চিকিৎসার লাগামহীন ব্যয়
প্রকাশিতঃ 9:11 am | December 30, 2024
কালের আলো রিপোর্ট:
দেশে স্বাস্থ্য খাতে ব্যক্তির নিজের ব্যয় ধারাবাহিকভাবে বেড়েই চলেছে। চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৮ দশমিক ৬ শতাংশ ব্যক্তি নিজেই বহন করেন। আর এই ব্যয় করতে গিয়ে বছরে ৮৬ লাখের বেশি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে। ২০১৮ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ পাঁচ বছরে চিকিৎসা ব্যয় তিন গুণ বেড়েছে। সরকারি খাতে চিকিৎসা বরাদ্দ কমা, ওষুধের মূল্যবৃদ্ধি ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার খরচ বৃদ্ধি পাওয়ায় চিকিৎসা ব্যয় বেড়েছে।
সুপরিকল্পিত রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময় ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির দ্রুত বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি এবং স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বৃদ্ধি করে নাগরিকদের চিকিৎসা ব্যয় কমিয়ে আনা সম্ভব। মাস কয়েক আগে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাগর-রুনী হলে ডক্টর ফর হেলথ অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়।
এক গবেষণায় দেখা গেছে, ২০১৫ সালের তুলনায় ২০২০ সালে দেশে মানুষের চিকিৎসা খাতে ব্যক্তিগত ব্যয় (আউট অব পকেট এক্সপেনসেস) আরও বেড়েছে। এ অতিরিক্ত ব্যয় ২০১৫ সালে ছিল ৬৭ শতাংশ, যা ২০২০ সালে দাঁড়িয়েছে ৬৯ শতাংশে। ২০২০ সালে বাংলাদেশে মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের দুই-তৃতীয়াংশ বা ৬৮ দশমিক ৫ শতাংশ ব্যয় হয়েছে ব্যক্তির নিজ খরচে।
জানা যায়, বছরান্তে বাড়ছে রোগীর ব্যয়ভার। প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ ও মিয়ানমারের তুলনায় বাংলাদেশে রোগীর চিকিৎসা ব্যয়ভার বেশি। মালদ্বীপে স্বাস্থ্যসেবার মাত্র ১৪ শতাংশ রোগীকে বহন করতে হয়। অথচ বাংলাদেশে একজন রোগীকে মোট ব্যয়ের ৭৩ শতাংশ বহন করতে হয়। এই ব্যয়ভার মেটাতে গিয়ে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তরা হিমশিম খাচ্ছে। বাধ্য হয়ে অনেকে মাঝপথে চিকিৎসা বন্ধ করে দিচ্ছে। যদিও জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রায় (এসডিজি) ২০৩২ সালের মধ্যে ব্যয়ের এই হার ৩২ শতাংশে নামিয়ে আনার অঙ্গীকার করা হয়েছে। চিকিৎসায় রোগীর ব্যয় বৃদ্ধির জন্য সরকারের অদূরদর্শিতা ও অবহেলাকে দায়ী করেছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা। তাদের মতে, স্বাস্থ্য খাতকে এখনো অবহেলার চোখে দেখা হয়। বাজেট বরাদ্দে স্বাস্থ্য খাত সবসময় পিছিয়ে থাকে। সামান্য যা বরাদ্দ হয় সেই অর্থও যথাযথভাবে ব্যয় করা হয় না।
এছাড়া দেশের মানুষের চিকিৎসা ব্যয়ের ৬৪ শতাংশ চলে যায় ওষুধের পেছনে। বিপর্যয়মূলক চিকিৎসা ব্যয়ের অন্যতম কারণ ওষুধ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সবার জন্য ওষুধ সহজলভ্য না হলে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা সম্ভব নয়। মানুষের চিকিৎসা ব্যয় হয় মূলত হাসপাতাল, চিকিৎসকের চেম্বার, রোগনির্ণয় বা পরীক্ষা–নিরীক্ষা, ওষুধ এবং কিছু চিকিৎসাসামগ্রীর (চশমা, ক্রাচ ইত্যাদি) পেছনে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ জাতীয় স্বাস্থ্য হিসাবে (ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস) দেখা যায়, মানুষ নিজের পকেটের ১০ দশমিক ১ শতাংশ খরচ করে হাসপাতাল ও ক্লিনিকে, চিকিৎসকের ব্যক্তিগত চেম্বারে ১৩ দশমিক ৪ শতাংশ, রোগনির্ণয় পরীক্ষা–নিরীক্ষায় ১১ দশমিক ৭ শতাংশ, ওষুধে ৬৪ দশমিক ৬ শতাংশ এবং চিকিৎসাসামগ্রীতে শূন্য দশমিক ১ শতাংশ; অর্থাৎ চিকিৎসার জন্য অন্য সব খাতে যে খরচ হয়, তার প্রায় দ্বিগুণ খরচ হয় শুধু ওষুধের পেছনে।
বিশেষজ্ঞদের বড় একটি অংশের মত, দীর্ঘস্থায়ী রোগ, বিশেষ করে ক্যানসার বা কিডনি রোগের চিকিৎসায় মানুষকে লম্বা সময় ধরে খরচ চালিয়ে যেতে হয়। বাস্তবতা হচ্ছে, অনেক পরিবারের এ ধরনের রোগের খরচ দীর্ঘ সময় ধরে বহন করার সামর্থ্য নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, চিকিৎসা খরচ মেটাতে গিয়ে দেশে প্রতিবছর বহু পরিবার বিপর্যয়ের মধ্যে পড়ে। এই বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ ওষুধ। নিয়মিত ওষুধের খরচ মেটাতে অনেক পরিবার দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়, অনেকে নিঃস্ব হয়ে হয়ে যায়।
ওষুধে বাংলাদেশ প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। প্রয়োজনের ৯৫ শতাংশ ওষুধ এখন দেশেই তৈরি হয়। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যেসব ওষুধ তৈরি করে, তাদের সব কটির মূল্য নিয়ন্ত্রণ সরকার করে না। একই ওষুধ বিভিন্ন কোম্পানি ভিন্ন ভিন্ন মূল্যে বিক্রি করে। কিছু ক্ষেত্রে দামের পার্থক্য অনেক। কিন্তু সরকার ওষুধের দাম নির্ধারণ করে দিলে তা কমিয়ে আনা যাবে এবং তাতে কোম্পানিগুলোর লাভও নিশ্চিত করা সম্ভব।
কালের আলো/এমএএএমকে