আলিঙ্গনেই থেমে গেল থমথমে পরিবেশ
প্রকাশিতঃ 9:13 pm | March 12, 2019
নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নবনির্বাচিত সহ-সভাপতি (ভিপি) নুরুল হক নুরকে বুকে জড়িয়ে নিয়েছেন ছাত্রলীগের সভাপতি মো. রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন।
ডাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ক্যাম্পাস জুড়ে টান টান উত্তেজনা বিরাজ করলেও বিকালে দুই ভিপি প্রার্থীর আলিঙ্গনে থেমে গেছে থমথমে পরিবেম। নবনির্বাচিত ভিপি প্রত্যাহার করে নিয়েছে ঘোষণা করা অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট। এর আগে শোভনের অনুরোধে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে থেকে সরে যান ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, গত সোমবার সকাল থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত ডাকসু নির্বাচনের কথা থাকলেও কয়েকটি হলে সন্ধ্যা পর্যন্ত ভোটগ্রহন করতে হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে। সারাদিনই ক্যাম্পাসের মধ্যে টান টান উত্তেজনা ছিল। সেই দিন শেষ পর্যন্ত উৎসবের বিপরীতে বিক্ষোভ, বর্জন আর উত্তাপের দেন্দ্রে পরিণত হয় দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠটি। এই নির্বাচনে ছাত্রলীগ ছাড়া সবকয়টি ছাত্র সংগঠন নির্বাচন বর্জন করেছিলেন। তারা ভিসি ও নির্বাচন কমিশনের পদত্যাগ চেয়ে ভিসির বাসভবন ও কার্যালয়ে করেছেন বিক্ষোভ।
কিন্তু সোমবার (১১ মার্চ) দিবাগত রাত ৩টা ১৭ মিনিটে বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবন মিলনায়তনে ফলাফল ঘোষণা শুরু করেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনে সহ-সভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হয়েছেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতা নুরুল হক নুর। তিনি পেয়েছেন ১১ হাজার ৬২ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রলীগ সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন পেয়েছেন ৯ হাজার ১২৯ ভোট।
ভিসির ফলাফল ঘোষণা করার পরই ছাত্রলীগের নেতারা সিনেট হলের বিক্ষোভ শুরু করেন। এসময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা নুরকে শিবির বলে আখ্যায়িত দেন। ‘শিবিরকে ভিপি মানি না, মানবো স্লোগান দেন’।
ভিসিকে ভূয়া বলেও স্লোগান দেন বিক্ষোভরা। ভিপি প্রার্থীর নাম ঘোষণা প্রায় আধাঁ ঘন্টার পর নির্বাচনে সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদ ও সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদের নাম ঘোষণা করা হয়। এ সময় উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. নাসরীন আহমেদ, উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক সামাদ, চিফ রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক এস এম মাহফুজুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।
অন্যদিকে ফলাফল ঘোষণা পর বিক্ষোভের ধারাবাহিকতায় গতকাল সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস অবরোধ করেছে ছাত্রলীগ। কাকডাকা ভোর থেকে ছাত্রলীগের ডাকে ঢাবি ক্যাম্পাসে অবরোধ কর্মসূচি চলছে। সকালের দিকে কর্মীদের উপস্থিতি অপেক্ষাকৃত কম থাকলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রলীগ কর্মীদের উপস্থিতি বাড়ছে।
সকাল ৭টা থেকে সকাল ১০টার আগে পর্যন্ত সীমিত পর্যায়ে যানবাহন চললেও ১০টার পর ক্যাম্পাসে প্রবেশের বিভিন্ন রাস্তা শাহবাগ, নীলক্ষেত,পলাশী, বকশিবাজার পুরোপুরি ব্যারিকেড দিয়ে যানবাহন প্রবেশ বন্ধ করে দেয়া হয়। ছাত্রলীগের অভিযোগ তুলে, নুরুল হক নুর জামায়াত-শিবির কর্মী। ছাত্রলীগের অনির্ধারিত এ অবরোধের কারণে বিপাকে পড়েছেন ক্যাম্পাসে অবস্থিত উদয়ন ও ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুলের শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকরা। তাদের ক্যাম্পাসে যেতে দেয়া হলেও রিকশা ও মোটরসাইকেলসহ যানবাহন আটকে দেয়া হয়েছিল। অনেকে ব্যারিকেড পেরিয়ে স্কুল পর্যন্ত পৌঁছালে সেখান থেকে তাদের ফিরিয়ে দেয়া হয়।
