যুদ্ধ জয়ের সক্ষমতা দেখালো বাংলার অকুতোভয় সেনারা, সার্বভৌমত্ব রক্ষায় প্রস্তুত থাকার বার্তা প্রধান উপদেষ্টার

প্রকাশিতঃ 9:35 pm | January 05, 2025

এম.আব্দুল্লাহ আল মামুন খান, অ্যাকটিং এডিটর:

মুহুর্মুহু গুলির শব্দে প্রকম্পিত চারপাশ। শত্রুকে পরাস্ত করতে ব্যবহার করা হচ্ছে অত্যাধুনিক ট্যাংক, এপিসি ও গোলন্দাজ বাহিনীর কামান। বহি:শত্রুর বিরুদ্ধে চলছে তীব্র লড়াই। শত্রুকে প্রতিহত করতে প্রাণপণে লড়ছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। ঠিক যেন যুদ্ধের দামামা! বাংলাদেশের চৌকস সেনা সদস্যদের বজ্র আঘাতে একে একে ধ্বংস হচ্ছে শত্রুর ঘাঁটি। মহড়ায় অংশ নেয় বাংলাদেশ বিমান বাহিনীও। তাদের আধুনিক জঙ্গি বিমান, আর্মি এভিয়েশনের যুদ্ধ বিমান, হেলিকপ্টার ও প্যারা কমান্ডোর আক্রমণে পিছু হটতে বাধ্য হয় শত্রু বাহিনী। অকুতোভয় দামাল সেনাদের সামনে কোন অবস্থাতেই তাঁরা টিকতে পারেনি। কুপোকাত হতে হয়েছে ক্ষিপ্রতা, দক্ষতা আর কৌশলের কাছে।

হিমালয়সম সাহস, দৃঢ় মনোবল আর দক্ষতায় বিজয়ের কাক্সিক্ষত হাসি বাংলার বীর সেনাদের মুখে। উচ্ছ্বাসমাখা সুবর্ণ জয়ের জয়োধ্বনি তখন কণ্ঠে কণ্ঠে। যার মাধ্যমে তাঁরা দেখিয়ে দিলো নিজেদের শক্তিমত্তা ও যুদ্ধ জয়ের সক্ষমতা। নতুন বছরের শুরুতেই তাঁরা বারতা দিলো দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় যেকোন পরিস্থিতিতেই প্রস্তুত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। গল্পের এমন বাস্তবিক দৃশ্যপটেই রাজবাড়ীর সাদারচরে সামরিক প্রশিক্ষণ এলাকায় ৫৫ পদাতিক ডিভিশনের আয়োজনে সশস্ত্র বাহিনীর দক্ষতা বৃদ্ধিতে শত্রুর বিরুদ্ধে হয়ে গেলো এমন এক ছায়া যুদ্ধ। রোববার (০৫ জানুয়ারি) সেনাবাহিনীর শীতকালীন প্রশিক্ষণের চূড়ান্ত মহড়ার শেষ দিনে ফুটিয়ে তোলা হয় এমন অভিনব দৃশ্যপট।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই রণকৌশল দেখতে এদিন ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারযোগে অনুশীলনস্থলে গিয়ে ঘণ্টাব্যাপী মহড়া পর্যবেক্ষণ করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড.মুহাম্মদ ইউনূস। এ সময় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান, নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল এম নাজমুল হাসান ও বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খাঁন তাঁর সঙ্গে ছিলেন। প্রধান উপদেষ্টা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে সার্বভৌমত্ব রক্ষায় প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান। এর মাধ্যমে আরও আভিযানিক দক্ষতা অর্জন করবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এমন প্রত্যাশার কথাও জানান তিনি। এ সময় প্রধান উপদেষ্টার প্রতিরক্ষা ও জাতীয় সংহতি উন্নয়ন বিষয়ক বিশেষ সহকারী লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব:) আব্দুল হাফিজ, সেনাবাহিনীর ৫৫ পদাতিক ডিভিশনের জেনারেল অফিসার কমান্ডিং (জিওসি) ও যশোরের এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল জে এম ইমদাদুল ইসলামসহ উচ্চ পদস্থ সেনা কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

