শুধু পদত্যাগ নয়, শিক্ষামন্ত্রীকে আইনের মুখোমুখি করা দরকার

প্রকাশিতঃ 2:12 pm | February 15, 2018

গোলাম মোর্তোজা:

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ও যে অতি সাধারণ বিষয়ে পরিণত হয়ে যায়, বাংলাদেশ তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। ‘প্রশ্নপত্র ফাঁস’ তেমন একটি সাধারণ বিষয়। সবাই জানেন যে, আজ বা কাল পরীক্ষা এবং সেই পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হবে। সবাই এও জানেন যে, শিক্ষামন্ত্রী বলবেন ‘না প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি, গুজব ছড়ানো হচ্ছে’। এক্ষেত্রে মানুষের জীবনের সব বিস্ময় কেটে গেছে। ৫ হাজার ৫০৪ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতিও মানুষকে বিস্মিত করতে পারে না। বেসিক, সোনালি, শেয়ার বাজার, রিজার্ভ চুরির পর, মানুষ ধরেই নিয়েছে এমন হতেই পারে। তবে আর্থিক দুর্নীতির খতিয়ান নয়, আজ আবার কথা বলব প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়ে।

১.
শিক্ষার অভিভাবক শিক্ষামন্ত্রী। প্রশ্নফাঁস বিষয়টিকে কেন্দ্র করে দাবি উঠেছে, শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগের। ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের মতো স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ বলেছেন, ‘শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ সমাধান নয়’। জাফর ইকবাল ও তার বক্তব্যের বিশ্লেষণ পরে আসব। তার আগে জাফর ইকবালের সঙ্গে আংশিক একমত পোষণ করে বলছি ‘শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ নয়’, তাকে আইনের মুখোমুখি করা দরকার। কেন শিক্ষামন্ত্রীর ক্ষেত্রে এমন বলছি,তার সংক্ষিপ্ত কিছু কারণ।

ক. ২০১৪ সালের এইচএসসি পরীক্ষার প্রশ্নফাঁস হচ্ছিল। ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল ও অধ্যাপক ইয়াসমিন হক শহীদ মিনারে বসে থেকে প্রথম দৃশ্যমান প্রতিবাদ করেছিলেন। যদিও প্রশ্নপত্র ফাঁস শুরু হয়েছিল তারও আগে থেকে।

শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, ‘প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি’। ড. জাফর ইকবাল ‘ফাঁস হয়েছে’ প্রমাণ দিয়ে লেখেন। শিক্ষামন্ত্রী তার পরও অস্বীকার করেন।

খ. ২০১৭ সালের এসএসসির গণিত পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস হয় মাঝরাতে। শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘তদন্ত কমিটি করব। তদন্তে যদি প্রমাণ হয় প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে, তাহলে পরীক্ষা বাতিল করা হবে।’

পরীক্ষা বাতিল তো দূরের কথা, শিক্ষামন্ত্রী তার প্রতিশ্রুত তদন্ত কমিটিও গঠন করেননি।

গ. ২০১৮ সালের এসএসসি পরীক্ষা। আজকে পর্যন্ত ৮টি পরীক্ষা হয়েছে, প্রতিটি পরীক্ষারই প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়েছে। এবারের এসএসসি পরীক্ষার প্রথমদিন বাংলা প্রথমপত্রের প্রশ্নপত্র ফাঁস হলো। পরীক্ষার আগে শিক্ষামন্ত্রী অনেক কথার সঙ্গে এও বলেছিলেন ‘প্রশ্নপত্র ফাঁস হলে পরীক্ষা বাতিল করা হবে’।

সাংবাদিকরা শিক্ষামন্ত্রীকে ফাঁস হওয়া প্রশ্নপত্র দেখালেন। যে প্রশ্নপত্রের সঙ্গে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়া প্রশ্নের হুবহু মিল ছিল। শিক্ষামন্ত্রী বললেন, ‘প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়নি। আমি মিলিয়ে দেখেছি, ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সঙ্গে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়া প্রশ্নের মিল নেই’।

২. উপরে ৩টি সুনির্দিষ্ট ঘটনা উল্লেখ করলাম। যদিও এমন কয়েকশ’ ঘটনার সুনির্দিষ্ট উদাহরণ দেয়া যাবে। ঘটনা ৩টির বিশ্লেষণ-

প্রথমত : শিক্ষামন্ত্রী প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে ব্যর্থ হয়েছেন।

দ্বিতীয়ত : শিক্ষামন্ত্রী অসত্য বলেছেন। যে ঘটনা সত্য, যার দৃশ্যমান তথ্য প্রমাণ আছে, সেই ঘটনা তিনি ‘গুজব’ বলে উড়িয়ে বা চাপা দিয়েছেন। একবার বা দুইবার নয়,শতবার।

তৃতীয়ত : প্রশ্নপত্র ফাঁসের সত্য ঘটনা শিক্ষামন্ত্রী যদি অস্বীকার করে চাপা না দিতেন, তাহলে তা এতটা মহামারি আকার ধারণ করত না।

