শিশুদের খেলনায় সিসা বিষ
প্রকাশিতঃ 3:03 pm | December 21, 2024
কালের আলো রিপোর্ট:
প্লাস্টিক রিসাইকেল (পুনঃপ্রক্রিয়াজাত) করে তৈরি শিশুদের খেলনা সামগ্রীতে ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। যার মধ্যে একটি ক্ষতিকর রাসায়নিক হলো সিসা। সিসা হলো একজাতীয় বিষাক্ত ধাতু। মানবদেহের জন্য সিসা একটি বিষ। এটি প্রকৃতিতে পাওয়া যায়। সিসা চকচকে, নীলচে-ছাই রঙের; খুবই নরম তাই আগুনে সহজে গলে যায়। দেশে ব্যাটারি পুনঃচক্রায়নও সিসার একটি বড় উৎস।
সিসা দূষণে ক্ষতিগ্রস্ত শিশুর সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে চতুর্থ। দেশে সাড়ে ৩ কোটির বেশি শিশুর রক্তে সিসা রয়েছে বিপজ্জনক মাত্রায়। সম্প্রতি পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় (এমওইএফসিসি) ইউনিসেফের সঙ্গে যৌথভাবে আয়োজিত এক কর্মশালায় এই তথ্য উপস্থাপন করা হয়। শিশুদের রক্তে উদ্বেগজনক মাত্রায় সিসার উপস্থিতি, সিসার উৎস ও দূষণের উপায়গুলো দেখানো হয়। কর্মশালায় সিসা দূষণের বাস্তবতা বুঝতে হলে সারা দেশে এর উপস্থিতি (রক্তে সিসার মাত্রা) সম্পর্কিত উপাত্ত জানা জরুরি বলে করে ইউনিসেফ।
সেই অনুষ্ঠানে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘সিসা ও ভারী ধাতুর দূষণ একটি নীরব ঘাতক, যা মোকাবিলায় প্রয়োজন জরুরি ও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ। সবার জন্য একটি সিসামুক্ত ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে এবং ২০৪০ সালের মধ্যে সিসা দূষণ রোধ করতে অন্তর্বর্তী সরকার সব অংশীজনের সঙ্গে কাজ করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। আমি সব অংশীজনদের এই কর্মশালায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণের আহ্বান জানাই। বাংলাদেশে বিষাক্ত ধাতুর সংস্পর্শে আসার প্রধান উৎসগুলো চিহ্নিত করতে আমরা একত্রে একটি বিস্তৃত ও কার্যকরী কর্ম পরিকল্পনা গড়ে তুলতে পারবো।’
জানা যায়, সিসা দূষণ একটি জরুরি পরিবেশগত স্বাস্থ্য সংকট, বিশেষ করে বাংলাদেশে। দ্রুত নগরায়ন ও শিল্পায়ন পরিবেশে ভারী ধাতুর দূষণ বাড়িয়েছে, যার ফলে শিশুদের বাতাস, পানি, মাটি, খাবার, খেলনা, রঙ ও রান্নার সামগ্রীর মাধ্যমে বিষাক্ত পদার্থের সংস্পর্শে আসার ঝুঁকি বেড়েছে। সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কমিউনিটির নারী ও শিশুদের মধ্যে সিসা দূষণের প্রভাব ব্যাপক; এটি ছোট শিশুদের জন্য বেশি ক্ষতিকর, যা স্থায়ীভাবে তাদের স্নায়বিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধকতার কারণ হচ্ছে।
বাংলাদেশে ইউনিসেফের প্রতিনিধি রানা ফ্লাওয়ারস বলেন, ‘সাধারণত ভারী ধাতু বিশেষ করে সিসা প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় শিশুদের ওপর বেশি গুরুতর প্রভাব ফেলে, এই ক্ষতি চিরস্থায়ী ও অপরিবর্তনীয়। দুর্ভাগ্যবশত, শিশুদের ক্ষেত্রে মস্তিষ্কের বিকাশের সময়সীমা কমে যায় এবং প্রায় সব অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বয়স্কদের ক্ষেত্রে হৃদরোগ (কার্ডিওভাসকুলার) দেখা দেয় আর গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে তাদের অনাগত শিশুরা হয় ক্ষতিগ্রস্ত। তবে সুস্পষ্ট আইন এবং বিশেষ করে বেসরকারি খাতের সঠিক ও কার্যকরী পদক্ষেপ দ্বারা এই দূষণ প্রতিরোধযোগ্য। আর এভাবে, এই দূষণের ফলে ভুক্তভোগী নারী ও শিশুদের যে অতিরিক্ত খরচ ও ভোগান্তি হয়ে থাকে, পাশাপাশি সামগ্রিক স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে যে বাড়তি খরচ হয়ে থাকে, সেটাও অনেকাংশে কমিয়ে ফেলা সম্ভব। ইউনিসেফ অংশীদারদের সঙ্গে একত্রে মিলে অন্তর্বর্তী সরকারকে একটি স্বাস্থ্যকর ও নিরাপদ বাংলাদেশ গড়তে সহায়তা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, যেখানে প্রতিটি শিশু সিসা ও বিষাক্ত ধাতুমুক্ত পরিবেশে বেড়ে উঠতে, খেলতে ও শিখতে পারবে।’
