চিকিৎসক নিগ্রহ, আলোর মুখ দেখেনি সুরক্ষা আইন

প্রকাশিতঃ 2:31 pm | January 03, 2025

কালের আলো ডেস্ক:

ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে গত বছরের ৫ এপ্রিল ফিরোজ শাহ হাউজিং এলাকায় কিশোর গ্যাং সদস্যদের হামলায় গুরুতর আহত হন দন্ত চিকিৎসক ডা. কোরবান আলী। মাথায় ইটের আঘাতে মুমূর্ষু অবস্থায় তাঁকে প্রথমে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়।

পরে উন্নত চিকিৎসার জন্য নগরের ওআর নিজাম রোডে বেসরকারি মেডিক্যাল সেন্টার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১০ এপ্রিল ভোরে মারা যান তিনি।
এ ঘটনায় ডা. কোরবান আলীর ছেলে আলী রেজা নুর বাদী হয়ে আকবর শাহ থানায় মামলা দায়ের করেন। পুলিশ ৩ জনকে গ্রেপ্তার করে।
পটিয়া উপজেলায় মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আহত সাইফুল্লাহ পলাশ নামের এক ব্যক্তিকে চিকিৎসা দিতে দেরির অভিযোগ তুলে পটিয়া জেনারেল হাসপাতালে ঢুকে জরুরি বিভাগে দায়িত্বরত ডা. রক্তিম দাশকে মারধর করা হয় ১০ এপ্রিল রাতে। এ ঘটনায় হাসপাতালের নির্বাহী পরিচালক এস এইচ খাদেমী বাহাদুর পটিয়া থানায় ৩ জনকে এজাহারনামীয় ও ১০-১২ জনকে অজ্ঞাত আাসামি করে মামলা দায়ের করেন। তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জনকে ঘটনা তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেন। মাথায় আঘাত পেয়ে চিকিৎসা নিতে হয় আহত চিকিৎসককে।

নগরের ওআর নিজাম রোডে মেডিক্যাল সেন্টার হাসপাতালে গত বছরের ১৩ এপ্রিল রাত ১০টায় ব্রঙ্কোনিউমোনিয়ার জটিলতা নিয়ে এক শিশু ভর্তি হয় এনআইসিইউতে। পরদিন ১৪ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৯টায় শিশুটি মারা যায়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে দায়িত্বরত শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. রিয়াজ উদ্দিন শিবলুকে মারধর করে রোগীর স্বজনরা। গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে চমেক হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয়। এ ঘটনায় শিশুর বাবার নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত ১৮-২০ জনকে আসামি করে পাঁচলাইশ থানায় মামলা করে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। পুলিশ ৬ জনকে গ্রেপ্তার করে।

ডা. রক্তিম ও ডা. রিয়াজের ওপর হামলার প্রতিবাদে ২৩ এপ্রিল সারাদিন সেবাদান বন্ধ রাখেন চিকিৎসকরা। হামলার আসামিসহ জামিনপ্রাপ্তদের জামিন বাতিলের দাবি ও অন্য আসামিদের গ্রেপ্তারের দাবিতে এই কর্মসূচিতে একাত্মতা জানায় বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) চট্টগ্রাম শাখা, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ চট্টগ্রাম শাখা, বেসরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান সমিতি, বাংলাদেশ শিশু চিকিৎসক সমিতি ও অন্যান্য চিকিৎসক সংগঠনগুলো। এর আগে ১৮ এপ্রিল একই দাবিতে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের সামনে চিকিৎসকদের বিভিন্ন সংগঠনের অংশগ্রহণে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ সমাবেশ করা হয়।

কলকাতায় আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের ডা. মৌমিতা দেবনাথকে গত ৯ আগস্ট ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনায় চলমান আন্দোলনের সঙ্গে সংহতি জানান চট্টগ্রামের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। ১৯ ও ২০ আগস্ট নগরের দুই নম্বর গেট, কাজীর দেউড়ি এলাকায় বিক্ষোভ করেন তারা। এসময় অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে পাঁচটি দাবি তুলে ধরেন শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যে ছিল স্কুল-কলেজের পাঠ্যক্রমে পারস্পরিক সম্মতির গুরুত্ব ও যৌন-শিক্ষা সংশ্লিষ্ট বিষয় অন্তর্ভুক্ত করার দাবিও।

১৪ জুলাই চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট নুসরাত জাহান জিনিয়ার আদালতে কিডনি সরানোর অভিযোগে ডা. রাজিব হোসেন, তার পিতা ডা. রবিউল হোসেন ও তার মা খালেদা বেগমের বিরুদ্ধে মামলা করেন বায়েজিদ বোস্তামী থানা এলাকার মো. আবু বক্কর নামের এক ব্যক্তি। আদালত শুনানি শেষে মামলাটি গ্রহণ করে পিবিআই (পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) চট্টগ্রাম মেট্রো ইউনিটকে তদন্তের নির্দেশ দেন।

আগ্রাবাদের চট্টগ্রাম মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালে ১৪ অক্টোবর সকাল সাড়ে ৭টায় কর্তব্যরত ডা. আরিফুল ইসলাম ও ওয়ার্ডবয়কে মারধর করে জানে আলম রিমন নামের এক যুবক। এর প্রতিবাদে হাসপাতালের চিকিৎসক ও কর্মচারীরা দুই ঘণ্টা কর্মবিরতি পালন করেন।

রাউজানে এক চিকিৎসককে ক্রসফায়ারের হুমকি দিয়ে ৩০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি ও অপহরণের মামলায় দুইজনকে কারাগারে পাঠিয়েছেন আদালত। গত ১৩ নভেম্বর চট্টগ্রামের চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কাজী সহিদুল ইসলামের আদালত এই আদেশ দেন।

