হার নয় ‘অপরাজিত’ ছাত্রলীগের শোভন!
প্রকাশিতঃ 11:39 am | March 13, 2019
পলিটিক্যাল এডিটর, কালের আলো :
নেতৃত্বের স্বপ্ন তাকে দেখিয়েছিলেন স্বয়ং মুজিবকন্যা। কোন একদিন নিজেই বলেছিলেন, ছাত্রলীগে আমার পছন্দের প্রার্থী আছে। তখনই অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন আপাদমস্তক আওয়ামী লীগার, এমনই এক পরিবারের সন্তান রেজোয়ানুল হক চৌধুরী শোভনের হাতেই উঠতে যাচ্ছে দেশের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস আর ঐতিহ্যের ধারক বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতৃত্বের ঝান্ডা।
ছাত্রলীগের চেয়ারে বসে যখন ‘শেখ হাসিনা’র ছাত্রলীগ’ প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক জয়যাত্রার সূচনা ততক্ষণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের এই মেধাবী ছাত্রের সাফল্যের মুকুটে আরো একটি পালক যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা উঁকি দিলো, এক ফালি চাঁদের মতোই।
আরো পড়ুন:
ভিপি নূরকে কারা দিয়েছিলো ১২ হাজার টাকা, তদন্ত দাবি
নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ২৮ বসন্ত পর ‘দ্বিতীয় পার্লামেন্ট’ হিসেবে পরিচিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) নির্বাচন। সম্মিলিত শিক্ষার্থী সংসদের ব্যানারে ছাত্রলীগের প্যানেলে ভিপি পদে মনোনয়নও পেলেন। কিন্তু ডাকসু’র ‘নিউক্লিয়াস’ হিসেবেই যার আবির্ভূত হওয়ার কথা ‘মধ্যরাতের ফলাফলে’ সেই বিশুদ্ধ, নির্মল ও সুন্দর স্বপ্নের অপমৃত্যু হলো।
কোন এক জ্যামিতিক ছকে হয়তো ‘হার’ মানলো আওয়ামী লীগের ‘ফ্রেশ ব্লাড’ গর্বের প্রতীক রেজোয়ানুল হক চৌধুরী শোভন। কিন্তু প্রকারান্তরে দলীয় কুটকৌশলী বিরুদ্ধবাদীদের গালে চপেটাঘাত করে সব ভালো’র জন্যই নিজেকে রীতিমতো ‘বলি’ দিলেন তিনি।
বুকের ভেতরে বহমান এক সমুদ্র কষ্ট চাপা দিয়ে উপাচার্যের (ভিসি) বাসভবনের সামনে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীদের সামনে উচ্চারণ করলেন- ‘ছাত্রলীগ কর্মীদের মন ছোট হতে পারে না। ছাত্রলীগ কর্মীদের মন অনেক বড় হতে হয়।’ মুখে সুন্দর সুন্দর কথা বলে মানবতার জয়গানে ফেনা তুলতে অভ্যস্ত নেতারা যা পারেননি শোভন সেটিই করে দেখিয়েছেন।
দলীয় নেতা-কর্মীদের শান্ত করতে সৌম্য ও হৃদয়বান শোভন বলেছেন, ‘মানুষকে দূরে ঠেলে দিয়ে লাভ নাই। কারণ, আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষার্থীদেরকে নিয়ে চলতে হবে। সবাই তো আমাদের। কে আপন, কে পর? সবাই তো আপন। তুমি যদি মানুষকে পর করে দাও তাহলে তো হবে না।’
তিনি বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাদের অভিভাবক, তাদের সাথে বেয়াদবি করতে পারবো না।’
ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের প্রতি তিনি বলেন, ‘আমি হেরে গেছি, আমার মধ্যে কি ব্যথা নাই? এমন কিছু করো না যেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পাশাপাশি দেশের পরিবেশ নষ্ট হয়। যা হয়েছে সেটা মেনে নাও।’
নিজের চোখের সামনেই হাজার হাজার ছাত্রলীগ নেতা-কর্মী এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের স্বপ্নযাত্রার যবনিকাপাত ঘটিয়ে, তাদের আবেগ-অনুভূতিকে নাড়িয়ে মেঘাচ্ছন্ন দিন থেকে যেন রৌদ্রোজ্জ্বল এক বিকেলের দিকেই নিয়ে গেলেন শোভন।
