ছেলের মৃত্যুশোকে চলে গেলেন বাবাও

প্রকাশিতঃ 3:57 pm | December 27, 2024

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:

চাঁদপুরে জাহাজে সাত খুনের ঘটনায় নিহত সজীবুল ইসলামের বাবা দাউদ মোল্যা মারা গেছেন। ছেলেকে হারানোর শোক সইতে না পেরেই তিনি না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন বলে জানিয়েছেন স্বজনরা। ছেলে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার পর বাবাও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ায় এলাকায় শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

জাহাজে নিহত সজীবুলের বাড়ি মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার পলাশবাড়িয়া ইউনিয়নে। এমভি আল-বাখেরা জাহাজে গ্রিজার ছিলেন তিনি। তার বাবা দাউদ মোল্যা এলাকায় কৃষিকাজ করতেন

মহম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আব্দুর রহমান জানান, বৃহস্পতিবার (২৬ ডিসেম্বর) রাত পৌনে ১২টার দিকে নিজ বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন দাউদ মোল্যা।

সজিবুলের মামা আহাদ সর্দার বলেন, ‘মঙ্গলবার ছেলে সজিবুলের মৃত্যুর খবর শোনার পর থেকে দাউদ মোল্লা কেঁদেই চলছিলেন। স্বজনদের কোনো সান্ত্বনাই তাকে ভোলাতে পারেনি পুত্রশোক। কাঁদতে কাঁদতে একপর্যায়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর বাড়িতেই তার মৃত্যু হয়।’

আহাদ সর্দার বলেন, ‘পাঁচ বছর ধরে জাহাজের বিভিন্ন পদে চাকরি করেছিলেন সজিবুল ইসলাম। সম্প্রতি জাহাজের চাকরিতে পদোন্নতি পেতে পরীক্ষাও দিয়েছিলেন তিনি। সেই ফলাফলের অপেক্ষায় ছিলেন। মাঝের এই সময়টায় অলস বসে না থেকে সপ্তাহ দুয়েক আগে এমভি আল-বাখেরা জাহাজে গ্রিজার পদে আবারও চাকরি নেন তিনি। পদোন্নতি হলে বেতন বাড়বে, বড় জাহাজে চাকরি হবে—এ কারণে পরীক্ষা দিয়েছিলেন। দুই সপ্তাহ আগে বাড়িতে ধান কাটার কাজ করে গেছেন। যাওয়ার সময় বাড়িতে বলে গেছেন রেজাল্টের অপেক্ষায় ঘরে বসে না থেকে জাহাজে ছোট কোনো পদে কাজ করে আসি, তাতে কিছু রোজগার হবে। কিন্তু সব শেষ হয়ে গেল।’

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মহম্মদপুর ও নড়াইল সীমান্তবর্তী কয়েকটি ইউনিয়নের বহু মানুষ জাহাজে চাকরি করেন। মেঘনায় জাহাজে নিহতদের আরেকজনও একই ইউনিয়নের বাসিন্দা। ১৭ বছরের সেই কিশোরের নাম মো. মাজিদুল ইসলাম। তিনি চর যশোবন্তপুর গ্রামের আনিচুর রহমানের ছেলে। ঝামা বরকাতুল উলুম ফাজিল ডিগ্রি মাদ্রাসার নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী মাজিদুল। মাদরাসা বন্ধ থাকায় জাহাজে কাজ নিয়েছিল সে।

এর আগে সোমবার বিকালে চাঁদপুরের হাইমচর উপজেলার নীলকমল ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী এলাকায় মেঘনা নদীতে এমভি ‘আল বাখেরাহ’ জাহাজ থেকে পাঁচটি লাশ উদ্ধার করা হয়। এ সময় গুরুতর আহত আরও তিনজনকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক দুজনকে মৃত ঘোষণা করেন।

এ নিহতরা হলেন, জাহাজের মাস্টার ফরিদপুর জোয়াইর উপজেলার মো. গোলাম কিবরিয়া (৬৫), তার ভাগনে জাহাজের লস্কর শেখ সবুজ (৩৫), জাহাজের সুকানি নড়াইলের লোহাগড়ার আমিনুল মুন্সী (৪০), জাহাজের লস্কর মাগুরার মোহাম্মদপুরের মাজেদুল ইসলাম (১৭), একই এলাকার লস্কর সজিবুল ইসলাম (২৬), নড়াইল লোহাগড়া এলাকার জাহাজের ইঞ্জিন চালক মো. সালাউদ্দিন মোল্লা (৪০) এবং মুন্সিগঞ্জ শ্রীনগর থানার জাহাজের বাবুর্চি রানা (২০)।

একইদিন চাঁদপুর সদর হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে নিহত সাতজনের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে জেলা প্রশাসন।

এ ঘটনায় ১০ জন অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তিকে আসামি করে মামলা হয়েছে। জাহাজের মালিকের পক্ষে মাহাবুব মুর্শেদ বাদী হয়ে মঙ্গলবার রাতে হাইমচর থানায় মামলাটি করেন বলে চাঁদপুর নৌ-পুলিশ সুপার সৈয়দ মুশফিকুর রহমান জানান।

এছাড়া আহত সুকানি জুয়েল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নাক, কান ও গলা বিভাগে চিকিৎসাধীন।

নিহত প্রত্যেক পরিবারকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২০ হাজার টাকা ও নৌ-পুলিশের পক্ষ থেকে ১০ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়েছে। ঘটনা তদন্তে শিল্প মন্ত্রণালয়, জেলা প্রশাসন ও জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে গঠন করা হয়েছে পৃথক তিনটি তদন্ত কমিটি। এ ঘটনায় মঙ্গলবার আকাশ মন্ডল ওরফে ইরফান নামের জাহাজটির এক কর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব।

র‌্যাবের ভাষ্যমতে, বেতন-ভাতা আর বোনাসের টাকা নিয়ে ক্ষোভ থেকেই জাহাজের মাস্টার গোলাম কিবরিয়াকে কুপিয়ে হত্যা করেন ইরফান। পরে ঘটনা জানাজানি হওয়ার ভয়ে ইরফান জাহাজের বাকি সাত কর্মীকেও কোপান, যাদের মধ্যে ছয়জনই মারা গেছেন।

পরে বুধবার গ্রেপ্তার হওয়া ইরফানের সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করে আদালত।

এর আগে ২০২২ সালের অক্টোবরে চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে এমভি সুলতান সানজানা নামের লাইটার জাহাজডুবির ঘটনায় মহম্মদপুর পলাশবাড়িয়া ইউনিয়নের চারজন নিহতের ঘটনা ঘটেছিল।

কালের আলো/ডিএইচ/কেএ