মুক্তিযুদ্ধে খালেদা জিয়ার বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার মূল্যায়ন হয়নি আজও

প্রকাশিতঃ 4:39 pm | December 16, 2024

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:

অনেক পরিচয়ে পরিচিত তিনি। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী, দেশের সবচেয়ে বৃহৎ রাজনৈতিক দলের চেয়ারপার্সন। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার ও জেড ফোর্সের অধিনায়ক শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের স্ত্রী এবং তাঁর আজীবনের ছায়াসঙ্গী। তবে সব পরিচয় ছাপিয়ে ২০২২ সালের ২৫ মার্চ বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে দেশের প্রথম নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে দাবি করেন। প্রায় ৪১ বছর যাবত দেশের গণতন্ত্রের জন্য লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া বেগম জিয়াকে নিয়ে দলটির দ্বিতীয় শীর্ষ নেতার এমন মন্তব্যের প্রেক্ষিতে সেই সময় সমালোচনায় মেতেছিলেন শাসক দলটির নেতারা। তবে প্রকৃত অর্থেই ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ চট্টগ্রামের ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সহ-অধিনায়ক মেজর জিয়ার অনুপস্থিতিতে বেগম খালেদা জিয়া তাৎক্ষণিকভাবে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের সেন্ট্রাল অর্ডিনেন্স ডিপো (কোড) বা ‘কেন্দ্রীয় অস্ত্রাগার’ থেকে ১৭ বেলুচ সৈন্যদের অস্ত্র না দেওয়ার সিদ্ধান্ত প্রদান করেন। এরই মাধ্যমে তিনি প্রকারান্তরে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে অস্ত্রহীন হওয়া থেকে রক্ষা করেছিলেন। সেদিনের ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় অবশ্যই প্রতীয়মান হয় দেশের প্রথম নারী মুক্তিযোদ্ধা তিনিই।

এই ঘটনাটিকেই প্রায় আড়াই বছর আগে নিজের জবানীতে তুলে এনেছিলেন বিএনপি মহাসচিব। ওইদিন তিনি আরও বলেছিলেন-‘যে নেত্রী (খালেদা জিয়া) একজন গৃহবধূ ছিলেন। প্রথম জিয়াউর রহমান সাহেবের বিদ্রোহের পর তাঁর স্ত্রী, তিনি সেদিন যখন সোয়াত জাহাজের দিকে এগোচ্ছিলেন, তখন পাকিস্তানি কমান্ডার আমাদের অষ্টম বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডার সোহরাব হোসেনসহ সেনাবাহিনীর সৈনিকদের নিরস্ত্র করার চেষ্টা করছিল। সেই সময় খালেদা জিয়া প্রথম বলেছিলেন, “তোমরা অস্ত্র সমর্পণ করবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত না জিয়াউর রহমান ফিরে আসেন।” এ-ই দিয়ে তাঁর শুরু।’ তবে মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই বেগম জিয়ার এমন বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার মূল্যায়ন হয়নি এখনও।

একই ঘটনার প্রমাণ মেলে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) সৈয়দ আবু ব্কর সিদ্দিক’র মন্তব্যেও। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র খণ্ড-৯ এর উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেছেন, ‘১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ বিকেল ৪টার দিকে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের সেন্ট্রাল অর্ডিনেন্স ডিপোর (কোড) কেন্দ্রীয় অস্ত্রাগারের পাহারায় ছিলেন হাবিলদার কাদের ও তৎকালীন সিপাহী পরবর্তীতে হাবিলদার নুরুল হক। এ সময় ১৭ বেলুচ-এর একটি দল আসে চট্টগ্রাম সেনানিবাসের ষোলশহরস্থ ‘কোডে’। তারা চট্টগ্রাম সেনানিবাসসহ তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের অন্যান্য সেনানিবাসের বাঙালি ইউনিটের অস্ত্র ‘আর আর ৭৭ ও ৭৬ (রাইফেলের রেঞ্জ ৭৭ ও ৭৬ মিটার) পশ্চিমা ইউনিটে জমা করার আদেশ পালনের জন্য এসেছেন বলে উল্লেখ করেন।’

