বিজিবিতে যুক্ত হলেন ৬৯৫ সদস্য, দেশের অখণ্ডতা রক্ষায় সদা জাগ্রত থাকার বার্তা স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার

প্রকাশিতঃ 5:27 pm | December 31, 2024

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো:

ছাত্র-জনতার রক্তস্নাত গণঅভ্যুত্থানের পর বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)’-এর ১০২তম রিক্রুট ব্যাচের প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ। নতুন বাংলাদেশে চ্যালেঞ্জিং সময়টিতে সীমান্তরক্ষী বাহিনীটিতে যুক্ত হলেন ৬৯৫ জন সদস্য। দীর্ঘ ২৩ সপ্তাহের কঠোর প্রশিক্ষণ শেষে মঙ্গলবার (৩১ ডিসেম্বর) সমাপনী কুচকাওয়াজে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় অবিচল থাকার দৃপ্ত শপথ করলেন নতুন এই সৈনিকরা।

সীমান্তের কাণ্ডারি হিসেবে আত্মপ্রকাশের মাহেন্দ্রক্ষণটিতে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার বায়তুল ইজ্জতে অবস্থিত বিজিবি এর ঐতিহ্যবাহী প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান ‘বর্ডার গার্ড ট্রেনিং সেন্টার এন্ড কলেজ (বিজিটিসিএন্ডসি)’-এর ‘বীর উত্তম মজিবুর রহমান প্যারেড গ্রাউন্ডে’ নবীন সৈনিকদের শপথ গ্রহণ, প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ পরিদর্শন ও অভিবাদন গ্রহণ করেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব:) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।

নবীন সৈনিকদের উদ্দেশ্যে এ সময় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘শৃঙ্খলা হচ্ছে সৈনিক জীবনের অলংকার। আদেশ ও কর্তব্য পালনে যে কখনো পিছপা হয় না সে-ই প্রকৃত সৈনিক। সততা, বুদ্ধিমত্তা, নির্ভরযোগ্যতা, আনুগত্য, তেজ ও উদ্দীপনা একটি বাহিনীর শৃঙ্খলা ও পেশাগত দক্ষতার মাপকাঠি।’ নবীন সৈনিকরা এসব গুণাবলির প্রতিফলন ঘটিয়ে বাহিনীর ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে তিনি বলেন, ‘বিজিবি’র চারটি মূলনীতি-‘মনোবল, ভ্রাতৃত্ববোধ, শৃঙ্খলা ও দক্ষতা’-এ উদ্বুদ্ধ ও অনুপ্রাণিত হয়ে বিজিবি’র ওপর অর্পিত দায়িত্ব সুশৃঙ্খল ও সূচারুরূপে পালন করে দেশের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতা রক্ষার সুমহান দায়িত্ব পালনে সদা জাগ্রত থাকতে আহ্বান জানান।’

বিজিবি সদর দপ্তর সূত্র জানায়, বিজিবি’র ১০২তম রিক্রুট ব্যাচের প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে বিজিবি মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী, পুলিশ মহাপরিদর্শক বাহারুল আলমসহ ঢাকা, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলের সামরিক ও বেসামরিক উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এর আগে চলতি বছরের ৩০ জুলাই ১০২তম রিক্রুট ব্যাচের মৌলিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। প্রশিক্ষণ ভেন্যুতে সর্বমোট ৬৯৫ জন রিক্রুটের মধ্যে ৬৪৯ জন পুরুষ এবং ৪৬ জন নারী রিক্রুট মৌলিক প্রশিক্ষণ সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন করেন।

দেশমাতৃকার জন্য জীবন উৎসর্গ করা বীর শহীদদের গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ
এদিন সকালে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব:) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীকে সশস্ত্র সালাম প্রদানের মধ্য দিয়ে নবীন সৈনিকদের শপথ গ্রহণ ও প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয়। প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজে অভিবাদন গ্রহণ শেষে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা নবীন সৈনিকদের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দিক-নির্দেশনামূলক ভাষণ প্রদান করেন। ভাষণের শুরুতে তিনি বিজিবি’র সেই সকল অকুতোভয় সদস্যদের, যাঁরা ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশমাতৃকার জন্য জীবন উৎসর্গ করে গেছেন তাদেরকে গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। একই সঙ্গে তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধে জীবন উৎসর্গকারী বিজিবি’র ২ জন বীরশ্রেষ্ঠ, ৮ জন বীরউত্তম, ৩২ জন বীরবিক্রম এবং ৭৮ জন বীরপ্রতীক খেতাবে ভূষিত বীরসহ ৮১৭ জন অকুতোভয় বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন।

