সাংবাদিক পল্লীর জমিতে বস্তি, পালালেও কর্তৃত্ব ইলিয়াস মোল্লাহর হাতে!
প্রকাশিতঃ 7:20 pm | December 29, 2024
জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, কালের আলো:
বিএনপির শাসনামলে ২০০৬ সালে মিরপুরের পল্লবীতে সাংবাদিকদের আবাসনের জন্য জমি দেওয়া হলেও তা দখলে নেই সাংবাদিকদের। প্রায় ৩০০ সাংবাদিক পরিবারের জন্য আবাসন গড়ে তুলতে ঢাকা সাংবাদিক সমবায় সমিতিকে পল্লবীর ঝিলপাড় মসজিদের পাশে জাতীয় গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষ সাত একর জমি দিয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ সালে ঢাকা-১৬ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ইলিয়াস উদ্দীন মোল্লাহ সেই জমি দখলে নিয়ে গড়ে তোলেন বস্তি ও গরুর খামার। এসব স্থাপনা ঘিরে সেখানে মাদক ও অস্ত্রের রমরমা ব্যবসা শুরু হয়। টানা চার মেয়াদে ইলিয়াস মোল্লাহ এমপি থাকাকালে সেই জমির দিকে আর কেউ চোখে তুলে তাকানোর সাহস করেননি।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আত্মগোপনে চলে গেছেন ইলিয়াস মোল্লাহ ও তার ঘনিষ্ঠজনরা। কিন্তু এখনো বহাল তবিয়তে আছে তার অবৈধ দখল। পালিয়ে থাকলেও ইলিয়াস মোল্লাহর লোকজন নিয়মিত ভাড়া তুলছেন বস্তি থেকে।
এদিকে নিজেদের জন্য বরাদ্দ হওয়া জমির দখল বুঝে পেতে ঢাকা সাংবাদিক সমবায় সমিতির নেতারা গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের দ্বারস্থ হয়েছেন বলে জানা গেছে। দ্রুত এখানকার অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে জমির দখল বুঝে পেতে চান সাংবাদিকরা।
ঢাকা সাংবাদিক সমবায় সমিতির সভাপতি সদরুল হাসান বলেন, ‘সাংবাদিকদের জন্য সরকারের বরাদ্দ দেওয়া জমি দখলমুক্ত করতে বহুবার গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের দ্বারস্থ হয়েছি। একপর্যায়ে জমির কিছু অংশ আমাদের বুঝিয়ে দেওয়া হলে সেখানে অস্থায়ী স্থাপনা তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু কিছুদিন পরই ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ লোক পাঠিয়ে তা ভেঙে দেন।’
এই সাংবাদিক নেতা বলেন, ‘গত ২৮ আগস্ট গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার কাছে এ বিষয়ে আবেদন করেছি। গৃহায়ণ কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানের সঙ্গে দেখা করলে পুলিশ সংকটের কারণে উচ্ছেদ কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছেন না বলে জানিয়েছেন।’
এদিকে স্বৈরাচার সরকারের পতনের এতদিন পরও নিজেদের জমি বুঝে না পাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করছেন সাংবাদিকরা। তারা এ ব্যাপারে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
যেভাবে সাংবাদিক পল্লী দখল করেন ইলিয়াস মোল্লাহ