৩.
প্রশ্নপত্র ফাঁস ঠেকাতে না পারার জন্যে শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ করা উচিত। সত্য চাপা দেয়া বা অসত্য বলা অপরাধ। সে কারণে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী শিক্ষামন্ত্রীর বিষয়টি দেখা দরকার। সুতরাং এখানকার দাবি শুধু শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ নয়, তাকে আইনের মুখোমুখি করাটাও হওয়া দরকার প্রধান দাবি। কারণ নিজের ব্যর্থতা এবং সেই ব্যর্থতা আড়াল করার জন্যে তিনি একটি দেশের শিক্ষা এবং শিক্ষা ব্যবস্থা পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়ার নেতৃত্ব দিয়েছেন, দিচ্ছেন।

৪.
এবার আসি ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবালের বক্তব্য প্রসঙ্গে। তিনি খুব জনপ্রিয় শিক্ষক। আকর্ষণীয় পদ্ধতিতে পাঠদান করান। সহজ-সরল ভাষায় কথা বলেন, লেখেন। খুব সাধারণভাবেই বলেন, ‘আমি রাজনীতি বুঝি না’। আমি তার লেখার পাঠক। ধারণা করতাম তিনি বিনয় থেকে ‘রাজনীতি না বোঝার’ কথা বলেন। কিন্তু এখন এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি, মুহাম্মদ জাফর ইকবাল আসলেই রাজনীতি বোঝেন না।

তিনি অধিকাংশ ক্ষেত্রে শিশুসুলভ সরলতা নিয়ে ‘রাজনীতি-শিক্ষা’ বিষয়টিকে দেখার চেষ্টা করেন। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে তার দৃঢ় অবস্থান শিশুসুলভ সরলতা দিয়ে বিশ্লেষণ করতে করতে তা, দলীয় অবস্থানের দিকে ধাবিত হয়েছে। তিনি এখন সেই দলীয় অবস্থানে দাঁড়িয়ে লিখছেন, কথা বলছেন। অন্য আরও অনেকের মতো মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বলতে ‘আওয়ামী লীগের পক্ষে’ তা না হলে ‘বিএনপি-জামায়াত’ চলে আসবে। বিএনপি-জামায়াতের চেয়ে আওয়ামী লীগ ভালো।

এমন অবস্থান নিতে গিয়ে ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল স্ববিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। তার আগের অবস্থান বা লেখার সঙ্গে, এখনকার অবস্থান বা লেখার সাংঘর্ষিক বিষয়টি দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। দলীয় অবস্থানের পক্ষে ঝুঁকে পড়ায়, রাজনৈতিক নেতাদের মতো, দায়বদ্ধ সম্মানিত অন্য শিক্ষকদের তুচ্ছ তাচ্ছিল্য বা কটাক্ষ করছেন নিজের লেখায়। তার স্ববিরোধী এবং কটাক্ষ করার দুটি নমুনা।

ক. শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাকে ভিসি হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিল, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন যে- শিক্ষকরা অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল ও অধ্যাপক ইয়াসমিন হক ছিলেন তাদের অন্যতম। দাবি ছিল ভিসিকে সরিয়ে দিতে হবে। ভিসিকে অপসারণ করলেই তো শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যেত না। তারপরও আপনি তার অপসারণ চাইছিলেন, কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্বে একজন অযোগ্য অনৈতিক মানুষ থাকতে পারেন না, থাকা উচিত নয়। এই যুক্তিতে তো আমরাও আপনাদের প্রতিবাদ সমর্থন করেছিলাম।

আজ যখন শিক্ষামন্ত্রীর অযোগ্যতা, ব্যর্থতা এবং অসত্য বলার দায়ে অপসারণ চাওয়া হচ্ছে তখন আপনি বলছেন, ‘শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ সমাধান নয়’। হ্যাঁ, যারা পদত্যাগ চাইছেন তারাও জানেন শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ সমাধান নয়। কারণ এটা একটা সরকারের সামগ্রিক ব্যর্থতা।

সেই সামগ্রিক ব্যর্থতার নেতৃত্বদানকারী ব্যক্তি শিক্ষামন্ত্রী। তার পদে থাকার কোনো নৈতিক অধিকার নেই, বিষয়টি শুধু সমস্যা সমাধানের নয়। আপনি যে কারণে ভিসির অপসারণ চেয়েছিলেন, আমরা তার চেয়ে আরও বহু গুণ বড় কারণে শিক্ষামন্ত্রীর প্রথমে অপসারণ, ও পরে আইনের মুখোমুখি করার দাবি করছি। ভিসির পদত্যাগ চাওয়ার সময়ের চেয়ে এখন আপনার দলীয় আনুগত্য বৃদ্ধি পাওয়ায়, মিনমিন করছেন ‘শিক্ষামন্ত্রীর পদত্যাগ সমাধান নয়’।

