বুকে লাল সূর্য-খচিত নিজস্ব জাতীয় পতাকা। ভাষার ভিত্তিতে যে জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছিল, এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বিজয়ের মাধ্যমে ঘোষিত স্বাধীনতা পূর্ণতা পায় এই দিনে। বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্নপূরণ হওয়ার পাশাপাশি বহু তরতাজা প্রাণ বিসর্জন আর মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে এই অর্জন হওয়ায়-বেদনাবিধুর এক শোকগাঁথার মাসও এই ডিসেম্বর।
আমি সেই শৈশবেই নিজের পরিবার থেকে জেনেছি পাকিস্তানি সামরিক জান্তার শোষণ, বঞ্চনা, নির্যাতন ও বর্বরতার দীর্ঘ অধ্যায়ের বাস্তব চিত্র। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণার পর ২৭ মার্চ আমার নিজ জেলা ময়মনসিংহ শহরের খাগডহরে রাতভর যুদ্ধ হয়। সেই যুদ্ধের খবর ছড়িয়ে পড়লে এখানকার প্রতিটি উপজেলার গ্রামের পর গ্রামে মুক্তিযুদ্ধে যাবার জন্য যুবকদের মাঝে সাড়া পড়ে যায়। ওই সময় গ্রামের ধনাঢ্যদদের থ্রি-ব্র্যান্ড রেডিও ছিল। রেডিওতে স্বাধীন বাংলা বেতার শোনা তখন যুদ্ধ অবরুদ্ধ মানুষের কাজ ছিল। সন্ধ্যার পরপরই স্থানীয় গ্রামের মানুষজন জড়ো হতেন সেখানে। মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া না হলেও অনেকেই ও তার সমবয়সীরা খেলতেন ‘যুদ্ধ।’ বড়রা যখন দেশের খবর বলতো তখন তারা গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতেন।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সূচনার মাস মার্চ। বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের আহবানও এসেছিল এই মাসেই। জেগে উঠে বাঙালি জাতি। হায়েনাদের বিপক্ষে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে শুরু হয় প্রস্তুতি। ২৫ মার্চের কালো রাতে পাকিরা নৃশংসতম, পৈশাচিক ও বর্বর কায়দায় হাজার হাজার নিরস্ত্র বাঙালিকে হত্যা করলো। ত্রিশ লাখ প্রাণের আত্মদান এবং ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে নয় মাসের রক্তয়ী মুক্তিযুদ্ধের পর বিজয়ের প্রভাতী সূর্যের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল শিশির স্নাত মাটি। পাকিদের হটিয়ে মুক্তির স্বাদ নিয়েছিল বীর বাঙালি। অর্জিত হয়েছিল চির আকাক্সিক্ষত স্বাধীনতা। বিশ্ব মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটলো স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশের।
এবারের মহান বিজয় দিবসকে নতুন মাত্রা দিয়েছে জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান। রক্তক্ষয়ী আন্দোলনের পর বাংলাদেশে গত ৫ আগস্ট ঘটে গেছে এক অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থান। শত শত প্রাণের বিনিময়ে পতন ঘটেছে ফ্যাসিবাদের। জাগিয়ে তুলেছিল বাংলাদেশের হৃদয়। এই অভ্যুত্থান দেশলাইয়ের কাঠির মতো জ্বলে উঠে ছাত্র-জনতা, যাদের মধ্যে আগে থেকেই ক্রমবর্ধমান জীবনযাত্রার ব্যয়, দুর্নীতি ও ভিন্নমতের ওপর সহিংস দমন-পীড়নের কারণে চরম ক্ষোভ-অসন্তোষ ছিল। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের চেয়েও প্রবল ও রক্তাক্ত ছিল ছাত্র-নাগরিকের এই গণঅভ্যুত্থান। বেশিরভাগ মানুষের কাছে মুক্তির বার্তা নিয়ে আসে বলেই কীনা তাই অনেকেই বলতে থাকেন, ‘আমরা আরেকবার স্বাধীন হয়েছি!’ অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড.মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে পথচলা শুরু হয়েছে নতুন এক বাংলাদেশের।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ক্ষমতার পালাবদলে সংগ্রামী ছাত্র-জনতা গতানুগতিক রাজনীতি থেকে বেরিয়ে এসে সুষ্ঠু সুন্দর গণতান্ত্রিক রাজনীতির সংস্কৃতির প্রবর্তন করেছে। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দেশের সূর্যসন্তানদের হাতে অর্পণ করেছে নতুন বাংলাদেশ গড়ার গুরুদায়িত্ব। এই সরকারের শরীরে লেগে রয়েছে মানুষের রক্ত-মিশ্রিত অঙ্গীকার পালনের দায়বদ্ধতা। যার মধ্যে রয়েছে বৈষম্য রোধ করা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ করার মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। এছাড়া রাষ্ট্র কাঠামোর যেখানে যে সংস্কার দরকার সেই সংস্কারের সঙ্গে ছাত্র-নাগরিকরা নিজেদের করেছে একাত্ম। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম যথার্থই বলেছেন, ‘এই আন্দোলনের গাঁথুনির যে শক্তি ছিল তাতে গুরুত্বপূর্ণ ছিল ভাবাদর্শিক বোঝাপড়া। এটাই সামনের দিনের রাজনীতি ঠিক করবে। অভ্যুত্থানের সময় যে নতুন মুহূর্ত সৃষ্টি হয়েছে, সেটির পুনর্মঞ্চায়ন করে যেতে হবে।’
মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হচ্ছে দেশপ্রেমের চেতনা। ৩০ লাখ শহীদের আত্মদান ও মর্যাদা আমাদেরই সমুন্নত রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, কোন দেনদরবার নয়। কারও দয়ার দানে নয়, সাগর-সমান রক্তের দামে বাংলাদেশ অর্জন করেছে স্বাধীনতা, রক্ত-সাগর পেরিয়ে বাঙালি জাতি পৌঁছেছে তার বিজয়ের সোনালি তোরণে। নতুন প্রেক্ষাপটে এই সময়ে যখন বাঙালি জাতি বিজয় দিবস উদযাপন করবে তখন আমরা চাই জনযুদ্ধের বাস্তবতা থেকে মুক্তিযুদ্ধকে এবং একই ধারাবাহিকতায় ২৪’র গণঅভ্যুত্থানকে দেখতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের মতোই এবারও ছাত্র-নাগরিকরা কোন অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেনি।
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সবচেয়ে গৌরবের দিনটিতে আমি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার সঙ্গে স্মরণ করছি মহান মুক্তিযুদ্ধ ও ২৪’র গণঅভ্যুত্থানে সকল শহীদের আত্মদানকে। কেবল দিবস উদযাপন নয়, এর অন্তর্নিহিত তাৎপর্যও আমাদের হৃদয় ও মননে ধারণ করতে হবে। স্বাধীনতার স্বপ্ন পূরণে সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলমও ইতোমধ্যেই বলেছেন, ‘৭১’-এর হানাদার বাহিনীর জুলুমের পুনরাবৃত্তি হয়েছে ২৪-এর জুলাইয়ে।’ তাই এবারের বিজয় দিবস আলাদা তাৎপর্য বহন করছে। আমরা চাই ড.মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার সবাইকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে বৈষম্যহীন, মানবিক এবং গণতান্ত্রিক দেশ বিনির্মাণ করুক। বিজয় নিশান উড়ছে ঐ/বাংলার ঘরে ঘরে…। আমরা চাই এই নিশান কখনো অবনত হবে না। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আর বিকৃত না হোক। নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জেনে দেশ গঠনে একসঙ্গে কাজ করুক- এই হোক বিজয়ের ৫৩ বছরে আমাদের দৃপ্ত অঙ্গীকার।
কালের আলো/এমএএএমকে