বিকশিত শিপিং খাতে ফিরছে বিএসসি’র আধিপত্য, সর্বোচ্চ মুনাফার রেকর্ড গড়ে সরকারকে ফেরত দিয়েছে পৌনে ৫০০ কোটি টাকা

প্রকাশিতঃ 10:10 pm | December 22, 2024

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:

দ্রুত বিকশিত হচ্ছে বাংলাদেশের শিপিং খাত। এ সময়টিতে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসি) বহরের সক্ষমতাও বাড়ানোর কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। দেশের শিপিং শিল্পে নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে দক্ষ নেতৃত্ব ও সঠিক পরিকল্পনায় ঘুরে দাঁড়াচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত এই সংস্থাটি। চেষ্টা চলছে বিএসসি’র জাহাজের বহর আরও বড় করার। শুধু তাই নয় গত ৫৩ বছরে সর্বোচ্চ মুনাফা আয়ের একটি বিরল রেকর্ডও গড়েছে তাঁরা। গত জুনে শেষ হওয়া অর্থবছরে প্রায় ২৫০ কোটি টাকা মুনাফা করে তাক লাগিয়ে দিয়েছে সবাইকে।

একই সঙ্গে শেয়ার হোল্ডারদের বদৌলতে সরকারকে পৌঁনে ৫০০ কোটি টাকা ঋণ ফেরত দিয়ে নিজেদের সক্ষমতারও পরিচয় দিয়েছে বিএসসি। অতীতে বাংলাদেশের সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের এমন নজির নেই। স্বভাবতই এই ধরনের ঘটনাকে একটি দৃষ্টান্ত হিসেবেই মনে করছেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন পরিচালনা পর্ষদ চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন। রবিবার (২২ ডিসেম্বর) বিকেলে বন্দর নগরী চট্টগ্রামের পতেঙ্গা বোট ক্লাবে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসি) ৪৭তম বার্ষিক সাধারণ সভায় সভাপতির বক্তব্যে ইতিবাচক এমন সব বার্তাই দিয়েছেন তিনি।

সুখবর জানিয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বলেন, ‘বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের (বিএসসি) জাহাজের বহর আরও বড় করার চেষ্টা চলছে। আশা করছি, আগামী দুই বছরে বিএসসির বহরে আরও আটটি জাহাজ যুক্ত হবে। তখন শেয়ার হোল্ডাররা আরও বেশি লভ্যাংশ পাবেন বলে আশা করছি।’

নিট মুনাফা থেকে ২৫ শতাংশ হারে নগদ লভ্যাংশ দেওয়ার ঘোষণা
বিএসসির ৪৭তম বার্ষিক সাধারণ সভায় সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) কমডোর মাহমুদুল মালেক নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) এম সাখাওয়াত হোসেন ও সচিব মোহাম্মদ ইউসুফের উপস্থিতিতে বদলে যাওয়া বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের নানাদিক তথ্য-উপাত্তের মিশেলে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘বিএসসি একটি রাষ্ট্রীয় সংস্থা। এই সংস্থাকে অনন্য পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাই আমরা।’

তিনি জানান, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে তাদের পরিচলন আয় ছিল ৪৮৭ কোটি ৭৪ লাখ টাকা, অন্যান্য খাত থেকে আয় ১০৮ কোটি ৪৪ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে এ অর্থবছরে তাদের মোট আয় ৫৯৬ কোটি ১৯ লাখ টাকা। একই অর্থবছরে ১৮৯ কোটি ৬১ লাখ টাকা পরিচলন ব্যয় এবং প্রশাসনিক ও আর্থিক খাতে ১২১ কোটি ৯৮ লাখ টাকা ব্যয়সহ বিএসসির মোট ব্যয় ৩১১ কোটি ৬০ লাখ টাকা। সে হিসাবে কর সমন্বয়ের পর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিএসসির নিট মুনাফা ২৪৯ কোটি ৬৯ লাখ টাকা।