এ ঘটনার নেপথ্যে কলকাঠি নাড়েন লেফটেন্যান্ট কর্নেল আবদুর রশিদ জানজুয়া। মূলত তাঁর নির্দেশেই ১৭ বেলুচ থেকে সৈনিকরা এই অস্ত্রাগারের অস্ত্র নিয়ে যেতে আসলে হাবিলদার কাদের’র নির্দেশে নুরুল হক ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেন্ড ইন কমান্ড মেজর জিয়ার বাসায় আদেশ আনতে ছুটে যান। এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক মেজর (অব.) সৈয়দ আবু ব্কর সিদ্দিক আরও বলেন, ‘ওইদিন মেজর জিয়া বাসায় ছিলেন না। তখন বেগম জিয়া পুরো ঘটনাটি জানতে চান। ঘটনা শোনার পর তিনি সাফ সাফ জানিয়ে দেন ‘মেজর জিয়ার হুকুম ছাড়া একটা সুইও ষোলশহর থেকে বাইরে যাবে না।’ নূরুল হক ‘কোডে’ ফিরে কাদেরকে ম্যাডামের নির্দেশের কথা জানালে তিনি (কাদের) সতর্ক হয়ে যান। ততক্ষণে বেলুচের সৈন্যরা ‘৭৬ ও ৭৭ আর আর রাইফেল’ তাদের গাড়িতে তুলে ফেলেছে দেখে হাবিলদার কাদের বেগম খালেদা জিয়ার নির্দেশ পালন করতে গিয়ে বেলুচ সৈন্যদের গাড়িতে গুলি করার উদ্যোগ নেয়। বেগতিক পরিস্থিতিতে বেলুচের সৈন্যরা সব অস্ত্র রেখে যেতে বাধ্য হয়।’ অস্ত্র সরানোর জন্য লে. কর্নেল জানজুয়ার হুকুম ছিল, কমান্ডিং অফিসারের এই হুকুমও সেদিন বেগম খালেদা জিয়ার নির্দেশের কাছে অগ্রাহ্য হয়ে যায় বলে সাবেক এই অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা জানান।

প্রায় আড়াই বছর আগের দেওয়া বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। শনিবার (১৪ ডিসেম্বর) জাতীয় বার্তা সংস্থা বাসস-এর সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেছেন, ‘বাস্তবতা হচ্ছে যেদিন শহীদ জিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন, সেদিন বেগম জিয়া সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে তারেক জিয়া ও কোকোকে নিয়ে অবস্থান করছিলেন। পাক বাহিনী ভেতরে ঢুকে পড়ায় সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যরা বেগম খালেদা জিয়ার কাছে অনুমতি নিতে গিয়েছিল কী করবে- সেটি জানার জন্য। সেদিন তিনি (বেগম খালেদা জিয়া) সেনাবাহিনীর উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘তোমরা অধিনায়কের অনুমতি ছাড়া কেউ আত্মসমর্পণ করবে না। তিনি সেদিন সেনাবাহিনীকে না বলার মধ্য দিয়ে শিশু সন্তানদের নিয়ে চট্রগ্রাম থেকে ঢাকায় এসে পাকবাহিনীর কাছে ধরা পড়েন। ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বন্দী ছিলেন বেগম জিয়া। বন্দিদশায় তিনি (বেগম খালেদা জিয়া) মক্তিযুদ্ধকালীন পুরোটা সময় মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছেন।’

মুক্তিযুদ্ধে কারারুদ্ধ ছিলেন সাড়ে ৫ মাস
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৬ মে দু’শিশু পুত্র তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানকে নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় আসেন বেগম খালেদা জিয়া। প্রথমে প্রয়াত বোন খুরশীদ জাহান হকের বাসায় ওঠেন। এরপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী তাঁর অবস্থান জেনে ফেললে ভূতত্ব জরিপ অধিদপ্তরের ডেপুটি ডিরেক্টর এস কে আবদুল্লাহর সিদ্ধেশ্বরীর বাসায় থাকতে শুরু করেন। ২ জুলাই ভোরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে আটকের আগে পর্যন্ত ওই বাড়িতেই ছিলেন বেগম জিয়া। তিনি সব সময় বাড়ির অন্দরেই থাকতেন। ওই সময় খালেদা জিয়ার গ্রেপ্তারের বর্ণনা দিয়ে প্রয়াত সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ তাঁর রচিত ‘বেগম খালেদা জিয়া: হার লাইফ, হার স্টোরি’ শীর্ষক গ্রন্থে লিখেছেন- ‘১৯৭১ সালের ২ জুলাই বেগম খালেদা জিয়াকে সিদ্ধেশ্বরীর এস কে আবদুল্লার বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করা হলো। তিনি সব সময় ভেতরেই থাকতেন এবং বাইরে বেরুতেন না। যেদিন তাকে আটক করা হয়, সেদিন খুব ভোরে বাড়ির বাগান দেখতে বেরিয়েছিলেন খালেদা জিয়া।’ তিনি আরও লিখেছেন- ‘আটকের পর খালেদা জিয়া ও তার দুই শিশু সন্তানকে পুরাতন সংসদ ভবনের একটি কক্ষে রাখা হয়। এরপর সেখান থেকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে একটি বাড়িতে নেওয়া হয়। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত সেখানেই তাকে আটকে রাখা হয়।’