গত বছর (২০২৩) এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো) ও ফিলিপাইনভিত্তিক সংস্থা ‘ব্যান টক্সিকস’ একটি যৌথ গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে। চলতি বছরের অক্টোবরে গবেষণার প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, শিশুর খেলনায় সহনীয় মাত্রা বিষাক্ত উপাদানের ন্যূনতম সীমা হচ্ছে-সিসা ৯০ পিপিএম, পারদ বা ৬০ পিপিএম মার্কারি, ৭৫ পিপিএম ক্যাডমিয়াম, ২৫ পিপিএম আর্সেনিক ও ২৫০ পিপিএম পর্যন্ত ব্রোমিয়াম। পিপিএম একক হলো ‘পার্টস পার মিলিয়ন’ অর্থাৎ অতিলঘু দ্রবণের ঘনমাত্রা প্রকাশের প্রচলিত ও কার্যকরী পদ্ধতি। কিন্তু এসব সামগ্রীতে ৩২০ পিপিএম পরিমাণ সিসা, ১৩৯০ পিপিএম ক্রোমিয়াম, ১২৮০ পিপিএম ব্রোমিয়াম ও ২৪৭ পিপিএম আর্সেনিক পাওয়া গেছে।
বিশেষ করে শিশুর খেলনা পুতুল, বর্ণমালা, খেলনা গাড়ি, ব্যাঙ, মগ, ফিডার, প্যাসিফায়ারসহ (শিশুর চুষনি) নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রীতে ক্ষতিকর উপাদানগুলো মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করছে। রাজধানীর চকবাজার, নিউ মার্কেট, গাউছিয়া মার্কেট, বসুন্ধরা সিটি, অর্কিড প্লাজাসহ বেশ কিছু জায়গা থেকে ১৬০টি খেলনার নমুনা সংগ্রহ শেষে সেগুলো পরীক্ষা করে এ তথ্য জানা গেছে। সংবাদ সম্মেলনে কিছু পণ্য পরীক্ষা করে ক্ষতিকর মাত্রাগুলো দেখানো হয়।
সম্প্রতি বায়তুল মোকারম, গুলিস্তানসহ পুরান ঢাকার খেলনার দোকানির সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। বেশিরভাগ দোকানি খেলনা তৈরির উপাদান সম্পর্কে অবগত নয়। তবে কোনো কোনো দোকানির দাবি তাদের বিক্রি খেলনা ফাইবার দিয়ে তৈরি, খেলনায় সিসার ব্যবহার করা হয় না। চায়না থেকে আমদানি করা খেলনায়ও শুধু ফাইবার বলে দাবি তাদের। বায়তুল মোকারম মার্কেটের সুপার রহমান ট্রেডিং করপোরেশনের মালিক ইমতিয়াজ খান বলেন, আমাদের সব খেলনা চীন থেকে আসে। এসব খেলনায় ফাইবার, কোনো সিসা। খেলনায় সিসা নাই সেটা কীভাবে নিশ্চিত হলেন এমন প্রশ্নে ইতমিয়াজ বলেন, সিসা নাই সেটা আমরা কেমনে বলব?
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) সভাপতি এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘শৈশবে বেড়ে ওঠার জন্য অন্যতম প্রয়োজনীয় উপাদান হচ্ছে খেলার মাঠ। খেলার মাঠে শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য গুরত্বপূর্ণ এবং বন্ধুত্ব ও সামাজিকীকরণে খেলার মাঠের বিকল্প হয় না। একটা সময়ে শহরে খেলার ব্যবস্থা ছিল। কালের আবর্তে খেলার মাঠ কমতে কমতে সেগুলো এখন নাই বললেই চলে। ঢাকায় প্রয়োজনের তুলনায় দশের ভাগের এক ভাগও খেলার মাঠও নাই। এটার বিকল্প হিসেবে বিভিন্ন খেলার উপাদান আসছে, দূষণের কারণ হচ্ছে। আসলে রাষ্ট্রের উপলব্ধির জায়গায় খেলার মাঠটাকে এত গুরত্বপূর্ণ হিসেবে চিন্তা করে না। তার ফলাফলে দেখা যায় আমাদের শিশুরা কেমিক্যালের তৈরি খেলনা গ্রহণ করছে। আর এটা তাদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলছে। আমাদের শিশুরা বিকলাঙ্গ হচ্ছে, তারা মানসিক ও শারীরিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এবং বিভিন্ন দূষণের শিকার হচ্ছে।’
কালের আলো/আরআই/এমকে