  • এবারের মহড়ায় ব্যবহার করা হয় নতুন সংযোজিত তুর্কি ড্রোন
  • ছিল তিন ধরনের আর্টিলারি গান; অংশ নেয় একটি পূর্ণ পদাতিক ব্রিগেড গ্রুপ
  • সেনাবাহিনীর মূল লক্ষ্যই বিজয়ী হওয়া ও দেশকে রক্ষা করা
  • যুগোপযোগী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সর্বদা নিজেদেরকে প্রস্তুত রাখবে সশস্ত্র বাহিনী

আধুনিক ও যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ দক্ষতায় জোর সেনাপ্রধানের
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান দায়িত্বভার গ্রহণের পর থেকেই আধুনিক ও যুগোপযোগী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতা অর্জনে জোর দিয়েছেন। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন- কার্যকর প্রশিক্ষণই সৈনিকের সর্বোত্তম কল্যাণ ও যুদ্ধক্ষেত্রে সাফল্যের চাবিকাঠি। ফলত সেনাপ্রধান সৈনিকদের মানসক্ষেত্রের নির্ভুল রূপায়নে সংবেদী সত্তার অভীস্পায় উদ্দীপ্ত করার প্রাণান্তকর প্রয়াসের মাধ্যমে উন্নত মনোবল অর্জনকে প্রোজ্জ্বলিত করেছেন চেতনার স্পন্দনে, অমিত শক্তি আর প্রগাঢ় আত্মবিশ্বাসে।

‘সবুজের বুকে লাল, সে তো উড়বেই চিরকাল’
বিদায়ী বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ম্যানুভার অনুশীলন শুরু হয়। প্রধান উপদেষ্টার অবলোকনের মধ্যে দিয়ে রোববার (০৫ জানুয়ারি) এটি শেষ হয়। এবারের মহড়ায় ব্যবহার করা হয় নতুন সংযোজিত তুর্কি ড্রোন। এছাড়াও ছিল তিন ধরনের আর্টিলারি গান। শীতকালীন এই অনুশীলনে অংশ নেয় একটি পূর্ণ পদাতিক ব্রিগেড গ্রুপ। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই রাজবাড়ি জেলায় ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরোধ কেন্দ্র। এজন্য এখানকার সামরিক কেন্দ্র থেকে এবার শীতকালীন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জানান দেওয়া হলো বাংলাদেশ চৌকস সেনাবাহিনীর যুদ্ধের সক্ষমতা। যার নাম দেওয়া হয় ‘বজ্রাঘাত’। যার মাধ্যমে বার্তা ছিল-সবুজের বুকে লাল, সে তো উড়বেই চিরকাল।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যুদ্ধ প্রস্তুতি পর্যবেক্ষণে ‘মুগ্ধ’ প্রধান উপদেষ্টা
বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর যুদ্ধ প্রস্তুতি পর্যবেক্ষণ করে নিজের মুগ্ধতার কথা প্রকাশ করেন প্রধান উপদেষ্টা ড.মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, ‘যুদ্ধের যে মহড়া দেখলাম অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে এবং সুন্দরভাবে এটি আয়োজন ও বাস্তবায়ন করার জন্য সংশ্লিষ্ট সকলকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। একটি চমৎকার অভিজ্ঞতা নিয়ে গেলাম। কত সুন্দরভাবে একটি যুদ্ধ পরিচালনা করা যায়, কত সাহসের সঙ্গে এগিয়ে যাওয়া যায়, যদিও এটি বাস্তব নয়, এটি মহড়া মাত্র। এই মহড়া থেকেই বাস্তবের সৃষ্টি এবং প্রস্তুতি। যাতে করে প্রকৃত যুদ্ধে আমরা সফলভাবে বিজয়ী হয়ে আসতে পারি।’