সকাল ১০টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ভিসির বাসভবনের সামনে বসে স্লোগান দেন ছাত্রলীগ কর্মীরা। প্রহসনের নির্বাচন মানি না মানব না’, ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’, ‘ভয় করি না বুলেট বোমা, আমরা সবাই মুজিব সেনা’। এর অদূরে ভিসির বাসভবনের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ নীরবে দাঁড়িয়ে। এসময় ছাত্রলীগের কর্মীরা টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেন।
অপর দিকে গতকালকের নির্বাচন বাতিল করে পুনরায় নির্বাচনের দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছে বামপন্থী শিক্ষার্থীদের একাংশ। গতকাল মঙ্গলবার সকাল থেকে টিএসসি চত্বরে সমবেত হয়ে শিক্ষার্থীরা অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন। বিভিন্ন স্লোগানে মাইকের তালে তাল মেলাচ্ছেন অন্যরা। প্রহসনের নির্বাচন মানি না, মানবো না, মানবতার ফেরিওয়ালা নির্বাচনে দিচ্ছে তালা, জালিয়াতির নির্বাচন বাতিল করতে হবে, দিয়েছি তো রক্ত আরও দেবো রক্ত প্ল্যাকার্ড ফেস্টুনে লেখা এমন নানা স্লোগান হাতে শিক্ষার্থীরা অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে ছিলেন। এছাড়া ডাকসু নির্বাচনে ভোট দিতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের তিক্ত অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হচ্ছে। শতাধিক শিক্ষার্থী আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন।
আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়াদের মধ্যে পরিসংখ্যান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রুদ্র রায় জানান, অবিলম্বে প্রহসনের নির্বাচন বাতিল করে পুনরায় নির্বাচন দিতে হবে। জালিয়াতির নির্বাচন মানি না- এ দাবিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছেন।
ডাকসুর নবনির্বাচিত সহ-সভাপতি (ভিপি) নুরুল হক নুর ও তার সহকর্মীদের ওপর হামলা চালিয়েছে ছাত্রলীগ। গতকাল মঙ্গলবার বেলা ২টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রে (টিএসসি) এ ঘটনা ঘটে। দুপুরে সহকর্মীদের নিয়ে হাসপাতাল থেকে ঢাবি ক্যাম্পাসে আসেন নবনির্বাচিত ভিপি নুরুল হক। টিএসসিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন তিনি। এ সময় মিছিল নিয়ে ছাত্রলীগের বিশ্ববিদ্যালয়ের নেতাকর্মীরা ডাকসু নির্বাচনে কোটা আন্দোলনকারীদের প্যানেলের সদস্যদের ওপর হামলা করেন।
তারা ছাত্রলীগ সভাপতি শোভনের অনুসারী বলে জানা গেছে। ছাত্রলীগ কর্মীরা সেখানে কয়েকজনকে মারধর করেন এবং স্লোগান দেন। এ সময় ছাত্রদলের অপর একটি মিছিল এদিকে আসছিল। সেই মিছিলও সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে। মিছিলে থাকা ডাকসু নির্বাচনের সমাজসেবা পদে প্রতিদ্বন্দ্বি^তাকারী ছাত্রদলের তৌহিদুর রহমানের মাথা ফেটে যায়।
টিএসসিতে অনেকটা ত্রিমুখী সংঘর্ষের আবহ সৃষ্টি হয়। এদিকে ছাত্রলীগের ধাওয়া খেয়ে টিএসসির সামনে বাম জোটের মিছিলের দিকে চলে যান নুর ও তার সহকর্মীরা। এরপর বাম জোটের ভিপি প্রার্থী লিটন নন্দী, বেনজীরসহ নুরদের মিছিল টিএসসি থেকে ঢাবির ভেতরে ঢোকে। ক্যাম্পাসে ধর্মঘটের সমর্থনে ক্লাস বর্জন করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