গত ২ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ঘটনার শিকার ডা. জাহাঙ্গীর আলম চাঁদা দাবি ও অপহরণের অভিযোগে রাউজান থানার সাবেক ওসি, দুই এসআই ও এক চিকিৎসকসহ ৬ জনের বিরুদ্ধে মামলার আবেদন করেন। পরদিন রাউজান থানার ওসিকে মামলাটি রেকর্ড করার নির্দেশ দেন আদালত। তিন আসামি আদালতে উপস্থিত হয়ে আত্মসমর্পণ করে জামিন আবেদন করেন। এর মধ্যে পাইওনিয়ার হাসপাতালের পরিচালক মনজুর হোসেন ও সুপারভাইজার মো. জাহাঙ্গীর আলমকে কারাগারে পাঠানো হয়। হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. ফজল করিম বাবুলের জামিন মামলার প্রতিবেদন জমা দেওয়া পর্যন্ত মঞ্জুর করা হয়।

গত ২৫ অক্টোবর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের ছাত্রী নাঈমাকে অসুস্থ অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যান। শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে তাকে প্রথমে চবি মেডিক্যাল সেন্টারে নেওয়া হয়। কর্তব্যরত ডা. সান্তনু মজুমদার তাকে চমেক হাসপাতালে রেফার করেন। চমেক হাসপাতালে পৌঁছালে চিকিৎসকরা নাঈমাকে মৃত ঘোষণা করেন। এতে চিকিৎসকের গাফিলতির অভিযোগ তুলে শিক্ষার্থীরা চবি মেডিক্যাল সেন্টারের সামনে জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করেন।

ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি, রাইটস অ্যান্ড রেসপন্সিবিলিটিজ (এফডিএসআর) বলছে, চিকিৎসকদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ঘটনাগুলোর কোনও প্রতিকার হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রশাসন এসব বিষয়কে গুরুত্ব দেয় না। এর বিচার আপস-মীমাংসা করা হয় প্রশাসন ও এক শ্রেণির চিকিৎসক নেতাদের মধ্যস্থতায়।

সংগঠনের চেয়ারম্যান ডা. আবুল হাসনাৎ মিল্টন বলেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানে ডাক্তারদের ওপর হামলার ঘটনায় সরকারি কর্মকর্তারা বাদী হয়ে মামলা করতে পারেন। এজন্য স্বাস্থ্য প্রশাসনকে আইনি সহায়তাসহ সব ধরনের সমর্থন দিতে হবে। সরকারি খরচে এসব মামলা পরিচালনা করতে দিতে হবে। এজন্য স্বাস্থ্য অধিদফতরে তালিকাভুক্ত আইনজীবী প্যানেল রাখা দরকার।

মহাসচিব ডা. শেখ আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, চিকিৎসাজনিত ভুল অস্বাভাবিক নয়। এরজন্য রোগীকে ক্ষতিপূরণসহ চিকিৎসকের লাইসেন্স বাতিলের বিধান আছে। রোগী ও চিকিৎসক উভয়ের স্বার্থে এই অভিযোগগুলোর সমাধান হওয়া জরুরি। তাই বলে একে ফৌজদারী অপরাধ হিসেবে গণ্য করে চিকিৎসককে গ্রেপ্তার ও জামিন না দেওয়া সঠিক হতে পারে না।

তারা চিকিৎসার ক্ষেত্রে ‘স্ট্যান্ডার্ড প্র্যাকটিস’ অনুসরণ করার পক্ষে মত দেন। এতে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধেও তখন ঢালাওভাবে ভুল চিকিৎসার অভিযোগ উত্থাপিত হবে না বলে মনে করেন তারা। এছাড়া সব চিকিৎসাকেন্দ্রে সিসি ক্যামেরাসহ নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার দাবি জানায় সংগঠনটি।

২০১৪ সালে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) থেকে তৎকালীন স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে চিকিৎসক সুরক্ষা আইনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠকে চিকিৎসক-রোগী দুইপক্ষের স্বার্থ, অধিকার মিলিয়ে একে ‘স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা আইন’ হিসেবে অনুমোদন দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। গত বছরের জানুয়ারিতে ডা. সামন্ত লাল সেন স্বাস্থ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার পর আইনটি চূড়ান্ত করতে আবারও উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটা আলোর মুখ দেখেনি।

বিএমএ’র পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা হয়েছিল, চিকিৎসকদের মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে গ্রেপ্তার করা যাবে না। কেউ অভিযোগ করলেই পুলিশ চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করতে পারবে না। চিকিৎসক ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। চিকিৎসকের ওপর হামলা করা হলে সর্বনিম্ন ৬ মাস এবং সর্বোচ্চ ৩ বছর কারাদণ্ডের বিধান রাখতে হবে। ভাংচুরের শাস্তি নির্ধারণের সুপারিশ ছিল যন্ত্রপাতি ভাঙার ওপর। প্রস্তাবে যে কোনও স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে যাওয়া দলে চিকিৎসক রাখার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়।

বিএমএ চট্টগ্রাম জেলার সভাপতি অধ্যাপক ডা. মুজিবুল হক খান  বলেন, পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন চিকিৎসকরা। একের পর এক চিকিৎসকের ওপর হামলার ঘটনা ঘটলেও উপযুক্ত বিচার না হওয়ার কারণে চিকিৎসকদের ওপর হামলা বেড়েই চলছে। সার্বিকভাবে চিকিৎসকরা কর্মক্ষেত্রে খুবই অনিরাপদ। চিকিৎসকদের সুরক্ষায় শক্তিশালী আইন থাকা দরকার।

কালের আলো/এএমকে