নতুন বছরে বিনিয়োগ-কর্মসংস্থান-মূল্যস্ফীতির চ্যালেঞ্জ

প্রকাশিতঃ 3:01 pm | January 01, 2025

কালের আলো ডেস্ক:

দেশের অর্থনীতি নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে। অর্থনীতিতে বিদ্যমান বিভিন্ন ধরনের কঠিন সমস্যা বা চ্যালেঞ্জ রয়েছে।

সেই ধারাবাহিকতায় ২০২৫ সাল প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা, বিনিয়োগ বাড়ানো, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং মূল্যস্ফীতির মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার বছর হবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা।
তারা বলছেন, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এক বিশেষ প্রেক্ষাপটে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে। তারপর থেকেই বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপক সংস্কারের চেষ্টা চলছে। এক্ষেত্রে অবশ্য অর্থনীতিতে বর্তমানে যেসব সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে, সেগুলো নতুন করে তৈরি নয়।

তারা আরও বলছেন, সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করা না গেলে আগামীতে অবস্থা আরও জটিল হয়ে ওঠার যথেষ্ট আশঙ্কা রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারে যারা আছেন, তাদের বিভিন্ন কমিশন আছে, টাস্কফোর্স আছে। তাদের সক্ষমতা ও দূরদর্শী কর্মপরিকল্পনায় ২০২৫ সালের প্রত্যাশা ও বাস্তবতাকে ধারণ করে এসব চ্যালেঞ্জ সামাল দিয়ে ইতিবাচক পরিবেশে ২০২৬ সালে যাওয়ার কথা বলছেন অর্থনীতিবিদেরা।

নতুন বছরে দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে কয়েকটি বিষয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) প্রবৃদ্ধি বাড়ানো, বিনিয়োগ বাড়িয়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের।

যদিও দেশে সম্প্রতি অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি বেশ কিছুটা কমে গেছে। কারণ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি না পাওয়ার কারণে প্রত্যাশিত মাত্রায় জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন করা যাচ্ছে না। বর্তমানে রপ্তানি খাতে সংকোচন দেখা যাচ্ছে। পণ্য রপ্তানি খাত সংকুচিত হলে তা বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ওপর এক রকম চাপ সৃষ্টি করে।

রপ্তানি আয় কমে গেলে বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা টাকার বিনিময় হার বা মান কমে যেতে পারে। স্থানীয় মুদ্রার অবমূল্যায়ন হলে তা আবার মূল্যস্ফীতিকে ঊর্ধ্বমুখী করে তোলে। কাজেই রাজস্ব আহরণ বাড়ানোর পাশাপাশি অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে হলে রপ্তানি খাতকে আরও বেশি শক্তিশালী করতে হবে। একইসঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আরও অনেক বেশি মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ অর্থনীতিবিদদের।

নির্বাচনী রোডম্যাপের ফলে অনিশ্চয়তা কাটছে
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আগামী বছরটা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বছর হবে। আগের বছরের প্রত্যাশার মধ্য দিয়ে নতুন বছর শুরু হবে। নির্বাচনের প্রস্তুতির একটা বিষয়সহ অর্থনীতির অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার চেষ্টা এই বছরে থাকতে হবে। বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান এবং মূল্যস্ফীতির মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার বছর হবে ২০২৫।

২০২৪ সালের শেষের দিকে রপ্তানি খাতের অগ্রগতি তুলে ধরে তিনি বলেন, আগের বছরের শেষের দিকে দেখেছি রপ্তানি খাত ভালো করছে। রিজার্ভের অবনমন থামানো গেছে। ফলে অনিশ্চয়তা যা ছিল, দেশি বা বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যে নেতিবাচক প্রভাব ছিল, তা কেটে গেছে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার পর।

মোস্তাফিজুর রহমান আরও বলেন, এটাকে সুসংহত করতে হবে। একইসঙ্গে পুরনো বছরের চ্যালেঞ্জ ও নতুন বছরের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলাও করতে হবে। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, বিনিয়োগে চাঞ্চল্য আনা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি, মানুষের ক্রয়ক্ষমতার অবনমন রোধ করার পাশাপাশি সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিগুলো শক্তিশালী করতে হবে।

‘অন্তর্বর্তী সরকার যে সংস্কার কার্যক্রম হাতে নিয়েছে এবং শ্বেতপত্রে যেসব চ্যালেঞ্জের কথা বলা হয়েছে, সেসবের সমাধানের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। সংস্কারের কিছু প্রস্তাব এরইমধ্যে চলে এসেছে বা আসবে, সেগুলো অন্ততপক্ষে বাস্তবায়ন শুরু করার একটা প্রক্রিয়া বা চেষ্টা ২০২৫ সালে থাকতে হবে। ’

২০২৫ সালের শেষে নির্বাচনী আবহাওয়া বিরাজ করবে। তা যাতে কোনো অনিশ্চয়তা সৃষ্টি না করে— উল্লেখ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, আমরা যেন ২০২৫ সালে শান্তিপূর্ণ ও সমঝোতাপূর্ণ নির্বাচনে যেতে পারি, তা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ তা অর্থনীতির স্থিতিশীলতা, অগ্রগতি, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