হুহু করে কাঁদতে থাকা নেতা-কর্মী এবং অনুসারীদের আবেগকে পেছনে ঠেলে নিজের কাছে নিজেকেই লুকিয়ে রাখার অবিরাম চেষ্টার ব্রত নিলেন! মঙ্গলবার (১২ মার্চ) সন্ধ্যায় আপন মহিমার আলোয় ঠিকই হেসে উঠলেন। সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতা নুরুল হক নুরকে ভিপি হিসেবে মেনে বুকে জড়িয়ে আবারো নিজের হৃদয়ের বিশালতার পরিচয় দিলেন।
‘নূরকে আমি আমার ছোট ভাই বলে মনে করি। সে নিজের যোগ্যতায় ও সাংগঠনিক নৈপুণ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভোটে নির্বাচিত হয়েছে। তাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীকে এই ফল মেনে নিতে হবে। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে তাকে আমি অভিনন্দন জানাই। তাকে আমি সর্বাত্মক সহযোগিতা করবো এই অঙ্গীকার করছি’ কী অকৃপণ ভালোবাসাময় কন্ঠেই উচ্চারণ ডাকসু’র এই মুকুটবিহীন সম্রাটের।
ঈষাণ কোনে কালো মেঘ সরিয়ে, ছাত্র রাজনীতির ঘোর অমানিশা ঘুচাতে শোভন সত্যি সত্যিই ‘আত্মত্যাগ’ করলেন। বিরল এই ত্যাগের মধ্যে দিয়ে ছাত্রলীগ নেতা থেকে জাতীয় নেতা হিসেবেও যেন আত্মপ্রকাশ ঘটলো মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, আওয়ামী লীগের কয়েকবারের সংসদ সদস্য প্রয়াত শামসুল হক চৌধুরী’র নাতি এবং সাবেক ছাত্রলীগার বাবা নূরুন নবী চৌধুরী খোকনের এই সন্তানের।
দলটির নেতা-কর্মীরা বলছেন, সবকিছুর স্বার্থে শোভন নিজেকে ‘বলি’ দিয়ে প্রমাণ করেছেন তিনি ‘শেখ হাসিনার ছাত্রলীগের সভাপতি’। যার কাছে মুকুট বা সাম্রাজ্য নয়, ব্যক্তির চেয়ে দল বড়-চিরায়ত এই শ্বাশ্বত বাণীই যিনি হৃদয়-মনে ধারণ করেন।
তিনি রচনা করলেন রক্তারক্তির বদলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়ের। আর তাইতো ছাত্রলীগের দুর্দিনের কান্ডারী মারুফা আক্তার পপি বলেছেন, ‘শুধু আশীর্বাদ নয় স্যালুট তোমাকে (শোভন)।’
অথচ শোভন ছাত্র রাজনীতিতে এমন অনুপ্রেরণার অনির্বাণ শিখা হয়ে অনন্য মর্যাদায় নিজেকে উদ্ভাসিত নাও করতে পারতেন। ডাকসু নির্বাচন ও ফলাফল নিয়ে কী তীব্র উত্তেজনাই না বিরাজ করছিলো সোমবার (১১ মার্চ) মধ্যরাত ৩ টা থেকে পরদিন মঙ্গলবার (১২ মার্চ) সন্ধ্যা নাগাদ ক্যাম্পাসে।
ঘটেছে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। ভিপি পদে পুননির্বাচনের দাবিতে ভিসির বাসভবন ঘেরাও করে রেখেছিল ছাত্রলীগ। অন্যদিকে রাজু ভাস্কর্যের সামনে বিক্ষোভে অংশ নেয় অন্যান্য প্যানেলের প্রার্থীরা। তারা ঘোষণা দেয় ভিপি পদ ছাড়া বাকিগুলোতে পুননির্বাচন দিতে হবে। এ সময় ক্যাম্পাসের ছাত্রলীগের ধাওয়ার মুখে পড়েন নব নির্বাচিত ভিপি নুরুল হক নুরও।
অনেকেই বলছেন, শোভন নিজের আত্মদানের মাধ্যমে অজানা শঙ্কা-আশঙ্কায় উৎকন্ঠিত ১৭ কোটি বাংলাদেশীর চোখে স্বপ্নের অমর জ্যোতি জ্বালিয়েছেন। নিজের সর্বোচ্চ ত্যাগের বিনিময়ে উপহার দিয়েছেন গণতন্ত্রের চূড়ান্ত বিজয়ের। উজ্জ্বল করেছেন মুজিবকন্যা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মুখ।
নিজেকে তুলে নিয়েছেন অবিশ্বাস্য এক উচ্চতায়। যেখানে কথিত ‘মানবতার ফেরিওয়ালার’ তকমা আঁটা জগদ্দল পাথর সদৃশ নেতাদের বিজয়োল্লাস মাটিচাপা পড়েছে। উপহার দিয়েছেন গৌরবদৃপ্ত বিজয় ও অহংকারের অবিস্মরণীয় মঙ্গলবার (১২ মার্চ)। জয়তু শোভন।
কালের আলো/এমআর/এএ