৩৬ চিকিৎসকের পদ শূন্য, হাসপাতাল যেন নিজেই রোগী!

প্রকাশিতঃ 11:20 am | January 05, 2025

সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি, কালের আলো:

হাসপাতাল যেন নিজেই রোগী। ভবনসহ সব সুযোগ-সুবিধা থাকলেও দীর্ঘদিন ধরে ৩৬ জন চিকিৎসক ও ৭৪ জন নার্সের পদ শূন্য রয়েছে। জেলার প্রায় ২৭ লাখ মানুষের চিকিৎসা সেবার একমাত্র ভরসাস্থল ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট সুনামগঞ্জ জেলা সদর হাসপাতালটি এখন নিজেই রোগে আক্রান্ত। সঠিক তদারকির অভাবে দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালের চিকিৎসা সেবার উন্নয়ন হচ্ছে না। জেলার ১২ উপজেলার রোগীরা হাসপাতালে সঠিক চিকিৎসা না পেয়ে সিলেটসহ বিভিন্ন প্রাইভেট হসপিটালে যেতে বাধ্য হচ্ছেন। তবে সবচেয়ে বেশি সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে এলাকার গরিব-অসহায় রোগীরা, যাদের প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা করার মতো অর্থ নেই।

সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, জেলা সদর হাসপাতালটির খাবার সরবরাহ নিয়ে রোগীদের রয়েছে নানান অভিযোগ। ওয়ার্ডের ওয়াশরুম নোংরা, ভেতরে দুর্গন্ধ। শিশু ওয়ার্ড, মহিলা ওয়ার্ড, সার্জারি ওয়ার্ডে রোগীরা বেড না পেয়ে ফ্লোরে গাদাগাদি করে চিকিৎসা নিচ্ছেন। রোগীর সঙ্গে থাকা লোকজনও তাদের সঙ্গেই শুয়ে আছেন। বহিরাগতদের আনাগোনাও লক্ষণীয়। এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালের এক্সরে মেশিনটি অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে, কারো কোনো খেয়াল নাই।

তাহিরপুর উপজেলার আলেয়া বেগম গণমাধ্যমকে জানান, তার ৭ মাসের নাতির পাতলা পায়খানা হয়েছে। দু’দিন আগে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। ওয়ার্ডের ভেতরে পর্যাপ্ত পরিমাণে সিট না থাকায় মেঝেতে রেখেই চিকিৎসা নিচ্ছেন তারা। যে ওয়ার্ডে ১০ জন রোগী থাকার কথা সেখানে ২০ জন রোগী গাদাগাদি করে চিকিৎসা নিচ্ছেন। প্রতিটি ওয়ার্ডের টয়লেট খুবই নোংরা, আর্বজনায় ভরপুর। নিয়মিত পরিষ্কার না করায় দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। সেইসঙ্গে উড়ছে মশা-মাছি। এখানে চিকিৎসা নিতে এসে আরও অসুস্থ হতে হচ্ছেন রোগীসহ সঙ্গে থাকা লোকজন।

বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ধনপুর গ্রামের রহিমা বেগম জানান, তিনি/চার দিন আগে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এর মধ্যে চার দিন সকালে পেয়েছেন ডিম, পাউরুটি আর কলা। দু’দিন পেয়েছেন সেমাই ও পাউরুটি। কিন্তু হাসপাতালের খাদ্য তালিকায় রোগীদের সকালের নাস্তা বাবদ ডিম, কলা, ব্রেড ও চিনি দেওয়া আছে। দুপুরের রাতের খাবার তালিকায় আছে মাছ, মুরগি, ডাল ও সবজি। কিন্তু রোগীদের দুপুর ও রাতে দেওয়া হচ্ছে শুধু ব্রয়লার মুরগি আর ডাল।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, জেলা সদর হাসপাতালটিতে ৬৬ জন এমবিবিএসসহ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক থাকার অনুমোদন থাকলেও বর্তমানে কমর্রত আছেন ৩০ জন চিকিৎসক। দীর্ঘদিন ধরে ৩৬ জন চিকিৎসকের পদ শূন্য রয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে সিনিয়র কনসালটেন্ট (সার্জরি), জুনিয়র কনসালটেন্ট (সার্জারি), সিনিয়র কনসালটেন্ট (চক্ষু), জুনিয়র কনসালটেন্ট (চক্ষু), সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি) সিনিয়র কনসালটেন্ট (গাইনি), সিনিয়র কনসালটেন্ট (কার্ডিওলজি), সিনিয়র কনসালটেন্ট (ডেন্টাল), জুনিয়র কনসালটেন্ট (প্যাথলজি), জুনিয়র কনসালটেন্ট (রেডিওলজি)।

অপরদিকে, দ্বিতীয় শ্রেণির নার্সসহ ২৬৪টি পদের মধ্যে শূন্য রয়েছে ৭৪টি পদ। তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর ৩৮টি পদের মধ্যে ১৯টি শূন্য এবং চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর ২৮টি পদের মধ্যে ১৩টি পদ শূন্য রয়েছে।

জেলা সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক (আরএমও) ডা. মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের এই হাসপাতালটি ২৫০ শয্যার। এখন শীত মৌসুম হওয়ায় রোগীর সংখ্যা একটু কম। এরপরও এখানে দৈনিক ভর্তি হচ্ছেন ৪০০ থেকে ৫০০ রোগী। গরমে প্রতিদিন রোগীর সংখ্যা দাঁড়ায় ৭০০ উপরে। ২৫০ শয্যা হাসপাতাল হওয়ায় তারা প্রতিদিন রোগীদের ২৫০টির বেশি ডিম দিতে পারেন না। যার কারণে খাবারে সমন্বয় করে ডিম দিতে হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘জেলার এত বড় একটি হাসপাতালে সার্জারি বিভাগের কোনো চিকিৎসক নেই। ফলে ছোটো-খাটো সার্জারির রোগীদেরও সিলেট রেফার করতে হচ্ছে। এটি আমাদের জন্য লজ্জার।’ এ সময় তিনি সার্জারি বিভাগে চিকিৎসকসহ শূন্য পদগুলোতেও চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়ার জোর দাবি জানান।

টয়লেট নোংরার বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অতিরিক্ত রোগীর চাপে টয়লেট পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা যাচ্ছে না। বিষয়টি গণপূর্ত বিভাগ দেখে। জেলা গণপূর্ত বিভাগকে এ ব্যাপারে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তারা টয়লেট সমস্যার দ্রুত সমাধান করে দিবেন বলে জানিয়েছে।’

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে সিভিল সার্জন ডা. মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ‘জেলা সদর হাসপাতালের বিষয়টি দেখভাল করেন তত্ত্বাবধায়ক। হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় সমস্যাগুলো দেখা দিয়েছে। আশা করি চিকিৎসকসহ জনবল সংকট দূর হবে এবং হাসপাতালের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।’

কালের আলো/এএএন/কেএ