কলাভবন, কার্জন হল, মোকারম ভবন, এনএক্স ভবনের কোথাও ক্লাস হতে দেখা যায়নি। শিক্ষার্থীরা কেউ ক্লাসে আসেননি, তেমনি শিক্ষকদেরও দেখা মেলেনি। এর আগে সোমবার (১১ মার্চ) ডাকসু নির্বাচনে কারচুপি ও নজিরবিহীন ভোট জালিয়াতির অভিযোগ এনে এর প্রতিবাদে মঙ্গলবার থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট ও ক্লাস বর্জন কর্মসূচি ঘোষণা করে নির্বাচন বর্জনকারী বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন সমর্থিত প্যানেল এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।
ভোট কারচুপির অভিযোগ এনে ভিপি ছাড়া বাকি পদগুলোতে স্বচ্ছ নির্বাচনের দাবি জানিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘটের ডাক দিয়েছেন ডাকসুর নবনির্বাচিত সহসভাপতি (ভিপি) নুরুল হক নুর। ধর্মঘট কতদিন চলবে এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই বিষয়ে অন্যান্য প্যানেলের প্রার্থীদের সঙ্গে বৈঠক করে কর্মসূচির বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হবে।
দুপুরে ভিসির বাসার সামনে গিয়ে শোভন নেতাকের্মীদের সেখান থেকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘সবার আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো বিশৃঙ্খলা হলে, এতে ছাত্রলীগের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। এমন কোনো কাজ করা যাবে না, যেন ছাত্রলীগের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। নির্বাচনের ফলাফল মেনে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে কাজ করবো।’
বিকেল সোয়া চারটার দিকে টিএসসি মিলানায়তনে কয়েশ নেতাকর্মী নিয়ে ছাত্রলীগ সভাপতি টিএসসি মিলনায়তনে অবস্থান করা নুরের কাছে গিয়ে ডাকসুর নবনির্বাচিত ভিপিকে মেনে নেওয়ার জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানান। নুরুল হক নুরকে শুভেচ্ছা জানিয়ে তার সঙ্গে কোলাকুলি করেছেন তিনি।
ছাত্রলীগের নেতাকর্মীসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘তোমরা তাকে সকল রকমের সহযোগিতা করবে। এটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি নির্বাচন। সকলকে মেনে নিয়ে পরস্পরকে সহযোগিতা করতে হবে। তাকে দায়িত্বশীল আচরণ করতে হবে আর তোমাদের শিক্ষার্থীদের তাকে সহযোগিতা করতে হবে। এ সময় শোভন সাংবাদিকদের বলেন, নুরকে ভিপি হিসেবে মেনে নিয়েছেন তারা। ছাত্রলীগ সবাইকে নিয়ে কাজ করবে বলে ঘোষণা দেন তিনি।
শোভন বলেন, ভোটাররা ভিপি পদে নুরুল হক নুরকে বেছে নিয়েছেন। তাদের রায়ের পতি আমি সম্মান জানাচ্ছি। তার সঙ্গে আছি, তাকে নিয়েই শিক্ষার্থীদের যে কোনো অধিকার আদায়ে কাজ করব। নুর ডাকসুর ভিপি। তিনি কোনো দলের নয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীর ভিপি তিনি। তাকে সবাই সহযোগিতা করতে হবে। শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ে তার পাশেই থাকবে ছাত্রলীগ। এর জবাবে ভিপি নুর বলেন, ‘শোভন ভাই আমার হলের বড় ভাই। আমার কাছে ভালো লেগেছে তিনি আমাকে শুভেচ্ছা জানাতে এসেছেন। আমরা একই পদে নির্বাচন করেছি। আমি বিজয়ী হয়েছি। তিনি আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। এটা খুবই ভালো লেগেছে।
গতকাল মঙ্গলবার ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ শুভেচ্ছা জানাতে গেলে ভিপি নুর উপস্থিত গণমাধ্যমকর্মীদের এক প্রশ্নে সবার সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করার কথা জানান নবনির্বাচিত ভিপি। এর আগে তিনি ডাকসুর নির্বাচনের কারচুপির অভিযোগ এনে ভিপি ও সমাজসেবা সম্পাদক পদ ছাড়া সব পদে পুননির্বাচন দাবি করেছিলেন। বাংলাদেশ সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ আন্দোলনের নেতা ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের নির্বাচিত ভিপি ডাকসুর পুননির্বাচনের দাবি থেকে সরে এসেছেন। তিনি ধর্মঘট প্রত্যাহার করে সবার সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করার আহ্বান জানান।
কালের আলো/এমএইচএ