খ. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল আপনার দলীয় আনুগত্য বৃদ্ধির আরেকটি প্রমাণ দেই। দলীয় আনুগত্য আপনার থাকতেই পারে, তাতে কোনো আপত্তি নেই। আপত্তি স্ববিরোধী বা সাংঘর্ষিক অবস্থান নিয়ে।

কয়েক বছর আগে আপনি রূপপুর নিউ ক্লিলিয়ার শক্তি কেন্দ্রের ভয়াবহ ঝুঁকির বিষয়টি নিয়ে সহজ-সরল ভাষায় অসাধারণ একটি লেখা লিখলেন। যারা এই শক্তি কেন্দ্রের বিরোধিতা করছিলেন, তাদের পক্ষে আপনার দৃঢ় অবস্থান পরিষ্কার হলো। কয়েক বছর পরে ২০১৭ সালে এসে আপনি শতভাগ উল্টো অবস্থান নিলেন। যে আপনি ঝুঁকির সবচেয়ে ভয়াবহ দিকটি তুলে ধরেছিলেন, সেই আপনি লিখলেন ‘আমার কোনো ভয় নেই’। কেন আগে ভয়ের কথা লিখেছিলেন, এই প্রশ্নের উত্তর দেয়ার সৎ সাহসের প্রমাণ দিতে পারলেন না।

দলীয় আনুগত্যের প্রকাশ ঘটাতে গিয়ে অথবা ‘ রাজনীতি না বোঝার’ কারণে শতভাগ সৎ এবং দায়বদ্ধ মানুষ প্রকৌশলী শেখ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদদের কটাক্ষ করে লিখলেন ‘খাঁটি বুদ্ধিজীবী’। অথচ এই মানুষগুলোর প্রতিবাদ -প্রতিরোধের কারণে কোনো সরকার জনগণের প্রাকৃতিক সম্পদ পাচার করতে পারেনি। আপনার মতো শিক্ষক-শিক্ষাবিদ যখন ‘খাঁটি বুদ্ধিজীবী’ বলে কটাক্ষ করেন, তখন বোঝা যায় কতটা ভয়াবহ মাত্রায় আপনি আজ দলীয় আনুগত্যের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। আত্মসমর্পণ ছাড়াও বিএনপি-জামায়াতের বিরোধিতা করা যায়, আওয়ামী লীগকে সমর্থন করা যায়, তা বিবেচনায় নেননি।

৫.
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় প্রশ্নপত্র ফাঁস একটি বড় বিপর্যয়। নিদের্শনা দিয়ে পাস করানো আরেকটি বিপর্যয়। এই দুটি বিপর্যয় ঘটানোর সঙ্গে মুহাম্মদ জাফর ইকবাল আপনি সরাসরি সম্পৃক্ত নন।

‘সৃজনশীল পদ্ধতি’ প্রবর্তন বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার আরেকটি ভয়ঙ্কর বিপর্যয়। বিশ্বাস করি, আপনি সৎ উদ্দেশেই ‘সৃজনশীল পদ্ধতি’ প্রবর্তনের পক্ষে ভূমিকা রেখেছিলেন। কিন্তু ভুল করেছিলেন, কোনো গবেষণা ছাড়া ‘সৃজনশীল পদ্ধতি’ বাস্তবায়ন শুরু করে। এদেশের শিক্ষা-শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবক কেউ ‘সৃজনশীল পদ্ধতি’ গ্রহণ করার মতো সক্ষম ছিলেন না। আগে শিক্ষক তৈরির উদ্যোগ না নিয়ে, সৃজনশীল পদ্ধতিতে শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনা শুরু করেছিলেন। শিক্ষকই যেখানে সৃজনশীল পদ্ধতি সম্পর্কে জানেন না, সেখানে বিপর্যয় অনিবার্য ছিল। ফলে আজকের শিক্ষা ব্যবস্থার বিপর্যয়ের একটি কারণ আপনি নিজেও।

৬.
শিক্ষা ব্যবস্থার বিপর্যয়কে তড়িৎ গতিতে এগিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা চলছেই। কেউ বলছেন ‘এমসিকিউ’ তুলে দেবেন। কেউ বলছেন ‘বই খুলে পরীক্ষার ব্যবস্থা’ করবেন। কোনো গবেষণা নেই, চিন্তা নেই। একটাকে চাপা দেয়ার জন্যে, আরেকটা সামনে আনছেন।

শিক্ষামন্ত্রী একটি কমিটি করেছেন, তারা খুঁজে দেখবেন ‘প্রশ্নপত্র ফাঁস’ হয় কি না, ফাঁস হলে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি হয় কি না, হাসি বা রসিকতার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। পুলিশ শিক্ষার্থীদের প্রশ্নসহ ধরছে, প্রশাসন বহিষ্কার করছে। প্রকৃত ফাঁসকারীদের কাছকাছিও কেউ যাচ্ছেন না, যাওয়ার চেষ্টা করছে না।

এই জাতি কীভাবে রক্ষা পাবে?

 

গোলাম মোর্তোজা: সম্পাদক, সাপ্তাহিক।