বিএসসির এই আর্থিক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আগের অর্থবছরের চেয়ে তিন কোটি ৪০ লাখ টাকা বেশি মুনাফা করেছে সংস্থাটি। আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরে সংস্থাটির মোট আয় হয়েছিল ৬৬৭ কোটি ২৩ লাখ টাকা, খরচ ছিল ৩৭৫ কোটি ৬৪ লাখ টাকা। কর সমন্বয়ের পর নিট মুনাফা হয়েছিল ২৪৬ কোটি ২৯ লাখ টাকা। এ অবস্থায় বিএসসি অংশীদারদের ২০২৩-২৪ অর্থবছরের নিট মুনাফা থেকে ২৫ শতাংশ হারে নগদ লভ্যাংশ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, চলতি বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত সংস্থাটির পরিশোধিত মূলধন ছিল ১৫২ কোটি ৫৩ লাখ ৫০ হাজার ৪০০ টাকা। এর মধ্যে সরকারের শেয়ারের পরিমাণ ৭৯ কোটি ৪৬ লাখ ৩৪ হাজার ৪০০ টাকা। বেসরকারি শেয়ারের পরিমাণ ৭৩ কোটি ৭ লাখ ১৬ হাজার টাকা। সরকারের শেয়ারের সংখ্যা সাত কোটি ৯৪ লাখ ৬৩ হাজার ৪৪০টি, যা মোট শেয়ারের ৫২ দশমিক ১০ শতাংশ। আর বেসরকারি শেয়ারের সংখ্যা সাত কোটি ৩০ লাখ ৭১ হাজার ৬০০টি, যা মোট শেয়ার সংখ্যার ৪৭ দশমিক ৯০ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে নিরীক্ষা হিসেব অনুযায়ী, বিএসসির মোট সম্পদের পরিমাণ তিন হাজার ৮১১ কোটি ৫৩ লাখ টাকা। দেনার পরিমাণ দুই হাজার ২৫৬ কোটি ১৬ লাখ টাকা।

বিএসসি উদাহরণ সৃষ্টিকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান
নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, আমরা মনে করি বিএসসি উদাহরণ সৃষ্টিকারী সরকারি প্রতিষ্ঠান। আগামী এক বছরের মধ্যে বিএসসির নিজস্ব অর্থায়নে দুইটি জাহাজ কেনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। চীনের সঙ্গে চারটি জাহাজ নির্মাণের চুক্তি জানুয়ারিতে হবে। তিন বছরের মধ্যে এই চারটি জাহাজ বহরে যুক্ত হবে।

বিএসসির বহরকে বড় করার সুসংবাদ উপদেষ্টার কণ্ঠে
দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশনের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৭৪ সালে বিএসসির বহরে ১৪টি জাহাজ যুক্ত হয়। এখন জাহাজের সংখ্যা ছয়টি। এ প্রসঙ্গে সুসংবাদ দিয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘আপনারা জানেন ইতোমধ্যে বিএসসির বহরকে বড় করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। সেজন্য চাইনিজ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা হয়েছে।

সরকার অনুমোদন দিলে আমরা চুক্তি সই করে ফেলব এবং দুই বছরের মধ্যে জাহাজগুলো পাওয়া যাবে। এছাড়া শিপিং কর্পোরেশন নিজের অর্থায়নে দুইটি বাল্ক ক্যারিয়ার কিনবে। আমরা বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ নিচ্ছি যেখানে আমরা এক থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে ব্যবহার হয়েছে এমন জাহাজ কিনবো। এর মধ্যে বিএসসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক জাপানে দুইটি জাহাজের সন্ধান পেয়েছেন। আমি বা আমাদের প্রতিনিধি কেউ গিয়ে সব ঠিক পেলে আমরা অন দ্যা স্পট জাহাজ কিনে ফেলব। আশাকরি জাপানি শিপ অবশ্যই ভালো হবে।’

‘দুর্দিনে’ ২৫ শতাংশ লভ্যাংশ দেওয়ার ঘোষণায় বিএসসির পরিচালনা পর্ষদের প্রশংসা করে নৌপরিবহন উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘এখন শেয়ারের বাজারে দুর্দিন চলছে। কোনো কোম্পানি এত খানি লভ্যাংশ দিতে পারছে না। সেখানে বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন এই দুর্দিনে ছয়টি জাহাজ নিয়ে আপনাদের ২৫ শতাংশ প্রফিট শেয়ার দিয়েছে। আমি আশা করি, আগামী বছর আমি থাকি বা না থাকি, আপনাদের প্রফিট শেয়ার আরও বাড়বে।’

