ডেঙ্গু প্রতিরোধে গড়ে ওঠেনি সমন্বিত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা

প্রকাশিতঃ 10:14 am | January 06, 2025

রাইসুল ইসলাম খান, কালের আলো:

ডেঙ্গু জ্বরবাহী এডিস মশা নিধনে কার্যকর উদ্যোগ নেই। ফলে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তদের সংখ্যা বাড়ছে। ২০০০ সাল থেকে দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হলেও দীর্ঘ দুই যুগেও ডেঙ্গু প্রতিরোধে গড়ে ওঠেনি সমন্বিত ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাপনা। সবার সমন্বিত অংশগ্রহণের মাধ্যমে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে সামনের দিনগুলোতে বড় ধরনের বিপর্যয় হতে পারে।

গত বছর বর্ষা শেষ হলে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা বাড়তে পারে বলে আগাম সতর্কবার্তা জানিয়েছিলেন জনস্বাস্থ্যবিদ এবং কীটতত্ত্ববিদেরা। এই সতর্কবার্তা আমলে না নেওয়া ও দৃশ্যমান কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ার ফলেই ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

গত পাঁচ বছরের মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ সংক্রমণ (২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত) ঘটেছে গত বছরে। আর মৃত্যুর হিসেবে দ্বিতীয়। এর আগে ২০১৯ ও ২০২৩ সালে ডেঙ্গুতে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে এক লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন, ২০২০ সালে এক হাজার ৪০৫ জন, ২০২১ সালে ২৮ হাজার ৪২৯ জন এবং ২০২২ সালে ৬২ হাজার ৩৮২ জন এবং ২০২৩ সালে মোট ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন।

অপরদিকে, গত বছর ২৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন মোট এক লাখ ৪৯১ জন। যার মধ্যে ৬৩ দশমিক ১০ শতাংশ পুরুষ এবং ৩৬ দশমিক ৯০ শতাংশ নারী। আর সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন ৯৮ হাজার ৯৮০ জন। এই পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ৫৬৫ জন মারা গেছেন। যার মধ্যে ৫১ দশমিক ৭০ শতাংশ নারী এবং ৪৮ দশমিক ৩০ শতাংশ পুরুষ। গত বছরে সর্বোচ্চ আক্রান্তের ঘটনা ঘটে অক্টোবর মাসে। ওই মাসে সারাদেশে মোট ৩০ হাজার ৮৭৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়। আর সর্বোচ্চ মৃত্যু ঘটে নভেম্বর মাসে। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় ১৭৩ জন।

মাস ভিত্তিক তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল এক হাজার ৫৫ জন, মারা যায় ১৬ জন। ফেব্রুয়ারিতে ৩৩৯, মার্চে ৩১১, এপ্রিলে ৫০৪, মে মাসে ৬৪৪, জুনে ৭৯৮, জুলাইয়ে ২ হাজার ৬৬৯ জন, আগস্টে ৬ হাজার ৫২১ জন, সেপ্টেম্বরে ১৮ হাজার ৯৭, অক্টোবরে ৩০ হাজার ৮৭৯, নভেম্বরে ২৯ হাজার ৬৫২ এবং ডিসেম্বরের ২৪ তারিখ পর্যন্ত ৯ হাজার ২২ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। আর জানুয়ারিসহ প্রতি মাসেই ডেঙ্গুতে মৃত্যু দেখেছে দেশবাসী। জানুয়ারিতে ১৬, ফেব্রুয়ারিতে ৫, মার্চে ৬, এপ্রিলে ২, মে মাসে ১২, জুন মাসে ৮, জুলাইয়ে ১৪, আগস্টে ৩০, সেপ্টেম্বরে ৮৭, অক্টোবরে ১৩৫, নভেম্বরে ১৭৩ এবং ডিসেম্বরে ৭৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের প্রধান কাজ হওয়া উচিত ডেঙ্গু মশার প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ। ওয়ার্ডভিত্তিক এডিস মশা নিধনে টিম গঠন করে কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি সাধারণ মানুষকেও পরিচ্ছন্ন সিটি গড়ার কার্যক্রমে যুক্ত করা। মশার বিরুদ্ধে একটি কার্যকর ও সর্বাত্মক অভিযান পরিচালনা করা। মশা মারতে না পারলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না। মশা মারার কাজে মনোনিবেশ না করলে ডেঙ্গুর ভয়াবহ বিস্তার রোধ করা যাবে না।