উপদেষ্টা চলতি বছরের জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আত্মদানকারী শহীদদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে বলেন, ‘গত জুলাই-আগস্টে সংঘটিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বিজিবি সদস্যরা ছাত্র-জনতার দাবির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। আন্দোলনে আহত ও নিহত ব্যক্তি ও পরিবারবর্গের সহায়তার ক্ষেত্রেও বিজিবি এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপনে সক্ষম হয়েছে। আহত ছাত্র-জনতাকে নিজস্ব উদ্যোগে চিকিৎসাসেবা ও তাদের পুনর্বাসনে আর্থিক সহায়তা প্রদান বিজিবিকে জনমানুষের আস্থা ও ভালবাসার প্রতীকে পরিণত করেছে।’

সুশৃঙ্খল ও পেশাদার দেশপ্রেমিক বাহিনীতে পরিণত হয়েছে বিজিবি
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ আজ একটি সুসংগঠিত, চৌকস, সুশৃঙ্খল ও পেশাদার দেশপ্রেমিক বাহিনীতে পরিণত হয়েছে মন্তব্য করে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘সীমান্তরক্ষী এই বাহিনীর সৃষ্টিলগ্ন থেকে এর উন্নয়ন ও সমৃদ্ধিতে যারা অবদান রেখেছেন তাদের সকলের অবদানকে কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করছি।’ বিজিবি ‘সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী’ হিসেবে বাংলাদেশের ৪ হাজার ৪২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত সুরক্ষা এবং সীমান্তের ভূমি ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধানের পাশাপাশি সীমান্তে চোরাচালান ও মাদক পাচাররোধ, নারী ও শিশু পাচারসহ যেকোনো ধরনের সীমান্ত অপরাধ দমন এবং বেসামরিক প্রশাসনকে সহায়তায় অত্যন্ত দক্ষতা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে দেশবাসীর আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছে।’

সীমান্তে দায়িত্ব পালনে পিঠ প্রদর্শন না করার আহ্বান
নবীন সৈনিকদের উদ্দেশ্যে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বিজিবি’র নবীন সৈনিকদের প্রদর্শিত তেজদীপ্ত কুচকাওয়াজের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। তিনি নতুন জীবনে পদার্পণের শুভলগ্নে তাদেরকে স্বাগত জানান। লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব:) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ‘সৈনিকদের সততা, নিষ্ঠা ও পেশাগত দক্ষতার ওপরই বাহিনীর ভাবমূর্তি ও গৌরব নির্ভর করে।’ তাই সীমান্তে দায়িত্ব পালনের সময় প্রতিপক্ষ বাহিনীর কাছে কোনো অবস্থাতেই পিঠ প্রদর্শন না করার জন্য বিজিবির প্রতিটি সদস্যকে উদাত্ত আহ্বান জানান। দেশ মাতৃকার এক ইঞ্চি মাটিও যেন হাতছাড়া না হয় বিজিবি সদস্যরা তা জীবন দিয়ে হলেও রক্ষা করবে এই আশাবাদ ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন, ‘বিজিবির দেয়া নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তাই দেশের মানুষের নির্বিঘ্ন ঘুম নিশ্চিত করবে। বিজিবি হবে সীমান্তের নিরাপত্তা ও আস্থার প্রতীক।’

সেরা চৌকস রিক্রুট হিসেবে প্রথম নাঈম মন্ডল
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠান শেষে ১০২তম রিক্রুট ব্যাচের সেরা চৌকস রিক্রুট হিসেবে প্রথম স্থান অধিকারী বক্ষ নম্বর-১৯৩ রিক্রুট (জিডি) মো. নাঈম মন্ডল এবং অন্যান্য বিষয়ে সেরা সৈনিকদের হাতে তাদের সফলতার জন্য ক্রেস্ট তুলে দেন। এরপর নবীন সৈনিকদের চৌকস দল স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাকে সশস্ত্র সালাম প্রদানের মাধ্যমে কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠান শেষ হয়। বিজিবি’র প্রশিক্ষিত সদস্যদের অংশগ্রহণে আকর্ষণীয় ট্রিক ড্রিল এবং বিজিবি’র সুসজ্জিত বাদকদল মনোজ্ঞ ব্যান্ড ডিসপ্লে প্রদর্শন করে।

মিয়ানমার সীমান্ত বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে
পরে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী মিয়ানমার সীমান্ত বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে আছে বলে জানান। তিনি বলেন, ‘মিয়ানমার সীমান্ত আমাদের নিয়ন্ত্রণে। আরাকান আর্মি নিয়ে কোনো আশঙ্কার কারণ নেই। পরিস্থিতির কারণে বন্ধু শত্রু হয়ে যায়, আবার শত্রু বন্ধু হয়ে যায়। করণীয় নিয়ে সরকার সজাগ আছে। এ নিয়ে আলোচনা চলছে।’

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘ভারতীয় সীমান্তে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) যাতে কোনো অবস্থাতেই পিঠ নয়, বুক দেখায়, সে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সম্প্রতি সীমান্ত হত্যার পেছনে দুই প্রান্তের খাসিয়া সম্প্রদায় দায়ী।’

কালের আলো/এমএএএমকে