তিনি বলেন, ‘সেনাবাহিনীর মূল লক্ষ্যই বিজয়ী হওয়া, দেশকে রক্ষা করা। সকল পরিস্থিতিতে। বলা যাবে না, এটি বর্ষার দিন এখন পারবো না, এখন বেশি গরম, পারা যাবে না। এটি বলার উপায় নেই। যেকোন পরিস্থিতিতে পূর্ণ সাহস ও প্রস্তুতি নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়। সেটির প্রস্তুতি হিসেবেই একটি মহড়া হলো। বাস্তব যুদ্ধে আমাদের যা করতে হবে সেটির ওপর প্রস্তুতি। আমরা সিনেমার পর্দায় যুদ্ধ দেখি সব সময়। ইতিহাসের বহু বড় বড় যুদ্ধ সিনেমার পর্দায় দেখি। প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের প্রকৃত ছবিগুলো দেখি। কীভাবে ব্যাটেলগুলো পুরো যুদ্ধে শত্রুর সম্মুখীন হয়েছে সেই দৃশ্য দেখি। করুণ ও সাহসের দৃশ্য দেখি। অনেকগুলো আমাদের স্মৃতিতে অমর হয়ে থাকে তাদের বীরত্ব ও সাহসের জন্য। বহু ব্যাটল পৃথিবীতে বিখ্যাত হয়ে আছে। শত্রুর কাছ থেকে বিজয় ছিনিয়ে এনেছে। সবকিছু এভাবেই হয়। আজ যেটি দেখে ভালো লাগলো, যাতে ক্রমাগতভাবে আমরা প্রস্তুত থাকতে পারি। সৈনিকদের অভিনন্দন জানাচ্ছি। ক্রমাগতভাবে এটি আরও সুন্দরভাবে গড়ে ওঠবে এই আশা করছি। এই প্রস্তুতির মধ্যে বারবার আসবে পারফেকশন। এটি শুধু যুদ্ধই নয় সবক্ষেত্রেই থাকে। খেলাধূলায় যে যতো বেশি খাটে, পরিশ্রম করে প্রস্তুতি নেয়, খেলায় তাঁর জেতার সম্ভাবনাই বেশি। এই পারফেকশনের জন্যই আমাদের সার্বক্ষণিক প্রচেষ্টা চলতে থাকবে।’

ভবিষ্যতে সশস্ত্র বাহিনীর সক্ষমতার আরও আধুনিকায়নের অঙ্গীকার
প্রথমেই মহান আল্লাহর কাছে সবার সুস্থতা ও নিরাপত্তার জন্য শুকরিয়া আদায় করেন প্রধান উপদেষ্টা। নিজের বক্তব্যে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই মহড়ায় আপনাদের কাছে আসতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। একজন শান্তিকামী মানুষ হিসেবে আমি বরাবরই যুদ্ধের চেয়ে শান্তির মহড়া দেখতে বেশি আনন্দবোধ করি। তবে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে প্রস্তুতির লক্ষ্যে সামরিক বাহিনীর এই প্রশিক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আজকের এই মহড়ায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যদের দক্ষতা অত্যন্ত প্রশংসিত। এই মহড়ায় আমি সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনীর সক্ষমতা সম্পর্কে আরও আত্মবিশ্বাসী হয়েছে। ভবিষ্যতে আমরা সশস্ত্র বাহিনীর এই সক্ষমতা আরও আধুনিকায়নের জন্য আমরা কাজ করে যাবো।’

‘প্রশিক্ষণই সর্বোত্তম কল্যাণ’-এই মন্ত্রে উদ্ধুদ্ধ হয়ে আধুনিক ও যুগোপযোগী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আভিযানিক দক্ষতা অর্জন করে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরা সর্বদা প্রস্তুত থাকবে বলেও মনে করেন তিনি। প্রধান উপদেষ্টা ড.মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘সে লক্ষ্যে সেনা সদস্যদের প্রশিক্ষণ হতে হবে বাস্তবসম্মত। আমি নিশ্চিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রশিক্ষণের এই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই এগিয়ে চলেছে। এইরকম একটি মহড়ার আয়োজন করতে হলে অনেক পরিশ্রম, পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের প্রয়োজন। এই মহড়া দেখে আমি বুঝতে পেরেছি এটি আয়োজনে ৫৫ পদাতিক ডিভিশন সকল সদস্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে। তাই আমি কনিষ্ঠতম সদস্য থেকে জিওসি পর্যন্ত সকলকে ধন্যবাদ দিতে চাই। এছাড়াও আমাকে এই মহড়ার আমন্ত্রণ জানানোর জন্য আমি সেনাবাহিনী প্রধানকে বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাতে চাই। বরাবরের মতোই বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী দেশের সম্মান ও গৌরব অটুট রাখতে জনগণের পাশে থেকে কাজ করে যাচ্ছে। যুগোপযোগী প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সর্বদা নিজেদেরকে প্রস্তুত রাখবে এই প্রত্যাশা আমার।’

কালের আলো/এমএএএমকে