‘বাংলাদেশে কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান প্রায় পৌনে ৫০০ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে সরকারকে আবার ফেরত দিয়েছে, এটি অনেক বড় ঘটনা। বিএসসি এটি সম্ভব করেছে। এটি হয়েছে কেবল বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের ওপর শেয়ারহোল্ডারদের আস্থা-বিশ্বাস ও কর্মকর্তাদের নিরলস প্রচেষ্টার কারণে’-যোগ করেন তিনি। নৌপরিবহন উপদেষ্টা আরও বলেন, ‘কোনো প্রতিষ্ঠান এখন লভ্যাংশ দিতে পারছে না বিগত সময়ের চুরিচামারির কারণে। কিন্তু বিএসসি সে জায়গায় সম্মানজনক লভ্যাংশ তার শেয়ারহোল্ডারদের দিতে পেরেছে। বর্তমানে পাঁচটি জাহাজ নিয়ে শেয়ারহোল্ডারদের লাভ দিয়েছে। যদিও ছয়টি জাহাজের মধ্যে একটি ইউক্রেনে ক্ষতি হয়েছে। আগামীতে এই লভ্যাংশ আরও বৃদ্ধি পাবে।’

কোনও অসৎ ব্যক্তি আমাদের কেবিনেটে নেই
প্রধান উপদেষ্টা ড.মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সততা ও জবাবদিহিতার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন নৌপরিবহন, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি গর্বের সঙ্গে বলেন, ‘এই সরকার অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করছে। গত তিন মাসে আপনারা শোনেননি এই সরকারের কেউ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছে। কোনও অসৎ ব্যক্তি আমাদের কেবিনেটে নেই।’

‘বিএসসিতে আগের মতো চুরিচামারি ও হেরফের হবে না’ জানিয়ে তিনি কঠোর বার্তায় বলেন, ‘কোনও চোর ধরা পড়লে তার আর রক্ষা নেই। আমার হাতে যদি কেউ ধরা পড়ে, ১০০ টাকাও যদি ঘুষ খায় তাহলে আমি চেষ্টা করবো চাকরি যেন না থাকে। আমি কথা দিয়ে যাচ্ছি, চোর ধরা পড়লে রক্ষা নাই। আমি যতদিন আছি আপনারা বিশ্বাস রাখতে পারেন।’

চট্টগ্রাম বন্দরের সমস্যা দূর করতে উদ্যোগ
বেসরকারি উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্যে ড.এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘শিপিং লাইনে আসতে চাইলে সহযোগিতা পাবেন। চট্টগ্রাম বন্দর অত্যন্ত মুনাফার জায়গায় আছে। তিন মাসের মধ্যে বন্দরে দুইবার এসেছি। বন্দরের সমস্যা দূর করার চেষ্টা করছি। চট্টগ্রামে ফরেন ডাইরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট ব্যবস্থা করছি। মধ্যপ্রাচ্যসহ বেশ কয়েকটি দেশ বন্দর ও বে টার্মিনালে বিনিয়োগ করতে বসে আছে। এটি হলে চট্টগ্রাম অঞ্চলের শ্রমিকদের অধিকতর চাকরির সুযোগ তৈরি হবে। চট্টগ্রাম বন্দর চট্টগ্রামবাসীর কাছে গর্বের বিষয় হবে। আমরা চেষ্টা করবো বিএসসির মাধ্যমে আমাদের পুরুষ ও নারী ক্যাডেট ও নাবিকদের চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করতে চাই। এর জন্য জাহাজ দরকার। আমি আশাকরি আগামী এজিএমে সুখবর পাবেন। একজনতো এখানে বলেছেন, ‘অনেকে রাতে এজিএম করে, শেয়ার হোল্ডাররা জানে না।’ কিন্তু আমরা দিনের বেলায় আপনাদের ডেকে এজিএম করছি। তাও একটি সরকারি সংস্থার এজিএম।’

কালের আলো/এমএএএমকে