এলডিসি থেকে উত্তরণ নিয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ২০২৫ সালে আমাদের এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রস্তুতিটা ভালোভাবে বেগবান করতে হবে। সব মিলিয়ে ২০২৪ সালের এত বড় একটা পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা, প্রত্যাশা ও বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ থাকবে। অর্থনীতির যে চলমান চ্যালেঞ্জ, তা মোকাবিলা করতে হবে, একইসঙ্গে সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যবস্থাপনাকে উন্নত করে প্রবৃদ্ধি ও বণ্টনের ভারসাম্য বজায় রেখে অগ্রসর হওয়ার একটা তাগিদ থাকবে। আমরা আশা করব অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৫ সালে প্রত্যাশা ও বাস্তবতাকে ধারণ করে এসব চ্যালেঞ্জ সামাল দিয়ে ইতিবাচক পরিবেশে ২০২৬ সালে যেতে পারবে।

প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে অবশ্যই বিনিয়োগ বাড়াতে হবে
কথা হলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম  বলেন, ২০২৫ সালে অর্থনীতির প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা। দ্বিতীয়ত, আমাদের বৈদেশিক বিনিময় হারের ক্রমাগত অবমূল্যায়ন হচ্ছে, তা স্থিতিশীল করা। এ জন্য আমাদের রপ্তানি আয় বাড়াতে হবে।

‘প্রবাসীদের অর্থ পাঠানো সম্প্রতি কিছুটা বেড়েছে। এই ধারা অবশ্যই যেন বজায় থাকে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এটি নিঃসন্দেহে একটি বড় চ্যালেঞ্জ। সব মিলিয়ে গুরুত্ব বিবেচনা করে সঠিক সময়ে সঠিক কাজগুলো করতে সক্ষম হলে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসবে। ’

তিনি বলেন, বর্তমান সময়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি কঠিন ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরে দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ কয়েকবার মুদ্রানীতি পরিবর্তন করেছে। যদিও বাংলাদেশের মতো অর্থনীতিতে শুধু মুদ্রানীতি দিয়ে উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এ জন্য মুদ্রানীতি ও রাজস্ব নীতির সমন্বয় সাধন করতে হবে। মনে রাখতে হবে, মূল্য বাড়িয়ে পণ্যের চাহিদা হয়তো কমানো যাবে, কিন্তু পণ্যের জোগান যদি একইসঙ্গে না বাড়ে, তাহলে মূল্যস্ফীতি কমবে না।

ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়লে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগ কমে যায় উল্লেখ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, বিনিয়োগ কমে গেলে উৎপাদন কমে যাবে। আর উৎপাদন কমে গেলে কর্মসংস্থানের পর্যাপ্ত সুযোগ সৃষ্টি হবে না। আর সবার জন্য উপযুক্ততা অনুযায়ী কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা না গেলে দেশে দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রম কোনোভাবেই কাজে আসবে না। কাজেই নতুন বছরে সরকারকে মূল্যস্ফীতির অভিঘাত রক্ষার পাশাপাশি আমাদের উৎপাদনশীলতা বাড়াতে হবে। একইসঙ্গে আমাদের রপ্তানি বাড়াতে হবে। এসব অভিঘাত মোকাবিলায় আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আরও অনেক বেশি মনোযোগ দিতে হবে।

বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, সার্বিকভাবে দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি মোটেও সন্তোষজনক নয়। আমরা জানি, বাংলাদেশ বিনিয়োগের জন্য অত্যন্ত উপযোগী একটি স্থান। এখানে রয়েছে ১৭ কোটি ভোক্তার এক বিশাল বাজার। কিন্তু বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের সময় নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হন। এ ছাড়া দেশে যদি অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগকারীরা পর্যাপ্ত পরিমাণে বিনিয়োগ না করেন, তাহলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরাও সাধারণত সে দেশে বিনিয়োগের জন্য আগ্রহী হন না।

‘স্থানীয় বিনিয়োগকারীরা যদি বিনিয়োগ বাড়ান, তাহলে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা মনে করেন দেশটিতে বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ আছে। তখন তারা বিনিয়োগের জন্য উৎসাহী হন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমরা দেশের বিনিয়োগ পরিবেশ এখনো উন্নত এবং বিনিয়োগবান্ধব করতে পারিনি। বিনিয়োগ বাড়াতে পারাটা বর্তমান সরকারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। এসব বিষয় সামনে রেখে আমাদের নানামুখী পদক্ষেপ নিতে হবে। ’

তিনি বলেন, আমাদের প্রবৃদ্ধি বাড়াতে হলে অবশ্যই বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বিশেষ করে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ অপেক্ষাকৃত অনেক কম। এক দশক ধরে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ জিডিপির ২২ থেকে ২৩ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য বেশ কিছু করণীয় আছে। প্রথমত; আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবশ্যই ভালো করতে হবে। দ্বিতীয়ত; অবকাঠামো, ট্রান্সপোর্টসহ ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইত্যাদি ক্ষেত্রেও নানা রকমের সমস্যা আছে।

‘তৃতীয়ত, ইজ অব ডুয়িং বিজনেস যে সূচকে আছে, সেই সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান অনেক নিচে। এর মধ্যে বেশ কিছু সাব-ইন্ডিকেটরস আছে। সেগুলোর উন্নতি হওয়া দরকার। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত কোনোভাবেই সন্তোষজনক নয়। এসব বিষয় যদি আমরা সমন্বয় করতে পারি, তাহলে আশা করা যায়, দেশের অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি বাড়বে এবং দেশে একটি স্থিতিশীল অর্থনৈতিক পরিবেশ ফিরে আসবে।

কালের আলো/এএমকে