২০০৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নির্দেশে প্রায় ৩০০ সাংবাদিক পরিবারের জন্য আবাসন গড়ে তুলতে ঢাকা সাংবাদিক সমবায় সমিতিকে পল্লবীর ঝিলপাড় মসজিদের পাশে এই জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়। ২০০৯ সালে দল ক্ষমতায় আসার পর মিরপুর এলাকার সংসদ সদস্য ইলিয়াস মোল্লাহ জমির একাংশে বস্তি বানিয়ে ভাড়া দেন। অন্য অংশে গড়ে তোলেন গরুর খামার। বস্তি, দোকান ও অস্থায়ী মার্কেট করার পর সেখানে অবৈধভাবে বিদ্যুৎ, গ্যাস ও ওয়াসার পানি সংযোগেরও ব্যবস্থা করেন ইলিয়াস।
জানা গেছে, সাংবাদিকদের জন্য বরাদ্দকৃত জায়গার কিছু অংশে ইলিয়াস মোল্লা নিজেই অবৈধভাবে গরুর খামার স্থাপন করেন। পরবর্তী সময়ে তার বোনের ছেলে সালমান মোল্লা সেখানে বস্তি ও দোকান ঘর স্থাপন করে ভোগদখল করে আসছেন।
তথ্য অনুযায়ী, শুধু বিদ্যুৎ বিল বাবদই বস্তিবাসীর কাছ থেকে প্রতি মাসে চার লাখ টাকা করে চাঁদা তোলেন সালমান মোল্লা। আর বস্তির পূর্ব পাশের অবৈধ স্থাপনা থেকে তার মাসিক আয় অন্তত তিন লাখ টাকা।
ইলিয়াস মোল্লার ছোট ভাই আলী মোল্লার দেহরক্ষী চিকন হারিসের নেতৃত্বে সাব্বির ও গাজী নামের দুই ব্যক্তি ওই জায়গার পশ্চিম পাশে নির্মিত স্থাপনা থেকে বস্তি ও দোকান ঘর ভাড়া বাবদ প্রতি মাসে তিন লাখ থেকে চার লাখ টাকা চাঁদা তোলেন।
এদিকে বস্তি এলাকায় সোহেল, ফারুক ও আনোয়ার নামের লোকদের নিয়ে মাদকের কারবার করে আসছেন আলোকদি এলাকার স্থানীয় সন্ত্রাসী সামছু। নোয়ার ও ফারুক নামে দুজনের টং দোকান মাদক বিক্রির জন্য ব্যবহার করা হয়।
অন্যদিকে ঝিলপাড় নতুন রাস্তা নিয়ন্ত্রণ করেন সালমান মোল্লার ড্রাইভার ফজলু। মন্দির থেকে মোড় পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করেন আলী মোল্লার অফিসের স্টাফ বেলাল ও মাসুদ। জসিম মোল্লার হয়ে বস্তি নিয়ন্ত্রণ করেন তুফান। আর ইলিয়াস মোল্লার ভাগ্নে সালমান মোল্লার হয়ে টাকা ওঠান ড্রাইভার ফজলু। জসিম মোল্লার হয়ে টাকা ওঠান তুফান। আর আলী মোল্লার হয়ে টাকা ওঠান বিল্লাল।
স্থানীয়রা জানান, নিজের নির্বাচনী এলাকা হওয়ায় ১৬ বছর ধরে ইলিয়াস মোল্লাহর কথার বাইরে কিছুই হতো না। জমি ছাড়াও বহু দোকান, মার্কেট, বাসস্ট্যান্ড ও ফুটপাত দখলে নিয়েছেন তিনি। এ নিয়ে অভিযোগ দিয়েও তেমন কোনো লাভ হয়নি।
শুধু তাই নয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে স্থানীয় সন্ত্রাসী ও নেতাকর্মীদের মিরপুর এলাকায় অতর্কিত হামলার নির্দেশদাতা ইলিয়াস মোল্লাহ। তার বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে হত্যাসহ একাধিক মামলা হয়েছে।
এলাকাবাসীর আশঙ্কা, বস্তিতে লুকিয়ে থাকা সন্ত্রাসীদের হাতে ৫ আগস্ট বিভিন্ন থানা ও নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজত থেকে লুট হওয়া অস্ত্রের কিছু থাকতে পারে। মিরপুর এলাকায় অপরাধ কর্মকাণ্ডে এসব অস্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে বলে ধারণা তাদের।
কালের আলো/এএমকে