বেগম জিয়ার গ্রেপ্তার সম্পর্কে আরেকটি বর্ণনা মিলেছে ১৯৯১ সালের আগস্টে প্রকাশিত দেশের বিশিষ্ট সাংবাদিক সৈয়দ আবদাল আহমদ রচিত ‘নন্দিত নেত্রী খালেদা জিয়া’ শীর্ষক বইয়ে। সেখানে খালেদা জিয়ার বড় সন্তান তারেক রহমান পিনোর একটি বক্তব্য রয়েছে। মায়ের গ্রেপ্তার বিষয়ে তারেক রহমানের ভাষ্য,- ‘ইঞ্জিনিয়ার চাচার বাড়িতে আমরা বেশ কিছুদিন ছিলাম। তারা আমাদের বেশ যত্ন করতেন। আম্মু ঘরের ভেতর থেকে খুব বের হতেন না। গ্রেপ্তারের দিন আম্মু ইঞ্জিনিয়ার (আবদুল্লাহ) চাচার বাড়ির বাগানটিতে হাঁটছিলেন- এমন সময় পাক আর্মির জিপ এসে বাড়ি ঘেরাও করলো। এরপর আম্মু, আমরা দু’ভাই, আবদুল্লাহ সাহেব, মজিবুর রহমানের চোখ বাঁধলো। আমরা ভয় পেয়েছিলাম। কিন্ত কাঁদিনি।’

আবদাল আহমেদ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ‘১৬ই ডিসেম্বর দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনীর পরাজয় হয়। খালেদা জিয়া সাড়ে পাঁচ মাস ক্যান্টনমেন্টে বন্দি থাকার পর ১৬ই ডিসেম্বর সকালে মুক্তি পান। সকালে দুই ছেলেকে নিয়ে একটি জিপে করে তাকে তার চাচা শ্বশুরের পুরানা পল্টনের বাসায় নিয়ে আসা হয়।’

১৬ ডিসেম্বর বন্দিদশা থেকে মুক্ত হওয়ার পর জিয়াউর রহমানের সঙ্গে খালেদা জিয়ার সাক্ষাতের বিষয়ে সাংবাদিক মাহফুজউল্লাহ তার বইয়ে লিখেছেন, ‘পাকিস্তানি আর্মি আত্মসমর্পণ করার পর খালেদা জিয়া ও দুই পুত্রকে ঢাকা থেকে বিমানে সিলেটের শমসেরনগরে নেওয়া হয়। জিয়াউর রহমানের অনুরোধে জেনারেল অরোরা সে ব্যবস্থা করেন। শমসেরনগর বিমানবন্দরে মেজর চৌধুরী খালেকুজ্জামান ও ক্যাপ্টেন অলি আহমেদ তাদের রিসিভ করে স্থানীয় একটি রেস্ট হাউজে নিয়ে যান। শমসেরনগরে খুব অল্প সময় থেকে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে চলে যান খালেদা জিয়া ও তাদের দুই সন্তান।’

শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের জীবনসঙ্গী বেগম খালেদা জিয়া মুক্তিযুদ্ধের পরও একাধিকবার কারাবরণ করেছেন। বিগত সরকারের সময়ে ফরমায়েশি রায়ে তাকে সাজা দিয়ে কারারুদ্ধ করা হয়েছিল। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষ মুক্তি পান। তারপর ২০২৪ সালের ৬ আগস্ট রাষ্ট্রপতির আদেশে পুরোপুরি মুক্তিলাভ করেন। নিজের দীর্ঘ বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনেও সততা, মহানুভবতা, উদারতা ও আদর্শের যে দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করেছেন তা যুগে যুগে বাঙালি নারীদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস। গণতন্ত্র ফেরাতে তাঁর অনবদ্য সংগ্রাম ও মহান মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার অনেক অজানা অধ্যায় সম্পর্কে এখন জানার সুযোগ তৈরি হয়েছে। দেশপ্রেমে আপোসহীন বেগম জিয়ার জীবনচর্চার মাধ্যমে নতুন প্রজন্ম দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হবে বলে মনে করছেন অনেকেই।

কালের আলো/আরআই/ওয়াইএ/এমকে