প্রসঙ্গত, ডেঙ্গু ভাইরাস থেকে মূলত দুই ধরনের সংক্রমণ হয়—সাধারণ ডেঙ্গু জ্বর ও মারণাত্মক ডেঙ্গু হেমারেজিক ফিভার বা ডেঙ্গু সিনড্রোম শক। যদিও চটজলদি রোগ নির্ণয় এবং হাসপাতালে আপৎকালীন শুশ্রূষার মাধ্যমে দ্বিতীয় ক্ষেত্রে মৃত্যুর ঝুঁকি অনেকটাই এড়ানো যাচ্ছে, তবু মৃত্যু ঘটছে। কারণ, আজ পর্যন্ত এই ধরনের জ্বরের সঠিক চিকিৎসা বেরোয়নি। মানবদেহে ডেঙ্গুর সংক্রমণ পদ্ধতি অত্যন্ত জটিল। এপিডেমিয়োলজির তত্ত্ব বলছে, অনুকূল পরিবেশে (ঠিক বর্ষা-পরবর্তী সময়ে) এ রোগের ভাইরাস মশা দ্বারা মানবদেহে বসতি বিস্তার ও সংক্রমণ ঘটায়। যেহেতু ডেঙ্গু রোগের সঠিক চিকিৎসাপদ্ধতি বা প্রতিষেধক টিকা এখনো সেভাবে আবিষ্কার হয়নি, তাই মশকনিধনযজ্ঞ বিনা আর উপায় নেই। আর ঠিক এখানেই চিকিৎসাশাস্ত্র মুখ থুবড়ে পড়েছে।

কারণ, মশাকে প্রতিষেধক দিয়ে প্রি-প্রোগ্রামও করা যায় না বা ওষুধ দিয়ে রি-ফিক্সও করা যায় না। ডেঙ্গুকে জনস্বাস্থ্যের প্রেক্ষাপটে বুঝতে হবে, যার ব্যাপ্তি চিকিৎসাশাস্ত্র থেকে বহুগুণ বেশি। জনস্বাস্থ্যের পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে, ডেঙ্গুর অন্যতম কারণ হলো অপরিকল্পিত নগরায়ণ। মশক নিধনে ক্রমাগত ব্যর্থতা, ক্রমবর্ধমান বিশ্বায়ন এবং অবশ্যই রোগ নিরাময়ে চিকিৎসাশাস্ত্রের আশানুরূপ অগ্রগতি না হওয়া। জনসচেতনতার অভাবও এর জন্য কম দায়ী নয়।

ডেঙ্গু সংক্রমণে মধ্যেই নতুন করে শঙ্কা বাড়িয়েছে চিকনগুনিয়া এবং জিকা ভাইরাসের সংক্রমণ। এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘গত বছরের অক্টোবর ও নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বৃষ্টি হয়েছে। সেই বৃষ্টিতে মশা ডিম দিয়েছে। ওই ডিম পূর্ণবয়স্ক মশা হয়ে একজন ডেঙ্গু রোগীকে দংশন করে ভাইরাসটা পেটের মধ্যে নিয়ে সুস্থ লোককে কামড় দিচ্ছে। ভাইরাস বা মশার এই জীবনচক্র সম্পন্ন হতে দেড় থেকে দুই মাস সময় লাগে। ফলে এই প্রকোপ স্বাভাবিক। এরপর পরিস্থিতি ঠিক হবে। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির দিকে সংক্রমণ কিছুটা কমে আসবে বলে আশা করছি। আগামী বছরের মার্চ-এপ্রিলে থেকে বৃষ্টি শুরু হলে তা বাড়তে থাকবে।’

কালের আলো/আরআই/এমকে