মহান বিজয় দিবসে নতুন বাংলাদেশে সম্মিলিত সংকল্প
প্রকাশিতঃ 9:34 am | December 16, 2024
মো.শামসুল আলম খান, এডিটর, কালের আলো:
১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১। দীর্ঘ নয় মাসের গৌরবোজ্জ্বল রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়। আত্মত্যাগ, নানা বিসর্জন আর সম্ভ্রমের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি হায়েনা মুক্ত স্বদেশ। শত বছরের শত সংগ্রামের একটি বড় পাওয়া প্রিয় স্বাধীনতা, লাল সবুজের পতাকা। নয় মাসের অনিশ্চয়তা, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার অবসান ঘটিয়ে আমাদের মুক্তিবাহিনী বিজয়ের পতাকা উড়িয়েছিল মুক্ত স্বাধীন স্বদেশের মাটিতে। মানুষ মুক্তি ও স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিল।
একাত্তর ছিল বাঙালির জীবনে সবচেয়ে গৌরবের সময়। একাত্তরের নয় মাস বাঙালির জীবনে যে আনন্দ-বেদনার মহাকাব্য রচিত হয়েছিল, তা এককথায় অতুলনীয়। একাত্তরের সেই দিনগুলোতে সবার মধ্যে জেগে উঠেছিল প্রবল দেশাত্মবোধ ও দেশপ্রেম। যে কারণে সময়ের ডাকে সাড়া দিয়ে আমাদের পূর্বপুরুষেরা তাঁদের যাঁর যা কর্তব্য সেটিই নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছিলেন। তবে আমরা বিজয় ধরে রাখতে পারিনি। নানা সময়ে কৌশলগত কারণে বা অন্য কোনো যুক্তিতে আত্মসমর্পণ করেছি। আপস করেছি। পরাজিত মানসিকতা নিয়ে আমরা বিজয়ের আনন্দে মেতে ওঠার চেষ্টা করেছি।
কিন্তু চলতি বছরের জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতা বুকের তাজা রক্ত ঢেলে পুনরায় আমাদের দিয়েছে স্বাধীনতার স্বাদ। আমি মনে করি, আমাদের একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের ও ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের শহীদদের স্বপ্ন ছিল এক ও অভিন্ন। এই গণঅভ্যুত্থান এক দিনে হয়নি। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় রাষ্ট্র ও সমাজে জেঁকে বসা অনিয়ম, দুর্নীতি, লুটপাট, দখলদারিত্ব, অর্থ পাচার, বিচারহীনতা ও ঋণখেলাপির বহমান সংস্কৃতির বিরুদ্ধে দীর্ঘ সময় যাবত ক্ষোভে ফুঁসে ওঠেছিল দেশের সাধারণ মানুষ। পরিবর্তনের স্বপ্নে তাঁরা বিভোর ছিলেন। কিন্তু ছাত্র-জনতা শিশার ঢালা প্রাচীরের ন্যায় ঐক্যবদ্ধ থেকে স্বৈরতন্ত্রকে বিদায় করে।
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার স্বৈরতন্ত্রকে অল আউটের মধ্যে দিয়ে তাঁর দম্ভ-অহমিকারও পতন ঘটাতে সক্ষম হয়। ঐক্যবদ্ধ ছাত্র-জনতার রুদ্ররোষে উপলখণ্ডের মতো ভেসে গেছেন। এখন দেশের আপামর জনসাধারণ মুক্ত পরিবেশে, দীর্ঘদিনের আকাক্সিক্ষত গণতান্ত্রিক চর্চার সুযোগ লাভ করেছে। এর মাধ্যমে আমরা পুনরায় দেখতে পেলাম আধুনিককালে কোনো স্বৈরশাসকই গণঅভ্যুত্থানের প্রবল প্রতিরোধের মুখে তাঁর মসনদ রক্ষা করতে পারেনি।
৫ আগস্টের নতুন প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে। সত্যের পথে ইতিহাসের অভিযাত্রা শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের সব দিগন্তে এক নতুন সূর্য উঠেছে। উদ্ভাসিত এই সূর্যের প্রতিটি আলোকবিন্দুতে এ যেন রেনেসাঁর দ্যুতি। মুক্তির পথ দেখাবে এই রেনেসাঁ। এই দেশের মানুষ সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক বিন্যাস ও পটভূমির আলোকেই এক নতুন রেনেসাঁর জন্ম দিয়েছে। কার্যত এই রেনেসাঁ জাতীয় মুক্তির চেতনায় আলোকিত একটি বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থাকে। এক স্বত:স্ফূর্ত নবজাগরণ এই জাতিকে নব উদ্বোধনের চালিকাশক্তি হিসাবে আবির্ভূত করেছে। যেমনটি ঘটেছিল মহান মুক্তিযুদ্ধে, একাত্তরে। একাত্তর ও চব্বিশের চেতনাকে সুসংহত করতে হবে।
বিগত ৫৩ বছরে আমাদের যেমন অনেক অর্জন আছে, তেমনি পেয়ে হারানো এবং না পাওয়ার দুঃখ-বেদনাও আছে। মুক্তিযুদ্ধের মতোই জুলাই গণঅভ্যুত্থান আমাদের আত্মমর্যাদা নিয়ে দাঁড়াতে শিখেছে। এই আত্মবিশ্বাস নিয়েই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড.মুহাম্মদ ইউনূস এর নেতৃত্বে আমরা নতুন বাংলাদেশ গড়তে চাই। এখন সময় স্বৈরাচারের দানবীয় দুর্নীতির কলঙ্ক দূর করা। দেশের সর্বস্তর থেকে দুর্নীতিকে উৎখাত করতে হবে চিরতরে। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে অন্তর্বর্তী সরকার প্রধানের বাণীতে আমরা আশান্বিত হয়েছি। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, ‘ছাত্র-শ্রমিক-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকার একটি উন্নত, সমৃদ্ধ ও সুশাসিত বাংলাদেশ গঠনে অঙ্গীকারবদ্ধ।’ তাঁর কথার সঙ্গে একাত্ম হয়ে আমরা চাই একটি ন্যায়নিষ্ঠ, বৈষম্যহীন ও কল্যাণকামী রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে উঠুক। মহান বিজয় দিবসে এই হোক আমাদের সম্মিলিত সংকল্প।
কালের আলো/এমএ/আরবিএ